২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`
৪ মাসের ব্যবধানে এলপি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি ৪৭.৩৬ শতাংশ

জ্বালানি তেলের দাম কমলো ভারতে, বাড়ল বাংলাদেশে

-

প্রতিবেশী দেশ ভারতে পেট্রোল ও ডিজেলের দাম কমানো হলেও দেশে কেরোসিন ও ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বা শতকরা ২৩ ভাগ বৃদ্ধি করে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এর একদিন না পেরুতেই একই সাথে গতকাল বৃহস্পতিবার এলপি গ্যাসের দাম ৪.২৯ শতাংশ বৃদ্ধি করে ১২ কেজির মূল্য ১ হাজার ২৫৯ টাকা থেকে ১ হাজার ৩১৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ নিয়ে চার মাসে এলপি গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হলো ৪৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত জুলাইয়ে মূল্য ছিল ৮৯১ টাকা।
ডিজেল, কেরোসিন ও এলপি গ্যাসের মূল্য বাড়ায় জনজীবনে মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ার পাশাপাশি, পরিবহন, সেচসহ সামগ্রিক ব্যয় বেড়ে যাবে। এতে জনজীবনে দুর্ভোগ বাড়বে ও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এমনি পরিস্থিতিতে সুবিধাবঞ্চিত এবং নি¤œবিত্ত ও মধ্যবিত্তের কষ্ট লাগবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার ভর্তুকি কমাতে স্থানীয় বাজারে দাম বাড়িয়েছে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরো বেড়ে যাবে। দুর্ভোগে পড়বে সাধারণ মানুষ। তিনি বলেন, ভর্তুকি কমাতে জ্বালানির দাম বাড়ানোর প্রভাব অর্থনীতির সব খাতে পড়বে। এমনি পরিস্থিতিতে তিনি সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ দেন।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, একসাথে এত দাম বাড়ানো মোটেও যৌক্তিক হয়নি। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়লে তার প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে তিন মাস সময় লেগে যায়। প্রতিদিনের তেল তো আর বিপিসি প্রতিদিন কিনে আনে না। একইভাবে এলপিজি ব্যবসায়ীদের সুবিধা দিয়েও দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে যখন দাম কমে তখন তারা কিন্তু সহজে দাম কমান না। লোকসান পোষানোর কথা বলতে থাকেন। এটা ঠিক নয়। তিনি বলেন, করোনার কারণে এমনিতেই দেশের ৭৭ ভাগ মানুষের আয় কমে গেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেই কষ্ট হচ্ছে। আর এখন তো তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন ব্যয়, পণ্যের ব্যয় সব বাড়বে এবং সব শ্রেণীর পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। বেড়ে যাবে জনদুর্ভোগ।
ভারতে পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমল : প্রতিবেশী দেশ ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পেট্রোল ও ডিজেলের ওপর থেকে আবগারি শুল্ক লিটারপ্রতি ৫ ও ১০ টাকা কমিয়েছে। এ দাম গতকাল থেকে কার্যকর করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও ভারতে এ জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কারণে দেশটির নাগরিকরা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পেল বলে জনিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
দাম কমানোর আগে ভারতের চারটি মেট্রোপলিটনসহ সব বড় বড় শহরে পেট্রোর প্রতি লিটার ১০০ রুপির বেশি বিক্রি হয়েছে। একই অবস্থা ছিল ডিজেলেরও, কেবল দিল্লিতেই এর দাম ছিল খানিকটা কম, ৯৮ দশমিক ৪২ রুপি। পশ্চিমবঙ্গে গতকাল থেকে পেট্রোল বিক্রি হচ্ছে প্রতি লিটার ১০৪ দশমিক ৬৭ রুপিতে, আগের দিনও এ দাম ছিল ১১০ রুপির উপরে। ডিজেল বিক্রি হচ্ছে ৮৯ দশমিক ৭৭ রুপিতে, যা আগের দিন ছিল ১০২ রুপির কাছাকাছি।
