১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইসলামে শিশুর যত্ন

ইসলামে শিশুর যত্ন - মুফতি আলী হুসাইন -

মানুষ কেবল একটি দেহের নাম নয়, বরং তার মধ্যে রয়েছে একটি মন, একটি হৃদয়, একটি প্রাণ ও আল্লাহ প্রদত্ত বিবেক ও বুদ্ধি। এ সব কিছুর ওপর প্রতিফলিত হয় তার আবেগ-অনুভূতি, স্বপ্ন-ভালোবাসা, কল্পনা-আশা, আকিদা-বিশ্বাস, আচার-আচরণ ও গতিবিধি। যখন এ সব বিষয়ের নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক পরিচর্যা হয় তখন একজন মানুষ নীতি-নৈতিকতা ও উত্তম চরিত্রের উচ্চ শিখরে পৌঁছতে সক্ষম হয় এবং মানব সৃষ্টির মর্মমূল অনুধাবনে সচেষ্ট হয়। তাই একজন যোগ্য মানুষ তৈরির লক্ষ্যে মানব শিশুর চার প্রকার তরবিয়তের প্রয়োজন বরং অতীব জরুরি।

১. দেহের যত্ন ২. কলবের যত্ন ৩. রূহের যত্ন ৪.বিবেক ও বুদ্ধির যত্ন।
দেহের যত্ন : আমরা জানি মানুষের হুইল অব লাইফ তথা জীবন চাকা চারটি দেহ, ইবাদত, আত্মশুদ্ধি, আখিরাতের ফিকির। গাড়ির চাকাগুলোর কোনো একটি বিকল হয়ে গেলে বা পাংচার হয়ে গেলে সে গাড়ি চলা অসম্ভব, ঠিক তেমনি মানুষের জীবন চাকার এ চারটি মৌলিক উপাদান থেকে কোনো একটি অসম্পূর্ণ থাকলেও জীবন চলা অসম্ভব। তাকে পূর্ণাঙ্গ মানুষ বলাও মুশকিল।

তাই সর্ব প্রথম দেহ বা শরীর পরিচর্যার বিকল্প নেই। এর সঠিক পদ্ধতি হলো হালাল উপার্জনের মাধ্যমে নিরাপদ ও উপযোগী খাদ্য গ্রহণ, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান এর নিরাপদ ব্যবস্থা করা। শারীরিক সুস্থতা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও প্রাণবন্ততা ইত্যাদির প্রতি বিশেষ গুরুত্বারোপ করা।

শিশুর সার্বিকভাবে পরিচর্যার দায়িত্ব পিতা-মাতার। তারাই তার লালন পালনের প্রধান ভূমিকা পালন করবেন। বিশেষভাবে খাবার-দাবারের প্রতি লক্ষ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিশিষ্ট ফকিহ সিরাজি রহ: তার তরবিয়তি আলোচনায় ‘মায়ের বুকের দুধ-সন্তানের জন্য অধিক উপকারী’ প্রসঙ্গে বলেন, চতুষ্পদ জন্তুর দুগ্ধ দ্বারা শিশুর প্রতিপালন করলে তার স্বভাব প্রকৃতি খারাপ হয়ে যায়। (আল-মুহায্যাব ৩/১৮৯)

ইমাম গাজ্জালি এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, যে রমণী খোদাভীরু, হালাল খাবার গ্রহণ করে, শুধু এমন রমণীর মাধ্যমেই শিশুর লালন পালন ও তার দুগ্ধ পানের কাজ নিবে। কেননা হারাম খাবার থেকে উৎপন্ন দুধের মধ্যে কোনো বরকত নেই। যদি এ ধরনের দুধের দ্বারা কোনো শিশুর প্রতিপালন করা হয় তা হলে সে দুধের খারাপ প্রভাবে তার স্বভাব প্রকৃতিতে বক্রতা চলে আসে। ফলে তার রুচি-অভিরুচি মন্দ ও কুরুচিপূর্ণ বিষয়াসয়ের দিকে আকৃষ্ট হতে থাকে। তিনি আরো বলেন, শিশুকে দিনের কিছু সময় হাঁটাচলা, দৌড়াদৌড়ি ও শারীরিক ব্যায়ামে অভ্যস্ত করে তুলবে, যাতে করে তার মধ্যে অলসতা স্থান না পায়।
(ইহয়া উলুমিদ্দীন ৩/১৮৩)

কলবের যত্ন : শিশুর আকিদা-বিশ্বাস ও পরিপক্ব ঈমান তৈরির অনুশীলন। ইমাম গাজ্জালি রহ: বলেন, শিশুদের কুরআন-হাদিসের শিক্ষা এবং পূর্বসূরি পুণ্যবান লোকদের শিক্ষামূলক ঘটনা, তাদের জীবন চরিত সম্পর্কে আলাচনা করবে। এতে কোমল মতি শিশুদের অন্তরে তাদের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি হবে। (ইহয়া উলুমুদ্দিন ৩/১৭৩)

রূহের যত্ন : আত্মশুদ্ধি, উত্তম চরিত্র গঠন, সুপথে পরিচালনা, শরয়ী কর্মবিধির বাস্তব প্রয়োগ, ইবাদত-বন্দেগিতে আত্মমনোনিবেশ এ সব কিছুর মাধ্যমে একজন শিশুর পুঙ্খানুপুঙ্খ যত্ন হয়ে থাকে। ইমাম গাজ্জালি রহ: বলেন, শিশু পিতা-মাতার হাতে আমানতস্বরূপ, তার হৃদয়-আত্মা পূতপবিত্র মূল্যবান মণিমুক্তাসদৃশ। সব ধরনের চিত্র আকার-আকৃতি থেকে তার মানসপট একেবারেই শূন্য। তবে সব ধরনের চিত্র ধারণ করার যোগ্যতা তার মধ্যে বিদ্যমান। আকর্ষণীয় সব কিছুর দিকেই সে আকৃষ্ট হয়ে থাকে। অতএব যদি তাকে কল্যাণকর ও উত্তম বিষয়ে অভ্যস্ত করে তোলা হয় আর নিয়মতান্ত্রিক উত্তম শিক্ষা দেয়া হয় তাহলে উত্তম শিক্ষাই তার মধ্যে বদ্ধমূল হয়ে যায়। ফলে সে পার্থিব ও পারলৌকিক উভয় জগতে সে সফলতা অর্জন করে এবং তার পুণ্যময় সব কাজের প্রতিদানের সৌভাগ্যশীল অংশীদার হয় তার মাতা-পিতা, উস্তাদবৃন্দ, শিষ্টাচার প্রদানকারী সবাই। পক্ষান্তরে যদি খারাপ কাজে অভ্যস্ত করে তোলা হয় এবং চতুষ্পদ জন্তুর মতো বলগাহীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয় উদাসীনতা প্রদর্শন করা হয় তাহলে সে হতভাগা ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। আর তার পাপাচারের বোঝা মাতা-পিতা, অভিভাবক ও দায়িত্বশীলদের কাঁধে এসে পড়বে। আল্লাহ বলেন, ‘ হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে রক্ষা করো এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো। পৃথিবীর অগ্নিকাণ্ড থেকে সন্তানদের বাঁচানোর তাগিদে আমরা কত আপ্রাণ চেষ্টা করি তো পরকালের চিরস্থায়ী আগুন থেকে বাঁচানোর তাগিদে আরো বেশি প্রচেষ্টা করা উচিত। চিরস্থায়ী অগুন থেকে বাঁচানোর পদ্ধতি হলো মাতা-পিতা সন্তানকে সভ্যতা, ভদ্রতা, উত্তম চরিত্র ও নৈতিক গুণাবলির শিক্ষা দেবে এবং অসৎ সংশ্রব থেকে পরিপূর্ণভাবে দূরে রাখবে। (ইহয়া উলুমুদ্দিন ৩/৭৩)

বিবেক ও বুদ্ধির যত্ন : বিশুদ্ধ চিন্তাচেতনা, সুচিন্তিত পরিকল্পনা, মার্জিত দৃষ্টিভঙ্গি, কিভাবে চিন্তাভাবনা করতে হয়, তথ্য-প্রমাণাদি কিভাবে উপস্থাপন করতে হয়, বিষয়বস্তুর সাবলীল উপস্থাপন, ইলমি ও শাস্ত্রীয় দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া চাই। স্থান-কাল-পাত্র বুঝে কথা বলা এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঠিক ধারণা তাদেরকে দিতে হবে। জাগতিক বিষয়ে সচেতন করে তোলা এবং জাগতিক সাধারণ জ্ঞান দান করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

লেখক : মুহাদ্দিস, মারকাজুল ফিকহিল ইসলামী, উত্তরা, ঢাকা।
ও নির্বাহী পরিচালক, জামিয়া উম্মুলকুরা ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।


আরো সংবাদ



premium cement