২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনায় দেশের সাড়ে ৫ কোটি লোক এখন চরম দরিদ্র

পারিবারিক উপার্জন কমেছে ৭৪%, ১৪ লাখের বেশি প্রবাসী শ্রমিক বেকার : যৌথ সমীক্ষার তথ্য
-

কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন একটি সঙ্কটময় মুহূর্তে উপনীত হয়েছে। মহামারীটি নিম্ন আয়ের মানুষকে অস্বাভাবিকভাবে প্রভাবিত করেছে। দেশের প্রায় ১০ কোটি ২২ লাখ মানুষ অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত দুর্বলতার ঝুঁকিতে রয়েছেন। প্রায় ৭৪ শতাংশ পরিবারের উপার্জন কমে গেছে। ১৪ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন বা ফিরে আসছেন। দেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ এখন চরম দরিদ্র, যাদের দৈনিক আয় মাত্র এক দশমিক ৯ ডলার।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক, ডেটা সেন্স এবং উন্নয়ন সমন্বয়-এর এক যৌথ সমীক্ষায় এই তথ্য উঠে এসেছে। ‘কোভিড-১৯ এবং জাতীয় বাজেট ২০২০-২১ : নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কৌশল পুনর্বিবেচনা’ শীর্ষক এই সমীক্ষার ফলাফল গতকাল এক ডিজিটাল সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ করা হয়।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান উপস্থিত ছিলেন। ব্র্যাকের ঊর্ধ্বতন পরিচালক কে এ এম মোর্শেদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন আইসোশ্যাল-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. অনন্য রায়হান। প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেনÑ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন।
সমীক্ষায় ব্র্যাক, বিআইজিডি, পিপিআরসি, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা পরিচালিত গবেষণা পর্যালোচনার পাশাপাশি একটি জরিপও পরিচালনা করা হয়েছে এবং প্রাপ্ত ফলাফল সমন্বয় করে মূল প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। জরিপটি দেশের ২৫ জেলায় দৈবচয়নে নির্বাচিত ৯৬২ জন উত্তরদাতার অংশগ্রহণে মে মাসের ১৫-১৮ তারিখের মধ্যে সম্পাদন করা হয়।
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, দেশে অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ চরম দরিদ্র (দৈনিক আয় ১.৯ ডলার)। এদের মধ্যে নতুন করে চরম দরিদ্র হয়ে পড়া পরিবারগুলোও রয়েছে। উচ্চ অর্থনৈতিক ঝুঁকিতে থাকা চরম দরিদ্রের সংখ্যা চার কোটি ৭৩ লাখ এবং উচ্চ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন তিন কোটি ৬৩ লাখ মানুষ।
জরিপে দেখা গেছে, কোভিড-১৯-এর কারণে নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। যেসব পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে, এর মধ্যে ৩৪.৮ শতাংশ পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য চাকরি হারিয়েছেন। মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে গড় পারিবারিক উপার্জন প্রায় ৭৪ শতাংশ কমে গেছে। দিনমজুরসহ অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। উৎপাদন খাতেও বড় ধাক্কা লেগেছে। উদাহরণ হিসেবে, তৈরী পাশাক খাতে রফতানি এপ্রিল ২০১৯-এর তুলনায় ২০২০ সালের এপ্রিলে ৮৪ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। এ বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকে ৭ এপ্রিলের মধ্যে ১,১১৬টি কারখানা বন্ধ ঘোষিত হয়েছে এবং চাকরি হারিয়েছেন প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক।
সমীক্ষায় আরো বলা হয়, নিম্ন আয়ের মানুষের এই রোগের সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এসব পরিবারের উপার্জনশীল সদস্যের মৃত্যু হলে নারী ও শিশুদের মধ্যে অনাহার এবং অপুষ্টির শিকার হওয়ার উচ্চ আশঙ্কা সৃষ্টি হবে। এ ছাড়া দেশব্যাপী সমন্বয়ের অভাবের কারণে দরিদ্র ও অতিদরিদ্রদের কাছে সরকারের দেয়া খাদ্য এবং নগদ সহায়তা সঠিকভাবে পৌঁচ্ছে না বলে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও গবেষণা-সমীক্ষা থেকে প্রতীয়মান হয়।
কোভিড-১৯ নতুন অর্থনৈতিক বিভাজন, সামাজিক বিভাজন এবং ডিজিটাল বিভাজনও সৃষ্ট করেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কেবল ৩৪ শতাংশ পরিবারের স্মার্টফোন রয়েছে এবং ৫৪ শতাংশ পরিবারের টিভি দেখার সুযোগ রয়েছে। অতএব, এর নিচের অংশে বসবাসকারী শিশুরা ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালিত শিক্ষাকার্যক্রম থেকে বাদ পড়তে যাচ্ছে।
১৪ লাখেরও বেশি প্রবাসী শ্রমিক চাকরি হারানোর কারণে ফিরে এসেছেন বা দেশে ফিরে আসছেন। বিদেশে থাকা অভিবাসীরাও এখন ঋণচক্র ও সামাজিক কলঙ্কের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে পড়েছেন। মহামারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারগুলোকে আরো বেশি অসুবিধার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
ড. আতিউর রহমান বলেন, মানুষকে আগে বাঁচাতে হবে, তারপর স্বপ্নপূরণ আর সুখে থাকার চিন্তা। তাই এবারের বাজেট হোক বেঁচে থাকার বা টিকে থাকার বাজেট। কোভিড-১৯ মহামারীতে সবচেয়ে হুমকির মুখে স্বাস্থ্যব্যবস্থা। মধ্যবিত্তরাই চিকিৎসাসেবা পাবেন কি না সেই আতঙ্কে আছেন, দরিদ্রদের অবস্থা তো আরো করুণ। স্বাস্থ্য খাত ঠিক না করলে বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না, আমাদের অর্থনীতিও আগাবে না।
ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষ হিসেবে বটম অফ দি পিরামিডে শুধু শ্রমিকেরা নয়, অনেক ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাও আছেন। প্রণোদনা দেয়ার পরেও শ্রমিকদের ৬০ শতাংশ বেতন দেয়া হয়েছে। তাদের বাসাভাড়া ও অন্যান্য খরচ তো কমেনি। তাই এই মুহূর্তে বেঁচে থাকার জন্য যাদের প্রয়োজন বেশি তাদের প্রণোদনা বা ভর্তুকির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ড. ইমরান মতিন বলেন, জনগণের আতঙ্ক দূর করতে স্বাস্থ্য খাতে অবকাঠামো ও মানবসম্পদ বাড়াতে হবে। উপজেলা ও গ্রামীণ পর্যায়েও সার্বক্ষণিক ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী, প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম রাখতে হবে।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, এখন নতুন তালিকা তৈরির সময়ক্ষেপণের দিকে না গিয়ে আগের তালিকা ধরেই কাজ করা ভালো। ৭৮ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীকে যে ১০০ টাকা করে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে, তা এখনই ৫০০ টাকায় উন্নীত করা দরকার। এতে করে সঠিক জায়গায় সহায়তা পৌঁছানো অনেকটা নিশ্চিত হবে। শুধু বরাদ্দ করলেই হয় না, সবার কথা, সুবিধা-অসুবিধা শুনে দক্ষতাপূর্ণ, কার্যকর ও কৌশলী বাজেট করতে হবে। সবাইকে একসাথে হাঁটতে হবে।
এই গবেষণার আলোকে জাতীয় বাজেট ২০২০-২১-এ অন্তর্ভুক্তির জন্য কিছু প্রস্তাব পেশ করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ নিম্ন আয়ের যেসব পরিবারের উপার্জনকারী কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়ে উপার্জনহীন হয়েছেন বা মারা গেছেন সেসব পরিবারে অন্তত তিন বছরের জন্য নগদ সহায়তা দেয়া। আগামী অর্থবছর থেকে চরম দরিদ্র ও দরিদ্রদের জন্য এবং ২০২১-২০২২ অর্থবছর থেকে অন্যান্য বেকার গোষ্ঠীর জন্য সর্বজনীন বেকারত্ব সুবিধা স্কিম চালু করা।

 


আরো সংবাদ



premium cement