আন্দোলন সফলের চ্যালেঞ্জ বিএনপির
- মঈন উদ্দিন খান
- ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০, আপডেট: ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৫৮
সরকারবিরোধী আন্দোলন সফলের ‘কঠিন’ চ্যালেঞ্জ নিয়ে আজ ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করছে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতার বাইরে থাকা দলটির সামনে এখন আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের কাউন্টডাউন চলছে। যে নির্বাচন নিয়ে তারা সরব রাজপথের আন্দোলনে। তবে সরকার পতনের লক্ষ্যে দলটির ঘোষিত এক দফা দাবি আদায়ের এ পথ সহজ নয় বলে মনে করছেন রাজনীতি বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আন্দোলন সফল করতে হলে বিএনপিকে আরো আত্মপ্রত্যয়ী ও প্রতিশ্রুতিশীল হতে হবে।
১৯৭৮ সালের এই দিনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে জন্ম হয় বেশ কয়েকবার রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির। দীর্ঘ এই পথপরিক্রমায় দলটি বহুবার সীমাহীন প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত এক-এগারো সরকারের সময়ে দলটির ওপর যে মামলা, হামলা, জেল, জুলুম শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা এখন এক লাখেরও বেশি। দলটির তথ্য অনুযায়ী, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৪০ লাখেরও বেশি। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে বর্তমান পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের নেতাকর্মী। এর বাইরে গুম হয়েছে পাঁচ শতাধিক।
প্রতিষ্ঠার পটভূমি : সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল প্রতিষ্ঠার আগে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করেছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচন এগিয়ে এলে তিনি বিএনপি গঠন করেন। রাষ্ট্রপতি জিয়া এই দলের প্রথম চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। অধ্যাপক এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ছিলেন প্রথম মহাসচিব। অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য এবং জনগণের মধ্যে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন জাগিয়ে তোলাই ছিল জিয়াউর রহমানের মূলমন্ত্র। এর ফলে দলটি প্রতিষ্ঠার অল্প সময়ের মধ্যেই অভূতপূর্ব সাফল্য পায়। জিয়াউর রহমান স্বল্প সময়ের অক্লান্ত কর্মের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে পড়েন পুরো বাংলাদেশে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতির সাথে ইসলামী মূল্যবোধের মিশ্রণ তার দলকে আরো জনপ্রিয় করে তোলে। তার ঘোষিত ১৯ দফাকে দল ও সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘রাজনৈতিক দর্শন’ হিসেবেই আখ্যায়িত করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে বিপথগামী কিছু সেনাসদস্যের হাতে জিয়াউর রহমান শাহাদতবরণের কিছু পর স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপির রাজনীতিতে উত্থান ঘটে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার। পরে তিনি তিন দফায় দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
করোনার কারণে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে গুলশানের বাসা ফিরোজায় রয়েছেন খালেদা জিয়া। দলটির নেতারা বলছেন, কার্যত তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক কোনো কার্যক্রমে তিনি অংশ নিতে পারছেন না। এরই মধ্যে তাকে চিকিৎসার জন্য অনেকবার হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য দল ও পরিবারের পক্ষ থেকে বারবার আবেদন জানানো হলেও সরকার প্রতিবারই তা নাকচ করে দিয়েছে।
আন্দোলন সফলের চ্যালেঞ্জ : বিএনপি এমন একটি সময়ে ৪৬ বছরে পা রাখছে, যখন দলটির সামনে আন্দোলন ছাড়া বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই বলে দলটির নেতারা বলেছেন।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের এক দফা দাবিতে চূড়ান্ত আন্দোলনের ‘শেষ ধাপে’ নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। মধ্য সেপ্টেম্বর থেকে এই আন্দোলন শুরুর পরিকল্পনা করছে দলটি, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত যা চলমান থাকবে। তবে গত ২৯ জুলাই ঢাকার প্রবেশপথে অবস্থান কর্মসূচির তিক্ত অভিজ্ঞতায় ‘সেই আন্দোলন’ জমানোই এখন বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ দলটির অনেক নেতার অভিমত, সভা-সমাবেশ, মানববন্ধন, পদযাত্রার মতো নরম কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি থাকলেও ‘শক্ত কর্মসূচি’তে তাদের সেভাবে পাওয়া যায় না। এ বিষয়টি ভাবাচ্ছে হাইকমান্ডকে। যদিও অবস্থান কর্মসূচির ‘ব্যর্থতা’ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে তাৎক্ষণিক কিছু সাংগঠনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় দল। এর ইতিবাচক ফলও পেতে শুরু করেছে বলে দাবি নেতাদের। বিএনপি প্রত্যাশা করছে, আন্দোলনে দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে জনগণের রাজনৈতিক ভাগ্য বদলানোর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ১৬ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির এবার আন্দোলনে জেতাটাই একমাত্র লক্ষ্য। কারণ এবার বিএনপিকে ছাড়া সরকার যদি নির্বাচন করতে পারে, তাহলে দলটি আরো সঙ্কটে পড়তে পারে। এ বিষয়টি বিএনপির নেতৃত্বও বিবেচনায় নিচ্ছে বলে দলটির নেতাদের অনেকে বলছেন। তাই আগামী দিনে আন্দোলন সফল করাই বিএনপির বড় চ্যালেঞ্জ।