২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঠিকাদারদের অর্থ অল্প ধীরগতির অনেক গল্প

উন্নয়ন প্রকল্পের হালচাল-৬
-

দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর ধীরগতি বা নির্ধারিত মেয়াদে শেষ না হওয়ার পেছনে ভূমি অধিগ্রহণই মূল কারণ হিসেবে কাজ করছে। এ ছাড়া ২৫ কোটি টাকার বেশি কোনো বিনিয়োগ প্রকল্প হলে তার সম্ভাব্যতা যাচাই বা সমীক্ষা করার বিধান থাকলেও তা পরিপালন করা হচ্ছে না। যার কারণে প্রাক্কলন ঠিক মতো হচ্ছে না। অন্য দিক বিভিন্ন কারণে একজন ঠিকাদারকে একাধিক কাজ দেয়ার কারণে ঠিক মতো কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হচ্ছে সে। আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই এমন ঠিকাদারকে একাধিক কাজ দেয়া হচ্ছে। চলমান এক শ’টি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ স্থাপন প্রকল্পে এই দুর্বলতাগুলো ধরা পড়েছে পরিকল্পনা কমিশনের আইএমইডির চোখে। আইএমইডি বলছে, একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান একাধিক কাজ পাওয়ার ব্যাপারে সরকারকে একটি সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন।
প্রকল্প প্রেক্ষাপটের তথ্য থেকে জানা গেছে, সমগ্র বিশ্বে উৎপাদন কৌশল খুব দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তন বিশ্বকে পরিচালনা সহজ করেছে। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ব শ্রমবাজারে দক্ষ মানবসম্পদ সরবরাহকারী হিসেবে অবদান রাখার জন্য সরকার এক শ’টি উপজেলায় একটি করে টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপনের অনুমোদন দেয় ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে।
প্রকল্পে উদ্দেশ্য ও প্রধান কার্যক্রম
বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একটি কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্তকরণ, এসএসসি (ভোকেশনাল) এবং সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ কোর্স চালুকরণের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করা, দেশে-বিদেশে চাকরির সুযোগ সৃষ্টির জন্য যুব সমাজকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করা। প্রস্তাবিত টেকনিক্যাল স্কুল পর্যায়ে চারটি ট্রড কোর্স এবং চারটি প্যারা ট্রেডের ওপর সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একটি কারিগরি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে কোর্স প্রবর্তন করা। এই এক শ’টি টিএসসিতে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেলী পর্যন্ত সর্বমোট এক লাখ ৮ হাজার জন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করবে।
প্রকল্পের আওতায় কাজগুলো হলোÑ প্রতিটি স্কুল ও কলেজ স্থাপনে ন্যূনতম দেড় একর ভূমি অধিগ্রহণ, টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের ভৌত ও নির্মাণ সম্পাদন, প্রতিটি টিএসসিতে চারটি ট্রেড, ল্যাব ও ওয়ার্কশপের যন্ত্রপাতি এবং প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র ক্রয় ও সরবরাহ। এসবে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৬ হাজার ৪০০টি স্থায়ী পদ সৃজন। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন পদে ৪০০টি জনপদ সৃষ্টি করা।
দফায় দফায় মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি
দুই বছরে যে প্রকল্পটি সমাপ্ত করার জন্য ২০১৪ সালে একনেক থেকে যে অর্থ ব্যয় নির্ধারণ করে অনুমোদন দেয়া হয় তাতে কোনো অগ্রগতিই পাওয়া যায়নি। ২০১৬ সালের জুনে যেখানে প্রকল্পটি সমাপ্ত হওয়ার কথা সেখানে শুধু ৯০ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণেই খরচ হয়েছে চারটি বছর। প্রকল্পের শুরুতেই অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৯২৪ কোটি ৩ লাখ টাকা। প্রথমবার সংশোধন করেই ব্যয় বৃদ্ধি পায় ১৪৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়। ফলে সংশোধিত এক লাফে খরচ ২ হাজার ২৮১ কোটি ৬৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকায় উন্নীত হয়। ২০১৮ সালের জুনে সমাপ্ত করার জন্য মেয়াদ বর্ধিত করা হয়। জমির দর বৃদ্ধি, পূর্ত বিভাগের রেট শিডিউল পরিবর্তন, শিক্ষাকার্যক্রম উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে উন্নীতকরণ, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী পাঠদান করার জন্য স্কুলের স্পেস বাড়ানোর কারণে ব্যয় ও সময় বাড়ানো হয়। অগ্রগতি তেমন না হওয়ায় আবার বিশেষ নামে সংশোধন করা হয়। এখানে মেয়াদকাল সাড়ে তিন বছর বাড়িয়ে ২০২১ সালের ডিসম্বের পর্যন্ত অনুমোদন দেয়া হয়। ব্যয় ২ দশমিক ৩৭ শতাংশ বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি ৬৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা করা হয়।