দেশে বাড়ল ২৩ শতাংশ : ভারতে তেলের দাম কমানো হলেও আমাদের দেশে পণ্য উৎপাদনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ডিজেল ও কেরোসিনের দাম এক লাফে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ দাম গত বুধবার মধ্যরাত থেকে কার্যকর করা হয়েছে। দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য ক্রমবর্ধমান। বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বগতির কারণে পাশের দেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশ জ্বালানি তেলের দাম নিয়মিত সমন্বয় করছে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিভিন্ন গ্রেডের পেট্রোলিয়াম পণ্য বর্তমান মূল্যে সরবরাহ করায় ৭২৬.৭১ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এ লোকসান সমন্বয় করতেই লিটারে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা থেকে ৮০ টাকা পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিলে গেজেট প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে জ্বালানি তেলের দাম কমানো হয়েছিল। সেই সময় ডিজেলের দাম ৬৫ টাকা, কেরোসিনের দাম ৬৫ টাকা, অকটেনের দাম ৮৯ টাকা ও পেট্রোলের দাম ৮৬ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
এলপি গ্যাসের মূল্য ৪৭.৩৬ শতাংশ বৃদ্ধি : ২০০৯ সাল থেকে আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এর পর যেসব নতুন বাড়িঘর হয়েছে এতে এলপি গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে এলপি গ্যাসের চাহিদা দেশে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। বর্তমানে ৪১ লাখ পরিবার এলপি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। আর শিল্প ও আবাসিক মিলিয়ে বছরে ১২ লাখ টনের বেশি এলপি গ্যাস ব্যাবহৃত হচ্ছে। আবাসিকে নিত্যপ্রয়োজনীয় এলপি গ্যাসের মূল্য গত চার মাস যাবত একটানা বাড়ানো হচ্ছে। চার মাসের ব্যবধানে বাড়ানো হয়েছে ৪৭ দশমিক ৩৬ ভাগ। গত জুলাইতে প্রতি ১২ কেজি এলপি গ্যাসের মূল্য ছিল ৮৯১ টাকা, চার মাসের ব্যবধানে একই পরিমাণ এলপি গ্যাসের মূল্য বেড়ে এখন ১ হাজার ৩১৩ টাকা হয়েছে। গত ১৯ জুলাই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি ১২ কেজি এলপি গ্যাসের মূল্য ৮১৯ টাকা থেকে ১০২ টাকা বাড়িয়ে ৯৯৩ টাকা নির্ধারণ করে। এ মূল্য ১ আগস্ট থেকে কার্যকর করা হয়। সেপ্টেম্বরে ৯৯৩ টাকা থেকে প্রতি ১২ কেজিতে ৪০ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৩৩ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ১০ অক্টোবরে প্রতি ১২ কেজিতে ২২৬ টাকা বৃদ্ধি করে ১ হাজার ৩৩ টাকা থেকে ১ হাজার ২৫৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়। গতকাল ৪ নভেম্বর আবারো ১২ কেজিতে ৫৪ টাকা বৃদ্ধি করে ১ হাজার ২৫৯ টাকা থেকে ১ হাজার ৩১৩ টাকা নির্ধারণ ও কার্যকর করা হয়েছে।
গতকাল বিইআরসির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বেসরকারি এলপিজির রিটেইলার পয়েন্টে ভোক্তাপর্যায়ে মূসক ব্যতীত প্রতি কেজি ১০২ টাকা ৫৪ পয়সা এবং মূসকসহ মূল্য হবে প্রতি কেজি ১০৯ টাকা ৪২ পয়সা। সে অনুযায়ী রিটেইলার পয়েন্টে ভোক্তাপর্যায়ে ১২ কেজি বোতলজাতকৃত এলপিজির মূসকসহ মূল্য ১ হাজার ৩১৩ টাকা। এতে বলা হয় পরবর্তী আদেশ না দেয়া পর্যন্ত এ দামই বহাল থাকবে। ১২ কেজির পাশাপাশি সাড়ে ৫ কেজি, সাড়ে ১২ কেজি, ১৫ কেজি, ১৬ কেজি, ১৮ কেজি, ২০ কেজি, ২২ কেজি, ২৫ কেজি, ৩০ কেজি, ৩৩ কেজি, ৩৫ কেজি ও ৪৫ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের নতুন দামও নির্ধারিত হয়েছে। এখন থেকে সাড়ে ৫ কেজি ৬০২ টাকা, সাড়ে ১২ কেজি ১ হাজার ৩৬৮ টাকা, ১৫ কেজি ১ হাজার ৬৪১ টাকা, ১৬ কেজি ১ হাজার ৭৫১ টাকা, ১৮ কেজি ১ হাজার ৯৭০ টাকা, ২০ কেজি ২ হাজার ১৮৮ টাকা, ২২ কেজি ২ হাজার ৪০৭ টাকা, ২৫ কেজি ২ হাজার ৭৩৫ টাকা, ৩০ কেজি ৩ হাজার ২৮৩ টাকা, ৩৩ কেজি ৩ হাজার ৬১১ টাকা, ৩৫ কেজি ৩ হাজার ৮২৯ টাকা ও ৪৫ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৪ হাজার ৯২৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিইআরসি জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সৌদি আরমকো কোম্পানির প্রোপেন ও বিউটেনের দামের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতি মাসে এলপিজির নতুন দর ঘোষণা করে বিইআরসি। এ বিষয়ে গঠিত কমিটি এলপিজির নতুন দাম নির্ধারণ সংক্রান্ত সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেয় ২ নভেম্বর। ৩ নভেম্বর বিইআরসি চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে ভার্চুয়াল শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতেই এলপিজির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement