১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আফগানিস্তান : মাটি ও মহিলা

-

আফগানিস্তান একটি হাজারো সমস্যাক্লিষ্ট, যুদ্ধবিদীর্ণ দরিদ্র দেশ। তবুও এর প্রতি সবার লোভ, আকর্ষণ কিংবা আগ্রহ কী কারণে? বলা যায়, আফগান রাষ্ট্রের আর্থিক ও বাহ্যিক অবস্থা দৃশ্যত ভালো না হলেও এর অবস্থান, গুরুত্ব, সম্ভাবনাসহ বিভিন্ন কারণেই বারবার প্রভাবশালী বিদেশীরা সেখানে গেছে কিংবা সে দেশ নিয়ে গভীরভাবে মাথা ঘামিয়েছে।

আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান বাড়িয়েছে এর ভ‚রাজনৈতিক গুরুত্ব। আফগান দেশটি ‘গরিব’ হলে কী হবে, সে দেশ কিন্তু গুরুত্বের দিক দিয়ে ‘ধনী’। কারণ আফগানিস্তান মধ্য এশিয়া (সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলো), দক্ষিণ এশিয়া (সার্ক অঞ্চল) ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়া (মধ্যপ্রাচ্য)- এ তিনটি গুরুত্ববহ অঞ্চলের সংযোগস্থল। ২. আফগানিস্তান বিশেষত রকমারি ভ‚গর্ভের প্রাকৃতিক বা খনিজসম্পদে অতীব সমৃদ্ধ। এসব অত্যন্ত মূল্যবান এবং আধুনিক দুনিয়ায় এসব কিছুর চাহিদা ও মূল্য ব্যাপক হলেও তা অনুসন্ধান, উত্তোলন ও সরবরাহের সামর্থ্য নেই এ দেশের। এটি আমেরিকা ভালো করেই জানে, তার প্রতিপক্ষ চীনও জানে। তাই ওয়াশিংটনের পর এখন বেইজিংয়ের শ্যেন দৃষ্টি এর ওপর। তবে শেষাবধি কী অবস্থা দাঁড়ায়, তা দেখার বিষয়। বলা যায়, আফগানিস্তানের পাথুরে ন্যাড়া পাহাড় পর্বত আসলে দামি ‘খনির আকর’। ৩. অদম্য আফগানিস্তান কোনো দিন বহির্শক্তির বিশেষত বিধর্মী-বিজাতীয়-বিদেশী কোনো মহলের বশ্যতা স্বীকার করেনি। গ্রিক ‘মহাবীর’ আলেকজান্ডার পর্যন্ত অনমনীয় আফগানদের সাথে আপস করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তবুও তাকে ফিরে যেতে হয় এবং ফিরে যাওয়ার পথে তিনি অল্প বয়সেই হঠাৎ মারা যান। ৪. রাশিয়া (সাবেক সোভিয়েত মহারাষ্ট্র) ও আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) পরস্পরের বিপরীত বৃহৎ শক্তি হলেও দুইয়ের মিল হলো, উভয়ের অভিজ্ঞতা আছে আফগানিস্তানে বিষম নাকানি-চুবানি খাওয়ার। এ দিক দিয়ে রাশিয়া এক দশক আর আমেরিকার দুই দশকের তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। আফগান দেশটি ‘বিদেশীদের গোরস্তান’তুল্য হলেও নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি আকর্ষণ মানুষের অধিক বিধায় বারবার বাইরের দেশগুলো আফগান ভ‚মি ও মানুষকে পদানত করতে চেয়েছে এবং ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ‘পিপীলিকার পাখা ওঠে মরিবার তরে’।

আফগানিস্তানের একটি বড় সমস্যা দেখা যাচ্ছে, ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সরকার গঠনের প্রসঙ্গটি। তালেবানবিরোধী বিশেষত পাশ্চাত্যপন্থী মহলের আশা ছিল ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ মানে হবে- দেশের নানান জাতিগোষ্ঠী, নারী, সংখ্যালঘু প্রমুখের প্রতিনিধিত্ব। তবে তালেবান ‘অংশগ্রহণমূলক’ কথাটি একেবারে খুলে না বলে কিছুটা হলেও রাখঢাক করেছে। এ দিকে তাদের নতুন সরকারে কোনো মহিলা এখনো নেই এবং সম্ভবত কোনো অমুসলিম দূরের কথা; সম্ভবত একজনও নেই অ-পশতুন ব্যক্তি। আফগানিস্তানের দ্বিতীয় প্রধান নৃতাত্তি¡ক জাতিগোষ্ঠী হচ্ছে তাজিকরা (জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ) যারা উত্তরের পাঞ্জশিরে এবারো তালেবানবিরোধী বিদ্রোহের নেতা ও অগ্রণী। তারা তালেবানকে ‘পশতুন সংগঠন’ মনে করে। অবশ্য অভিযোগটি অনেকটা সত্য দীর্ঘ দিন। এখন তালেবানের রূপান্তর হওয়ার ব্যাপারে অনেকেই আশাবাদী। বাস্তবে সেটি পূরণ হওয়াই বড় কথা।

তালেবানের জবাব হলো, ‘এ সরকার অস্থায়ী ও অন্তর্বর্তীকালীন। তাই সবার জায়গা হয়নি এতে।’ কিন্তু তারা যে ২০ বছর পর রাষ্ট্রের ক্ষমতায় এসেই ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ সরকার গঠনের আশ্বাস দিয়েছেন এবং সমাজে নারীর যথাযথ মর্যাদা ও অধিকার দেয়ার অঙ্গীকার করেছেন; তা ভুলে গেলে চলে না। প্রমাণ করতে হবে, তালেবানরা ইসলামের শিক্ষা মোতাবেক ওয়াদা রক্ষা করে এবং নিজেদের কথাকে মূল্য দেয়। এখন মিডিয়ায় দিনের পর দিন প্রচার করা হচ্ছে, আফগানিস্তানের বড় বড় নগরে তালেবানের বাধা উপেক্ষা করেই নারীদের চলছে বিক্ষোভ। তাদের দাবি, মন্ত্রিসভাসহ সরকারে তাদের গুরুত্ব দেয়া। তালেবান কর্তৃপক্ষ নারীদের ‘নিরাপত্তা’র কথা তুলেছে। কেন ও কিসের নিরাপত্তা? এ নিরাপত্তা কিভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল এবং এর প্রতিকার কিসে? কার বা কাদের সে গুরুদায়িত্ব? এসব সওয়ালের জবাব প্রথমত সরকারকেই দিতে হবে। মোটকথা, সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পুরোপুরি পালন করে যেতে হবে; সে সরকার, তালেবান কিংবা অন্য যে কেউ হোক না কেন।

বিভিন্ন মিডিয়ায় আফগান তোলো (উত্থান) নিউজের জনৈকা মহিলা রিপোর্টারের দেশত্যাগের কাহিনী প্রচার করা হয়েছে। তিনি তালেবান নিগ্রহের মহাতঙ্কে ভুগছেন আফগান রাষ্ট্রের অনেকের মতো। এ ক্ষেত্রে অতীতের অভিজ্ঞতা ভালো নয়; বর্তমান এখনো অনিশ্চিত। এ মহিলা সাংবাদিক সাহস করে তালেবান শীর্ষ নেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এবার। তালেবানরা এ নারীকে ঘৃণা করেনি কিংবা তাড়িয়েও দেয়নি; যেমনটি খ্রিষ্ট জগতে মনে করা হতো- নারী ‘দোজখের দরজা’। ‘তালেবানি মোল্লা’র ইন্টারভিউ নিয়ে তিনি নিজেই সে কথা প্রচার করে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে দুনিয়াতে। তবে তিনি একজন নারী, এটিই তার ভয়ের কারণ। এখন প্রশ্ন, যেসব নারী আফগান টিভিতে সংবাদ পড়ছেন বা আফগানিস্তানে লেখাপড়া করছেন, তাদের পক্ষে তা করা এ আমলেও কিভাবে সম্ভব হলো? অন্য দিকে তালেবান নেতৃত্ব কি জানে তারা নারীবিদ্বেষের মারাত্মক অভিযোগে সমালোচিত? এ ক্ষেত্রে তাদের আচরণ কতটা পরিবর্তন বাস্তবোচিত এবং কতখানি তা এসেছে? ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ প্রশাসন গড়ার ওয়াদা সত্ত্বেও কোনো নারীকে নতুন মন্ত্রিপরিষদে না নেয়া এবং একই সাথে এ দাবিতে কাবুল-হেরাতে নারীদের বিক্ষোভের বিষয়ে তালেবান সরকার কী বলে? নারীদের এই মিছিলের পেছনে কার হাত সক্রিয়, তা না খুঁজে এবং গতানুগতিকভাবে নতুন যেকোনো সরকারের মতো ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ এস্তেমাল না করে বরং জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক যে নারী, তাদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা ও অধিকার-মর্যাদা দেয়াই তালেবান সরকারের উচিত; অন্যথায় এর কারণ-পটভ‚মি-প্রেক্ষাপট তুলে ধরা দরকার। নারী, শিশু, সংখ্যালঘুসমেত মানবাধিকারের অবমাননা তালেবানের একটি ‘মেজর ব্ল্যাক স্পট’। এই গুরুতর অভিযোগের শিগগিরই অপনোদন করতে হবে। অন্যথায় মনে করা হবে যে, তালেবান বদলায়নি এবং তাদের কথা ‘মিষ্টি’ হলেও কাজগুলো ‘তেতো’।

একজন রাজনীতিক বলেছেন, ‘কোনো দল, মহল বা শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে হলে তাকে নির্বাচনে বিজয়ী হতে হয় নতুবা এহেন বিরাট সংগঠনের প্রতি দেশের জনগণের থাকা চাই অন্তত মৌন সমর্থন ও সম্মতি।’ তালেবান যেভাবে এবার দিনে দু’টি করে আফগান প্রদেশ দখল করে দ্রæত দেশের রাজধানীতে পৌঁছে গেছে, এতে তেমন কোনো বাধা আসেনি এবং আগের পাশ্চাত্যপন্থী সরকার আগেভাগে পালিয়ে গেছে, তাতে বলা যেতে পারে- জনগণ তাদের মেনে নিয়েছে। এখন সেটি ‘মন্দের ভালো’ না ‘ভালোর ভালো’, তা অন্য কথা। দুই দশক ধরে আগের সরকারগুলো ও যুদ্ধবাজদের অন্যায়, অযোগ্যতা ও দুর্নীতি দেখে দেখে সাধারণ আফগানরা অতিষ্ঠ হওয়ারই কথা। যারা আজ তালেবানের কঠোর সমালোচনাকে প্রধান কাজ বলে গণ্য করছেন, তারা পূর্ববর্তী সরকারের দুর্নীতি ও অযোগ্যতা নিয়ে যতটা দরকার; ততটা মুখ খুলেছেন ও পরামর্শ রেখেছেন কি না আত্মসমালোচনা অত্যন্ত আবশ্যক।

তালেবান মন্ত্রীরা নাকি ১১ সেপ্টেম্বর শনিবার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের বার্ষিকীতে শপথ নিচ্ছেন। সেটি তাদের ব্যাপার। তবে এ নিয়ে যাতে কোনো প্রকার ভুল বার্তা না যায়। ২০০১ সালের এ দিন ভয়াবহ সন্ত্রাসবাদী হামলা নিউ ইয়র্কের বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের ভবন গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। একসাথে হামলা হয়েছিল পেন্টাগনেও। আর মারা যায় প্রায় তিন হাজার মানুষ, যাদের অন্তত সাতজন বাংলাদেশের। আমেরিকার অভিযোগ, তালেবানের মতো মৌলবাদীরা এ জন্য দায়ী। তবে হামলার এ ঘটনা যেমন রহস্যপূর্ণ, তেমনি তালেবানের সাথে আলকায়েদা বা আইএসের সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা যায়নি। এবার তালেবান ক্ষমতায় ফিরে সে কথাই বলে দাবি করেছে, ‘বিন লাদেনের সাথে তালেবানের সম্পর্ক ছিল না’।

তবে যুক্তরাষ্ট্র ন’এগারো সূত্রেই সর্বাত্মক হামলা করে ২০০১ সালের অক্টোবরে কাবুল থেকে তালেবানদের তাড়ায়। এরপর আমেরিকা সে দেশে ব্যর্থ যুদ্ধ করে গেছে আর নতিস্বীকার না করে তালেবান দিন দিন প্রভাব ও শক্তি সঞ্চয় করেছে। আর আজ আমেরিকা নতমুখে স্বদেশে ফিরেছে এবং তালেবান আবার রাষ্ট্রের ক্ষমতায়।


আরো সংবাদ



premium cement