৯০-এর পর শেয়ারবাজার লুট হয়েছে তিনবার

নব্বইয়ের দশকের পর শেয়ারবাজারে কারসাজি করে অন্তত তিনবার অর্থ লুণ্ঠন করা হয়েছে। এখানে ট্রেড বডিতে নির্বাচন হয় না, নমিনেশন বা চুক্তির মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। যার ফলে যিনি নির্বাচিত হন, তিনি সংগঠনের কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না। যে তাকে নির্বাচিত করেছেন তার হয়ে তিনি কাজ করার চেষ্টা করেন সব সময়।
এসব কথা বলেছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্র্য। গতকাল রোববার ষষ্ঠ সানেম অর্থনীতিবিদ সম্মেলনের সমাপনী দিনে ‘রাষ্ট্র এবং ব্যবসার মধ্যে শক্তির গতিশীলতা : বাংলাদেশে পুঁজিবাদ কিভাবে বিকশিত হচ্ছে?’ শীর্ষক আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।
বর্তমানে অতিমূল্যায়িত বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় আরো বলেন, বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে রাষ্ট্রকে দহন, শোষণ ও অবলোপনের মাধ্যমে। নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি-নির্ধারণের মাধ্যমে এখানে মূলধন সংগ্রহ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশে পুঁজি আহরিত হয়েছে তিনটি উপায়ে। প্রথমত, স্বাধীনতার পর যেসব পরিত্যক্ত সম্পদ ছিল, সেগুলো গ্রহণ ও লুণ্ঠন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, বিদেশী সহায়তায় অনেক অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প নিয়ে সেখান থেকে পুঁজি সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছে। তৃতীয়ত, উন্নয়ন অর্থায়নের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর সেখান থেকেই সূত্রপাত ঘটেছে অনাদায়ী ঋণের।
বর্তমানে অতিমূল্যায়িত বিভিন্ন প্রকল্প থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে পুঁজিবাদ সঠিক পথে এগোতে পারেনি। মেগা প্রকল্পের চেয়ে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে কম গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২০টি মেগা প্রকল্পের অর্ধেক বাজেট স্বাস্থ্য খাতে আর সমপরিমাণ বাজেট শিক্ষা খাতে; যা খুবই অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পিছিয়ে পড়া মানুষদের ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান এম এম আকাশ বলেন, রাজনীতি থেকে মানি পাওয়ার, মাসল পাওয়ার (পেশিশক্তি) ও ম্যানুপুলেশেন দূর করা না গেলে দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হবে না। এসব প্রভাবের কারণে বড় বড় ব্যবসায়ীর কাছে নতি স্বীকার করে সরকার। ফলে আইনকানুন ঠিক থাকে না, সুশাসন থাকে না। তখন একই অপরাধে একজন শাস্তি পায়, অন্য জন পায় না। তিনি আরো বলেন, রাজনীতিকে যদি অর্থশক্তির হাত থেকে মুক্ত করা না যায় তবে রাজনীতি এমনই হবে। অসৎ লোকের কাছে সর্বময় ক্ষমতা চলে যায়। তখন ভোট না করেও ভোট হয়, রাতের বেলা ভোট হয়, ১ টাকার কাজ করতে ৩ টাকা খরচ হয়। তাই বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে, তা এখনই ঠিক করতে হবে।
আলোচনায় প্যানেলিস্ট হিসেবে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রতিদ্বন্দ্বীশীল দলীয় ব্যবস্থা থেকে কর্তৃত্বশীল দলীয় ব্যবস্থায় গেছে। এটি নীতি-নির্ধারণীতে পুঁজিবাদের প্রভাব বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ বাংলাদেশে রাজনীতি করা খুবই ব্যয়বহুল। দেশে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচনের জন্য দেড় কোটি টাকা লাগে। যেখানে যুক্তরাজ্যে সংসদ সদস্য হতে এক লাখ ডলার ব্যয় করলেই চলে। এ পরিস্থিতি থেকে বের না হলে পুঁজিবাদের কাছে রাজনীতিবিদদের অবস্থা আরো দুর্বল করে তুলবে। যেসব দেশ রাজনীতিক ব্যবস্থাকে ব্যয়বহুল হওয়া থেকে আটকাতে পারেনি, সেসব দেশে আদানির মতো ব্যবসায়ী তৈরি হবে, ট্রাম্পের মতো নেতা সৃষ্টি হবে।
সানেমের এ আলোচনায় সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান। অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স এবং উন্নয়নের (বিআইজিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. মির্জা এম হাসান। এ ছাড়াও প্যানেল বক্তা হিসেবে ছিলেন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্ট নেটওয়ার্কের (বিইএন) প্রতিষ্ঠাতা ড. নুরুল ইসলাম ও অর্থনীতিবিদ ড. স্বপন আদনান।