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, রাজনীতি এমন একটি জিনিস যেখানে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ থাকে। বিএনপি ৪৫ বছর ধরে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই রাজনীতি করে এসেছে। আজকে যে চ্যালেঞ্জ সেটা হচ্ছে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জটি ছিল বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের চ্যালেঞ্জ। কাজেই আমরা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে কাজ করে যাচ্ছি। তিনি আরো বলেন, আমরা এ দেশে মৃত গণতন্ত্রকে পুনরুজ্জীবিত করতে চাই। সেই প্রক্রিয়াটিও হতে হবে গণতান্ত্রিক। সেই কারণেই আমরা বিগত এক বছর ধরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে রাজধানীতেই শুধু নয়; গ্রামগঞ্জে, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যন্ত জনসমাবেশ করেছি। মানুষকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশের বর্তমান একনায়কতন্ত্রের বাকশালী পদ্ধতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছি। এই চ্যালেঞ্জে আমরা অতীতে জয়ী হয়েছি। যেমন একবার সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন, যেভাবে এক দিন বেগম খালেদা জিয়া এ দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন করেছিলেন, সেভাবেই আমরা আগামীতে বাংলাদেশে আবার গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনব, বাংলাদেশের মানুষের ভোটের অধিকার তাদেরকে ফিরিয়ে দেবো।
কর্মসূচি : প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দুই দিনের কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। দিবসটি উপলক্ষে আজ শুক্রবার ভোরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারা দেশের দলীয় কার্যালয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। বেলা ৩টায় রাজধানীতে বর্ণাঢ্য র্যালি অনুষ্ঠিত হবে। নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে থেকে র্যালিটি শুরু হয়ে ফকিরাপুল মোড়, নটর ডেম কলেজ, শাপলা চত্বর, ইত্তেফাক মোড় হয়ে রাজধানী মার্কেটে গিয়ে শেষ হবে। নেতাকর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণে র্যালিকে এক দফার কর্মসূচির মতো রূপ দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে হাইকমান্ড। এ ছাড়া গতকাল বৃহস্পতিবার গুলিস্তানের মহানগর নাট্যমঞ্চে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ দিকে সারা দেশের ইউনিটগুলোতে নিজ নিজ সুবিধানুযায়ী প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হবে। দিবসটি সামনে রেখে এরই মধ্যে পোস্টার প্রকাশ করা হয়েছে। বিএনপির ৪৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী, শুভানুধ্যায়ী এবং দেশবাসীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে বাণী দিয়েছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জানা গেছে, দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে এক দফার আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার চিন্তা রয়েছে নীতিনির্ধারকদের। আর সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে গিয়ে আন্দোলন গতি লাভ করবে। ওই সময় ঢাকায় ফের মহাসমাবেশ, গণসমাবেশ বা বড় ধরনের কর্মসূচির চিন্তা রয়েছে হাইকমান্ডের। তখন কর্মসূচি হবে আবার ঢাকাকেন্দ্রিক। বিচারালয়ের সামনে অবস্থান ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ঘেরাওয়ের সাথে টানা অবস্থানের কর্মসূচি দেয়ার চিন্তা রয়েছে বিএনপির।
নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে, নভেম্বরে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করা হবে। বিএনপি তফশিল হওয়ার আগেই রাজপথে এক দফা আন্দোলনের ফয়সালা করতে চান নীতিনির্ধারকরা। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আন্দোলন পরিকল্পনা সাজাচ্ছে বিএনপি। দলের নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকেই ঢাকাকেন্দ্রিক টানা কর্মসূচি দিয়ে অক্টোবরে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে নেয়ার চেষ্টা থাকবে তাদের। সেই আন্দোলনে দলটি আর কোনো ভুল করতে চায় না। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি।
বিএনপি নীতিনির্ধারকরা বলেছেন, আগামীতে বিএনপি ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো আলোচনায় সাড়া দেবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বক্তব্য না আসবে।
রাজনৈতিক কলাকৌশলের পাশাপাশি রাজনীতিতে প্রভাবশালী দেশগুলোর সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে বিএনপি। বিএনপির বিশ্বাস, আগামী নির্বাচন ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা