১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. জাহিদ হোসেন

ক্ষুধার যাতনায় দরিদ্ররা মাঠে নামলে বিপদ হবে

মাসে মাথাপিছু ২ হাজার টাকা করে ৪ মাস সহায়তা দেয়া প্রয়োজন
-

আগামী অর্থবছরের বাজেট গতানুগতিক হলে হবে না। সঙ্কট মোকাবেলার জন্য বাজেটে বড় ধরনের বরাদ্দ রাখতে হবে। কারণ আগামী চার মাস সহায়তা দিলেই যে গরিবদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তা নয়। সঙ্কট যত দিন থাকবে গরিবদের পাশে তত দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। মাসে মাথাপিছু ২ হাজার টাকা করে ৪ মাস সহায়তা দেয়া হলে ১১ কোটির জন্য জিডিপির লাগবে ৩.৩ শতাংশ বা ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা। লকডাউনের ফলে যারা দিন এনে দিন খায় তারা আয়শূন্য হয়ে গেছে। তাদেরকে খাবারের জোগান দিতে না পারলে ক্ষুধার যাতনায় রাস্তায় নেমে পড়লে বিপদ হবে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও বতর্মান পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেন নয়া দিগন্তকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে করোনা মোকাবেলার জন্য বাজেটে একটা বিশেষ তহবিল রাখার পরামর্শ দেন।
নিচে তার সাক্ষাৎকারটি বিস্তারিত তুলে ধরা হলো।
নয়া দিগন্ত : কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে গোটা বিশ্বে অচলাবস্থা চলছে। আমাদের অর্থনীতিতে এর অভিঘাত কতটা গুরুতর হবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : আমাদের অনুমান তো বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখেছেন। অভিঘাতের একটা হলো অর্থনৈতিক উৎপাদনের ওপর। আরেকটা হলো দরিদ্রতা ও বৈষম্যের ওপর। উৎপাদনের ওপর অভিঘাতের হিসাব-নিকাশটা বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টে দেয়া হয়েছে। দু’দিক দিয়ে এ অভিঘাত ব্যাপক হবে। এ ধরনের জাতীয় ও বৈশ্বিক সঙ্কটের এমন নজির ইতিহাসে এর আগে নেই। এর আগে বিশ্ব মহামন্দায় যে সঙ্কট হয়েছিল তার সাথে আমরা পরিচিত। সেটা ১৯২৯ সালে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। সংক্রমিত হতে চার বছর সময় লেগেছিল। তেলের দাম বাড়ার কারণে জোগানের দিক থেকে আঘাত হানায় ১৯৭৩ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত মন্দা ছিল। এরপর আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনার জন্য বিশ্বমন্দা শুরু হয়। এটা আমরা ২০০৮-০৯ সালে দেখেছি। এটা আমেরিকা থেকে শুরু হয়ে সারা বিশ্বে ছড়ায়।
এবারের বিষয়টা একবারে ব্যতিক্রমী। করোনাভাইরাস এমন একটা সঙ্কট যা চীন থেকে শুরু হলেও খুব দ্রুত, সারা বিশ্বে স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টির পাশাপাশি হঠাৎ করে অর্থনীতিকে স্থবির করে ফেলেছে। ফলে কিছু সরকার স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে লকডাউনের মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। যেখানে অর্থনীতির চাকাটাকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বন্ধ করে দেয়া ছাড়া আর উপায় ছিল না। সংক্রমণের ঝুঁকিকে রোধ করার জন্য এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
আমাদের চাহিদা হলো দুটোÑ একটি হলো বৈশ্বিক আর অপরটি অভ্যন্তরীণ। আমাদের বড় বড় বাজার ইউরোপ-আমেরিকা করোনাভাইরাসের সেন্টারে পরিণত হয়েছে। এখন সব দেশেই লকডাউন চলমান। এমনকি এটা কবে তুলে নেয়া হবে তার পূর্বাভাস এই বিষয়ে শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীও দিতে পারবেন না।
এই অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের বড় বাজারগুলোর মধ্যে ফ্রান্স এবং জার্মানি ইতোমধ্যে মন্দার মধ্যে চলে গেছে। গত দুই প্রান্তিকে তাদের অর্থনীতি সঙ্কুচিত হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে মন্দায় পড়ে গেছে তার বড় দলিল হলো বেকার ভাতার জন্য আবেদন এখন ১ কোটি ৭০ লাখে উঠেছে। এর ভিত্তিতে ধরে নেয়া হয়েছে যে আমেরিকায় বেকারত্বের হার ১৩ থেকে ১৫ শতাংশে উঠেছে, যা দুই মাস আগে ৫ শতাংশের নিচে ছিল। কাজেই আমাদের বড় বাজারগুলো একটা গভীর মন্দার মধ্যে পড়েছে। এখন প্রশ্ন হলোÑ এটা আরো গভীর কতটা হবে এবং কত দিন থাকবে। রফতানির অর্ডার অনেক বাতিল হয়েছে আমাদের। যদি দুই বিলিয়ন ডলারও বাতিল হয় তাহলে তো আমরা রফতানিতে প্রবৃদ্ধি পাবো না। রফতানিতে তো প্রবৃদ্ধি এমনিতেই ছিল না। করোনাভাইরাস আসার আগে অর্থাৎ মার্চের আগে আমাদের অর্র্থনীতির সবগুলো সূচকে একটা নেতিবাচক ধারা ছিল। শুধু রেমিট্যান্স বাদে। এখনতো রেমিট্যান্সও সেই প্রভাবে পড়বে। কারণ আমেরিকা, কানাডা, ফ্রান্স, ইতালি, যুক্তরাজ্য ও জার্মানিতে প্রচুর বাংলাদেশী থাকে। তারা ট্যাক্সি চালায়, সবজির দোকান আছে, কাপড়ের দোকান আছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেউ আবার রেস্তোরাঁ বা দোকানে কাজ করে। এসব তো এখন বন্ধ। তারা এখন ঘরবন্দী। তাদের পক্ষে রেমিট্যান্স পাঠানো এখন আর সম্ভব নয়।
তেলের দাম ৩০ ডলারের নিচে নেমে গেছে। ফলে তেলনির্ভর দেশগুলোতে করোনার পাশাপাশি তেল-রাজস্ব কমায় নির্মাণ খাত, পরিবহন খাত, হসপিটালিটি খাত, সিকিউরিটিজ খাত, যেখানে বাংলাদেশীরা কর্মরত বেশি, এসব জায়গাতে বেকারত্ব দেখা দিচ্ছে। কাজেই রেমিট্যান্স প্রথম আট মাসে ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি ছিল, মার্চ মাসে তা নেমে যেতে দেখেছি। আগামীতেও নামবে। এর ফলে আমাদের অভ্যন্তরীণ ভোক্তাচাহিদার ওপরও একটা বড় আঘাত আসবে। চাহিদার দিক থেকে রফতানি, ভোক্তা-ব্যয় একটা ধাক্কা। আরেকটা হলো, ভোক্তা-ব্যয় করার সুযোগই তো নাই। আপনি তো বাসায় স্বেচ্ছা-বন্দী। মানুষ যদিও ব্যাংক থেকে প্রচুর টাকা তুলছে। তারা সেটা ব্যয় করছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে। অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিনে তারা টাকা খরচ করার সাহস করছে না। কারণ আয় নিয়ে সবাই শঙ্কিত। যাদের আয় চলে গেছে তাদের এই শঙ্কাটা বড়, সে আয় ফিরবে কি না? যাদের আয় এখনো বজায় আছে তারাও শঙ্কিত যে এটা কয় দিন থাকবে। তাই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছাড়া নগদ টাকা তারা বাসায় রাখছে। কিন্তু খরচ করছে না।
নয়া দিগন্ত : সামনে অভ্যন্তরীণ চাহিদার যে সঙ্কটের কথা বলছেন তার প্রভাব কি পড়তে পারে?
ড. জাহিদ হোসেন : আমাদের ভোক্তা-ব্যয়ের যে দুটো মহোৎসব তার মধ্যে একটা হলো পহেলা বৈশাখ, দ্বিতীয়টা হলো রমজান আর ঈদ। পহেলা বৈশাখ তো বিলীন। সামনে ঈদ। এখন হয়তো ই-কমার্সের মাধ্যমে কিছু লেনদেন বা কেনাকাটা হচ্ছে। তার আওতা তো খুব বেশি না। তাই ভোক্তাব্যয়েও এক বড় ধস আসবে। কাজেই রফতানিতে ধস, ভোক্তাব্যয়ে ধস। ভোক্তাব্যয় মোট জিডিপির ৬৯ শতাংশ। তারপরে আছে বিনিয়োগ। ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ করার সুযোগ তো এখন আর নেই। কারণ এই মুহূর্তে বিনিয়োগের সব পরিকল্পনা তো স্থগিত। কাজেই বিনিয়োগ থেকেও যে একটা চাহিদা আসত এবং উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর একটা সুযোগ তৈরি হতো সেটাও আপাতত বন্ধ। চাহিদার দিক থেকে এটা অনেক বড় ধাক্কা।
জোগানের দিক থেকে রফতানি বাণিজ্য ও আমাদের অভ্যন্তরীণ কুটির শিল্প সবই অনেকটা আমদানিনির্ভর। বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে যে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে, তাতে জাহাজ হয়তো আসছে, কিন্তু সেটা বন্দরে একটা কনটেইনার জট সৃষ্টি করছে। আবার অনেক মাল আছে, এলসি খোলা হয়েছে, কিন্তু সরবরাহ দিতে পারছে না। কারণ তাদের দেশে লকডাউন। আমাদের বেশির ভাগ কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশ আমদানি হয় চীন ও ভারত থেকে। ভারতেও এখন লকডাউন চলছে। জার্মানি থেকে যে মূলধনী যন্ত্রপাতিগুলো আমরা আনি, ধনী দেশগুলো থেকেও তো আমরা উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানি করি। গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন এখন সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। আর আমাদের স্থানীয় সরবরাহ চেইন এক জেলা থেকে আরেক জেলায় মাল পরিবহন করা যাচ্ছে না। সিমেন্ট উৎপাদনকারী, সুতা যারা বানায় তাদের কী অবস্থা, রড উৎপাদনকারীদের কী অবস্থা, তার চিত্র আমরা দেখতে পারছি। তাই আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইন এবং স্থানীয় সরবরাহ চেইন দুটোই ব্যাপকভাবে বিঘিœত। এর ফলে রফতানি অর্ডার বাতিল হওয়ার পরও যা আছে, তা তো উৎপাদন করার পরিস্থিতি নাই। ফ্যাক্টরি খুলতে পারছেন না। আবার কারখানা চালু রাখলেও কাঁচামাল যা স্টকে ছিল তার ব্যবহার শেষ হয়ে গেলে আর নতুন করে কাঁচামাল না এলে উৎপাদন চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এর ফলে সরবরাহ দিক থেকেও একটা বড় ধাক্কা আসছে। এই দুটো মিলে বিশ্বব্যাংক বলছে, যদি লকডাউন চার মাস স্থায়ী হয় প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ হতে পারে। আর যদি দুই মাস স্থায়ী হয় তাহলে ৩ শতাংশ হবে। সরকারি প্রাক্কলন মোটেও বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। করোনাভাইরাসের আগে প্রথম আট মাসে প্রবৃদ্ধি তো একটা দুর্বল অবস্থানে ছিল। সেটাকে তো মাথায় রাখতে হবে। করোনাভাইরাস ছাড়া দুর্বলতার কারণে এই প্রবৃদ্ধি যদি ৬ শতাংশও ধরি, আমার ব্যক্তিগত মতামত তারও কম। আর বিশ্ব্যাংকের এই ২ ও ৩ শতাংশও আশাবাদী হিসাব।
নয়া দিগন্ত : কৃষি খাত নিয়ে অনেকে শঙ্কিত। আপনার কী ধারণা?
ড. জাহিদ হোসেন : কৃষি খাতের অবস্থা হলো, যারা দুধ বিক্রি করেন, বিশেষ করে লাইভস্টক, পোলট্রি, ডেইরি ফার্মের মালিকরা, না দুধ বিক্রি করতে পারছেন, না মাংস বিক্রি করতে পারছেন। কৃষকরা সবজি বিক্রি করতে পারছেন না। কারণ আন্তঃজেলা সরবরাহ চেইন চালু নেই। পরিবহন খুবই সীমিত আকারে চলছে। বোরোধান মাঠে আছে। বোরো কাটার সময় চলে এসেছে। বিশেষ করে হাওর অঞ্চলে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বোরো যদি না কাটে তাহলে একটা বড় ধরনের বন্যা ঝুঁকিতে পড়বে। ফসলগুলো ধ্বংস হতে পারে। আবার সময় মতো না কাটলে ফসলগুলো মাঠে পড়ে থাকলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এখানে এখন ইন্টার্নাল মাইগ্রেশন সম্ভব হচ্ছে নয়। অনেক শ্রমিক যেতে চাচ্ছেন না। আমি খবরের কাগজ পড়ে জেনেছি যে, কৃষকরা শ্রমিক নেতাদের বলেছেন যে, আমাদের এক শ’ শ্রমিক দিতে পারবা কিনা? তারা বলছেন, করোনার ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে রেখে আমরা কিভাবে নিয়ে যাবো। আবার অনেক শ্রমিক বলছেন আমার ওই উচ্চ মজুরির দরকার নেই। কারণ আমি তো শুধু নিজেই ওই ঝুঁকির মধ্যে পড়ব না, ফিরে এসে আমার পুরো পরিবারকে ওই ঝুঁকির মধ্যে ফেলব। তার চেয়ে আমি এখানে আধাপেট খেয়ে থাকব। কিন্তু আমার উচ্চ মজুরির জন্য ঝুঁকিতে যাওয়ার দরকার নাই। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ বলছেন, কৃষিতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তারা এটা কিভাবে বলেন? কৃষির মধ্যে ধান হচ্ছে আমাদের বড় শস্য। আর ধানের মধ্যে বোরো হলো আমাদের বড় ধান। এই ধান এখন বিরাট ঝুঁকিতে আছে। কিভাবে এটাকে কাটা হবে, কিভাবে গুদামজাত করা হবে, কিভাবে চালে পরিণত করা হবে? কিভাবে বাজারে পৌঁছে দেয়া হবে। এই ধান কাটার জন্য যদি সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিশেষ উদ্যোগ না নেয়া হয় এবং যন্ত্রপাতি দিয়েই কাটতে হবে। ওই যন্ত্রপাতি তো আপনাকে সরবরাহ করতে হবে। কাজেই কৃষি খাতেও বড় একটা প্রভাব পড়তে পারে।
নয়া দিগন্ত : করোনা-পরবর্তীতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী কী?
ড. জাহিদ হোসেন : এখানে একটা হলো সঙ্কটকালীন চ্যালেঞ্জ। করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত স্বাস্থ্য সঙ্কটকালীন। এখানে তিনটা চ্যালেঞ্জ। প্রথমত: টেস্টিংয়ের ব্যাপকতা বাড়ানো। কারণ এটা অনেক কম। এর ভিত্তিতেই আপনি লকডাউনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। টেস্টিং ছাড়া লকডাউন পেছানোর চিন্তাই করা যাবে না। দ্বিতীয়ত: ট্রেসিং বা ট্রেস আউট করতে হবে। করোনায় আক্রান্ত যাদের পেয়েছেন তাদের সাথে কাদের যোগাযোগ ছিল সেটা বের করা। তাদেরকে হোমকোয়ারেন্টিনে রাখা। তৃতীয়টা হলো, আইসোলেশন এবং আইসোলেশনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে এবং বাড়াতে হবে। আইসোলেশনের জন্য যথেষ্ট জায়গা লাগছে। এ জন্য বড় একটা জায়গা চিহ্নিত করতে হবে। যেখানে আমরা একটা বড় অংশকে আইসোলেশনে চিকিৎসার ব্যবস্থা এই মুহূর্তে করতে পারছি না। সেই সক্ষমতার ব্যবস্থা করা। এতে যত টাকার প্রয়োজন তা খরচ করতে হবে। দরকার হলে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বরাদ্দ কমিয়ে সেই অর্থ ওখানে দিতে হবে। এডিপির বেশির ভাগ প্রকল্পের অর্থছাড় স্থগিত করে হলেও ওই খাতে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। বর্তমানে অর্থ ব্যয় করে হলেও টেস্টিং, ট্রেসিং (চিহ্নিত করা), আইসোলেশন এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, করোনা চলাকালে সারা দেশে তো লকডাউন থাকবে। এটার কারণে একটা বড় জনগোষ্ঠী যারা দিন এনে দিন খায় এরা তো আয়শূন্য হয়ে গেছে। এদেরকে জোগান দিতে না পারলে ক্ষুধার যাতনায় রাস্তায় নেমে পড়বে। লকডাউনের কার্যকারিতা থাকবে না। সিদ্ধান্ত নিতে হবে ক্ষুধার যাতনায় মরব না কারোনায়। শুধু নিজের ক্ষুধার যাতনা না, পরিবারের বাচ্চারও ক্ষুধা।
ওই সব দরিদ্রকে সহায়তা দিতে হবে। আমি বলে আসছি ওএমএসে যাবেন না। ওখানে গেলে করোনার ঝুঁকিটা বাড়িয়ে দেবেন। ওএমএস দুর্নীতির ঝুঁকিটা বাড়িয়ে দেবে, চুরি হবে। এত দিন পরে সরকার বুঝতে পেরে স্থগিত করেছে। দু’মাস আগেই তো এটা বোঝা উচিত ছিল। এর জন্য বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। তাই এদেরকে নগদ সহায়তা দিতে হবে। স্থানীয় বাজারে পণ্য পর্যাপ্ত রাখতে হবে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পণ্য কেনার ক্ষমতা যদি থাকে তাহলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে দোকানে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করার কথা বিবেচনা করত। তারা ৬ ফিট দূরত্বই রাখছে না। স্থানীয় নেতাদের বাড়িতে বস্তা বস্তা চাল পাওয়া যাচ্ছে। এসব কিছুই হতো না, তাদের নগদ সহায়তা দিলে। হতদরিদ্রদের মাথাপিছু মাসে ২ হাজার টাকা করে চার সদস্যের পরিবারে ৮ হাজার টাকা করে চার মাস দিলে ৪ কোটি মানুষের জন্য ব্যয় হতো জিডিপির ১.২ শতাংশ। এখানে শুধু গরিবরাই আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ভঙ্গুর জনগোষ্ঠীও আক্রান্ত। তাই বলেছি ৭ কোটিকে সহায়তা দিতে হবে। আর ১১ কোটিকে দিলে ব্যয় হতো জিডিপির ৩.৩ শতাংশ, যা সরকারের পক্ষে দেয়া সম্ভব। এখানে একটা মোটা অঙ্ক লাগবে। তবে এটা এমন অঙ্ক না যা আমরা দিতে পারি না। আমরা ৭২ হাজার কোটি টাকার একটা কর্মসূচি তো দিয়েছি। যেখানে ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের দেয়া হচ্ছে জিডিপির আড়াই শতাংশ। যার মধ্যে ৫০ হাজার কোটি টাকা বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান, মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য দিয়েছি। এটা তো তার চেয়ে দ্বিগুণ। ১ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো লাগতে পারে। এডিপিতে কিছু সাশ্রয় করে, বাজেটের মধ্যে অন্যান্য খাতে সাশ্রয় করে দেয়া যাবে। ৯ হাজার কোটি টাকা তো আমরা রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট মালিকদের দেই, বিদ্যুৎ উৎপাদন না করার জন্য। ওই জায়গায় পেমেন্টগুলো স্থগিত করে দরকার হলে সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে দ্রুত এই ব্যবস্থা করা। কিন্তু দ্রুত এই সহায়তা দিতে হবে। যারা জীবিকার ঝুঁকিতে আছেন, ক্ষুধার ঝুঁকিতে আছেন তাদের সহায়তা দিতে হবে।
তৃতীয় হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে। উৎপাদনশীল প্রতিষ্ঠান যেগুলো আছে, বিশেষ করে ক্ষুদ্র মাঝারি প্রতিষ্ঠান যেসব টেক্সটাইল, নির্মাণ খাতসহ বিভিন্ন খাতে আছে। গ্রামে আছে, শহরে আছে, যারা বাড়িভাড়া দিতে পারছে না, বেতন দিতে পারছে না। বিদ্যুৎ বিল দিতে পারছে না। এদের কোনো রাজস্ব আয় নেই। নগদ আয় বন্ধ। মিডিয়াগুলোও তা টের পাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে টিকে থাকে তার জন্য ৭০ হাজার কোটি টাকার কর্মসূচি সঠিক। এটা সঠিক জায়গায় পৌঁছালে হবে সঠিক কর্মসূচি। এখানে যারা আসলে সঙ্কটে আছে বা তাদের প্রতিষ্ঠান সঙ্কটে, কিন্তু এদের রিজার্ভও তো অনেক থাকার কথা। কারণ গত বছরই তো ৩৪ বিলিয়ন ডলার তৈরী পোশাক রফতানি করেছেন। আর বলছেন, কর্মচারীদের বেতন দেয়ার মতো টাকা নাই। এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা? কাজেই যেসব প্রতিষ্ঠান প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকখেলাপির ঝুঁকিতে আছে, তাদেরকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
নয়া দিগন্ত : নতুন অর্থবছরের বাজেট আসছে। এ ক্ষেত্রে বাজেট তৈরিতে সরকারকে কী কী পদক্ষেপ ও দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : আগামী অর্থবছরের বাজেট তো গতানুগতিক হলে হবে না। এই সঙ্কট যদি চলতে থাকে, তাহলে এই সঙ্কট মোকাবেলার জন্য বাজেটে বড় ধরনের বরাদ্দ রাখতে হবে। কারণ আগামী চার মাস সহায়তা দিলেই যে গরিবদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে তা তো নয়। সঙ্কট যত দিন থাকবে গরিবদের পাশে আপনাকে তত দিন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। কাজেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে করোনা মোকাবেলা তহবিল একটা রাখতে হবে বাজেটে। আবার যদি এটা দ্রুত নিয়ন্ত্রণে চলে আসে তাহলে আমাদের রিকভারির কথাও ভাবতে হবে। যদি লকডাউন তুলে ফেলি, তখন তো সবাই কাজে ফিরে যাবে। কিন্তু এটা আশা করা সবচেয়ে বড় ভুল হবে, করোনার আগে আমরা যে দেশে বাস করতাম, করোনার পরে আমরা সেই একই দেশে ফিরে যাবো। এটা হবে না। করোনার ফলে বিশ্ব বদলে গেছে। কাজেই করোনাপরবর্তী অর্থনীতিকে রিকভার করার জন্য তখন প্রণোদনার প্রয়োজন হবে। এখন কিন্তু প্রণোদনা দিয়ে লাভ নেই। যেখানে অর্থনীতির চাকা বন্ধ সেখানে প্রণোদনা দিয়ে কী হবে। এই প্রণোদনার উদ্দেশ্য হলো চাকাটাকে আরো জোরে ঘোরানো। করোনার এই ঝুঁকিটা কেটে গেলে প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে। সেই চিন্তা এখন করা বিলাসিতার মতো মনে হয়। দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে উঠি, তারপর দিবালোকে স্বপ্নটা দেখার সুযোগ হবে, ইনশাআল্লাহ।
নয়া দিগন্ত : সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কতটা বাস্তবসম্মত? এটার সঠিক ব্যবহার হবে বলে আপনি মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে গণমাধ্যমে যেসব সংবাদ আমরা দেখতে পাচ্ছি তাতে কোনো মতে ভরসা পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যবস্থাপনা যদি ঠিক থাকত, তাহলে গরিবরা কি ট্রাক লুট করতে বাধ্য হতো? আমাদের দেশে গরিবরা কি এ ধরনের কাজ করে? এরা এ ধরনের কাজ করে না। করছে ক্ষুধার জ্বালায়। কারণ এ ছাড়া তার আর কোনো উপায় ছিল না। এটা তো একটা অব্যবস্থাপনারই সূচক বা ইঙ্গিত। আওয়ামী লীগের তিন-চারজনকে র্যাব গ্রেফতার করল। এটা কি সুব্যবস্থাপনার সূচক? আমরা চাই না ওরা গ্রেফতার হোক। আমরা চাই সহায়তা গরিবের কাছে পৌঁছাক। গ্রেফতার করে বাহাবা নিয়ে তো কোনো লাভ নেই। যে মরছে তাকে আমি সাহায্য করতে পারছি কি না? তবে গরিবদের জন্য আমরা সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি দেখিনি। বলা হয়েছে, এতো লাখ টন চাল আমরা ওএমএসের জন্য দিয়েছি। তাদেরকে আবাসন দেবো। কত জনকে দেবেন, কত টাকা দেবেন? কিভাবে দেবেন? এটা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি থাকলে তো সেটা সরকারের মধ্যেই আছে।
এখন প্রণোদনার বিষয় নয়। ব্যবসায়ীদের লড়াই হলো টিকে থাকার বিষয়। প্রবৃদ্ধির জন্য লড়াই না, তারা সহায়তা চাচ্ছে ব্যবসাকে কিভাবে টিকে রাখতে পারে। ব্যাংকের মাধ্যমে দেয়া হচ্ছে। তাদের তহবিল নেই, আমানত নেই, আমানত পাচ্ছেও না। সুদ হার ৯ শতাংশে সীমিত। ব্যাংকের তহবিল আসবে কোথা থেকে যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন না করে। শুধু রেপো বাজার থেকে টাকা নিয়ে এক বছরের জন্য কিভাবে ধার দেবেন? তাহলে তো ব্যাংকাররা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে তো অর্থনীতি একেবারেই ভেঙে পড়বে।
নয়া দিগন্ত : ঘাটতি মোকাবেলায় বা সামাল দিতে কি করণীয় বলে মনে করেন?
ড. জাহিদ হোসেন : সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ করোনার সংক্রমণকে রোধ করা। পলিসিমেকারদের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো কমিউনিটি টেস্টিংয়ের দিকে যেতে হবে। তিতুমীর কলেজের কাছাকাছি বুথ করা হয়েছে। এটাকে সারা দেশে আরো বিস্তার করতে হবে।
গরিবরা যদি আয়ের সন্ধানে রাস্তায় পড়ে থাকে তাহলে এই টেস্টিং ভেস্তে যাবে। সংক্রমণটা বাড়তেই থাকবে। আপনি একদিকে কমাবেন, অন্য দিকে বাড়তেই থাকবে। এটা এমন একটা জিনিস, সবার জন্য যদি ঝুঁকিটা কমাতে না পারেন তাহলে কারো জন্য ঝুঁকি শেষ হবে না। সবাইকে ঝুঁকিমুক্ত করতে হবে। দরিদ্র মানুষ যাতে ঘরে থাকতে পারে এবং সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে পারে। দরিদ্র মানুষকে জীবনযাত্রায় সাপোর্ট দিতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
ড. জাহিদ হোসেন : আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনারাও ভালো থাকবেন।


আরো সংবাদ



premium cement