১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পেটের দায়ে ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ি মোছে ওরা

-

বেলা সোয়া ১টা। ব্যস্ততম তেজগাঁও সাতরাস্তা সড়ক। বিজয় সরণি লিংক রোডের তেজগাঁও প্রান্ত। ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধরনের প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল। এতসব গাড়ির কাছ ঘেঁষে প্রতিযোগিতার সাথে ছোটাছুটি করছে কয়েকজন শিশু। তাদের প্রত্যেকের হাতে বিভিন্ন রঙের ছোট্ট তোয়ালে বা কাপড়ের টুকরা। তপ্ত রোদ উপেক্ষা করে ট্রাফিক সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেলগুলোর দিকেই ছুটছে তারা। একে-অন্যের আগে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহনগুলো মুছতে চেষ্টা করছে। তবে বেশির ভাগ যানবাহনের চালক বা মালিক তাদের গাড়ি মুছতে নিষেধ করছেন। এতে সময়ক্ষেপণ না করেই অন্য কোনো গাড়ির দিকে ছুটছে তারা। কারণ কখন আবার সিগন্যাল ছেড়ে দেয়। সেখান থেকেও ফিরিয়ে দেয়া হলে আবার অন্য গাড়ির কাছে দৌড়ে যাচ্ছে। তবে সবাই ফিরিয়ে দিচ্ছেন না। কেউ কেউ তাদের যানবাহন মুছার সুযোগ দিচ্ছেন এই শিশুদের। শিশুগুলো একটু মুছেই হাত পাতছে বকশিসের জন্য। কেউ ৫ টাকা দিচ্ছেন বা কেউ ১০ টাকা। আবার কেউ তাদের গাড়ি না মুছিয়েও শিশুদের টাকা দিচ্ছেন। তবে দুই-একজন তাদের গাড়ি মুছিয়েও টাকা টাকা না দিয়ে চলে যাচ্ছেন।
এই ছোট্ট শিশুদের মধ্যে একজন শাহীন। বয়স কত তা সঠিক জানে না। তবে সাত বা আট বছর হবে বলে ধারণা তার। পরিবারের সাথে বসবাস করে বেগুনবাড়ি বস্তিতে। একটি এনজিও চালিত স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্র শাহীন। তার বাবা আবুল কাশেম ঠেলাগাড়ি চালান। মা সেলিনা বাসা বাড়িতে বুয়ার কাজ করতেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে শাহীন দ্বিতীয় তার বড় ও ছোট দু’টি বোন রয়েছে।
ছোট্ট শাহীন জানায়, ঘরে খাবার কম। তাই মা বস্তির অন্য ছেলেদের সাথে তাকে এখানে পাঠিয়েছেন। আসার সময় ১০ টাকা দিয়ে কেনা নীল রঙের একটি রুমাল আকৃতির তোয়ালে ধুয়ে তার হাতে দিয়েছেন। বলেছেন, ওই তোয়ালে দিয়ে সাহেবদের গাড়ি পরিষ্কার করে দিতে। সাহেবরা খুশি হয়ে যে টাকা দেবেন সেটি নিতে। কোনো সাহেব কাজ করতে নিষেধ করলে সেখান থেকে ফিরে অন্য সাহেবের গাড়ির কাছে যেতে বলেছেন। কেউ টাকা না দিলেও কিছু বলতে নিষেধ করেছেন। ঘরে খাবার কম কেন জানতে চাইলে শাহীন বলে, তার বাবা ঠেলাগাড়ির হেলপার হিসেবে কাজ করেন। অর্থাৎ ঠেলাগাড়ি যে দুই-তিনজন পেছন থেকে ধাক্কা দেন তাদের একজন। মা বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। কিন্তু বর্তমানে করোনাভাইরাসের কারণে বাবার কাজ অনেক কমে গেছে। যার কারণে প্রতিদিন আর টাকা পায় না। ভাইরাসের ভয়ে মায়ের কাজগুলোও বন্ধ রয়েছে। বাসাবাড়িতে এখনো মানুষ বুয়া নিতে ভয় পাচ্ছে। এতে মা রোজগার করতে পারছেন না। তাই মা বলছেন, ঘরে খাবার কমে গেছে। আমাদের সবাইকে কাজ করতে হবে।
শাহীনের সাথে আরো একজন মাসুম। তার বয়স ১০ বছর। পড়ে এনজিও চালিত একটি স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীতে। মাসুম জানায়, স্কুল বন্ধ, কাম-কাজ নাই। তাই সাহেবদের গাড়ি মুছি। তবে সবাই মুছতে দেয় না। গাড়ির কাছে যাওয়ার আগেই বলে ‘সর, সর’। কেউ কেউ মুছতে দেন, আবার টাকাও দেন। আবার দুই-একজন আছে মুছতে দিয়েও টাকা দেন না। আবার অনেক সাহেব তাদের গাড়ি মুছতে দেন না; কিন্তু এমনিতেই টাকা দেন। তারা জানায়, ছুটির দিন না হলে তাদের প্রতিদিন ১০০-৩০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয়। তবে রোদের মধ্যে এই কাজ করতে অনেক কষ্ট হয় বলে জানায় দ্বীপ্ত। সে জানায়, সিগন্যাল ছেড়ে দিলে গাড়িতো চলে যায়। কিন্তু আমরা তো যাই না।’ আমাদের তো রোদেই থেকে যেতে হয়। কারণ এক সিগন্যালের গাড়ি চলে যায়। অন্য সিগন্যালে এসে অন্য গাড়ি থামে। সেগুলোও মুছতে হয়। শুধু লিংক রোড নয়, এমন চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর শাহবাগ, পান্থপথসহ বেশ কয়েকটি এলাকায়।
বিজয় সরণিতে দায়িত্বরত একজন ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, সিগন্যালে থাকা গাড়ি মুছে দেয়ার প্রবণতা আগেও ছিল। কিন্তু করোনা চলাকালে এই কাজে শিশুদের বেশি দেখা যাচ্ছে। হয়তো সংসারে অভাব বেড়েছে, আবার স্কুলও বন্ধ। তাই পরিবারকে সাহায্য করতে শিশুরাও এগিয়ে এসেছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তারা কোনো ক্ষতি করে না। আবার কেউ তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও দেননি। যার কারণে আমরা কিছু বলি না। তবে অপরাধমূলক কিছু করে বসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।


আরো সংবাদ



premium cement