সরেজমিনে ৬ বছরে অগ্রগতি
সার্বিকভাবে গত এপ্রিল পর্যন্ত প্রকল্পের পেছনে অর্থ ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬৯০ কোটি ৫৩ লাখ ৩৩ হাজার টাকা বা ৩০ শতাংশ। এই অর্থ খরচে বাস্তব অগ্রগতি ৪৫ শতাংশ। মূলত ৯০ শতাংশ ভূমি অধিগ্রহণে সময় লেগেছে প্রায় ৪ বছর। ভূমি অধিগ্রহণ করে তা হস্তান্তর করতে গড়ে ছয় মাস লেগেছে। আর গণপূর্ত ও নির্মাণ কাজের কার্যাদেশ দিতে সময় লেগেছে গড়ে দেড় বছর। বিভিন্ন জটিলতায় কয়েকটি ক্ষেত্রে আরো বেশি সময় লেগেছে। প্রকৃতপক্ষে নির্মাণ কাজের আদেশ দেয়া শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। ২০১৬ সালে কোনো কার্যাদেশ দেয়া হয়নি। তবে ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল সময়ের মধ্যে কার্যাদেশ দেয়া হয় মোট ৮৭টি। কয়েকটিকে রি-টেন্ডার করে কার্যাদেশ দিতে বিলম্ব হয়। কিছু জায়গায়তে ভূমি নিচু হওয়ার কারণে পাহাড় থেকে তা সমতল করা হয়। আর ১৫টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ২ থেকে ৯টি করে কাজ পেয়েছে প্রতিজন। তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণ, অর্থ সঙ্কট, নির্মাণসামগ্রী সময়মতো সরবরাহ না থাকায় কাজে ধীরগতি। চুক্তিপত্র অনুযায়ী সবক্ষেত্রেই কাজের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ব্যয় ব্যতীত দ্বিতীয় মেয়াদে সময় বৃদ্ধি চলছে। তবে নির্ধারিত ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমাপ্ত হওয়া নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের বিএসসি (সিভিল) ইঞ্জিনিয়ার ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারা সাইটে কাজ নিয়মিত পরিদর্শন করার কথা। কিন্তু এখানে ব্যত্যয় ঘটছে।
ছাড়কৃত অর্থও ব্যবহারে ব্যর্থ
প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রতি অর্থবছর যে পরিমাণ অর্থ ছাড়করণ করা হয় তাও ব্যবহার করতে পারেনি বাস্তবায়নকারী সংস্থা। আইএমইডির তথ্যানুযায়ী, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ছাড়কৃত অর্থের মাত্র ৫৩.৪৩ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ছাড়কৃত ৭৫ শতাংশ অর্থের ৯৮.৮৫ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৮৯.৪৯ শতাংশ ছাড়কৃত অর্থের মাত্র ৪৯.৯৯ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ছাড়কৃত ৮৩.২০ শতাংশ অর্থের ৮১,১৪ শতাংশ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৫০ শতাংশ ছাড়কৃত অর্থের ৭০.৩৬ শতাংশ অর্থ খরচ করতে পেয়েছে প্রকল্পের পেছনে। ফলে কোনো বছরই ছাড়কৃত অর্থ পুরোটাই খরচ করতে পারেনি। গড়ে প্রকৃত খরচ হয়েছে ৩৫ শতাংশ। এটি অত্যন্ত ধীরগতি সম্পন্ন প্রকল্প।
রাজস্ব খাতে খরচের মধ্যে বেতনভাতা, সরবরাহ সেবা ও মেরামত খাতে এপ্রিল পর্যন্ত অগ্রগতি মাত্র ৮ শতাংশ। আর মূলধনী খাতের যানবাহন, যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র, ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়ন, ভৌত কাজে অগ্রগতি ৩০ শতাংশ। এখানে যানবাহন, যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। ভূমি অধিগ্রহণ ও উন্নয়নে অগ্রগতি ৯৬ শতাংশ। ভৌত কাজে ৩২ শতাংশ। নির্মাণকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো যন্ত্রপাতি ও আসবাবপত্র কেনা যাবে না। সেটার প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি।
আইএমইডি বলছে, বাস্তবায়নকারী সংস্থার পরিকল্পনাগত সমস্যার কারণেই ভূমি নির্বাচন ও অধিগ্রহণ, মাটি পরীক্ষা, কাঠামোগত ডিজাইন, আর্কিটেকচারাল ডিজাইন প্রণয়ন করে টেন্ডার আহ্বান করে কাজ শুরু করতে সময় বেশি নষ্ট হয়েছে। ১৫টি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে একাধিক টিএসসির (২-৯টি) কাজ দেয়া হয়েছে। যাদের অর্থ সঙ্কট রয়েছে। নির্মাণসামগ্রী সময়মতো সরবরাহ না থাকায় নির্মাণ কাজের গতি খুবই মন্থর। ভৌত অগ্রগতি এদের কাজের ৭ থেক ৩৫ শতাংশ। যদিও কাজ সমাপ্তির মেয়াদ প্রায় ক্ষেত্রেই শেষ হয়েছে। একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান একাধিক কাজ পাওয়ার ব্যাপারে সরকারকে একটি সিদ্ধান্তে আসা প্রয়োজন। পাশাপাশি এই প্রকল্পে আটটি সাইটের কাজ ৬ বছরে শুরু করা সম্ভব হয়নি। ১৪টির কাজের অগ্রগতি সর্বাচ্চ ৯ শতাংশ।


আরো সংবাদ



premium cement