মুক্ত পরিবেশে নির্বাচনী বার্তা নিয়ে তৃণমূলে বিএনপি

অর্ধযুগ পর পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ করবেন খালেদা জিয়া

এবারের ঈদুল ফিতর বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে এক ভিন্ন অনুভূতি তৈরি করেছে। এর আগে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা হয় জেলে না হয় আত্মগোপনে ঈদ উদযাপন করেছেন। অনেকেই ১০-১২ বছর ধরে নিজের এলাকায় পর্যন্ত যেতে পারেননি।

মঈন উদ্দিন খান
Printed Edition

ঈদকে কেন্দ্র করে অর্ধযুগ পর মুক্ত পরিবেশে নির্বাচনী বার্তা নিয়ে তৃণমলে যাচ্ছে বিএনপি। বৃহৎ এই উৎসবকে ঘিরে নানা আয়োজনে দলের ইমেজ ও জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে ইতোমধ্যে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে নেতাদের। নির্দেশনা পেয়ে স্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি আগামী নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা এ ঈদকে বেছে নিয়েছেন গণসংযোগের সুযোগ হিসেবে।

ঈদে বিএনপির বিশেষ বার্তার কথা জানিয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের পর একটি ভিন্ন পরিবেশে এবার ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন দেশের মানুষ। নেতাকর্মীরা অনেকেই নিজ নিজ এলাকায় ঈদুল ফিতর পালন করবেন। এবারের ঈদে বিএনপির বার্তা হলো- নেতাকর্মীরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ঈদ উদযাপন করবেন। বিশেষ করে আগামী ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের কথাবার্তা এবং আচরণে মানুষ যেন কষ্ট না পায়। জনগণের পাশে থাকতে হবে। এটিই আমাদের দলীয় বার্তা।

এবারের ঈদুল ফিতর বিএনপির নেতাকর্মীদের কাছে এক ভিন্ন অনুভূতি তৈরি করেছে। এর আগে পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সময়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা হয় জেলে না হয় আত্মগোপনে ঈদ উদযাপন করেছেন। অনেকেই ১০-১২ বছর ধরে নিজের এলাকায় পর্যন্ত যেতে পারেননি। গত বছরের বিপ্লবে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর বিরোধী রাজনীতিতে স্বস্তি নেমে আসে। সেই স্বস্তি নিয়ে উদযাপিত হবে এবারের ঈদ।

মুক্ত পরিবেশে ঈদ উদযাপনের কথা জানিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাহউদ্দিন টুকু বলেন, চার শতাধিক মামলা নিয়ে বিগত বছরগুলোতে কখনো জেলে, কখনো ফেরারি জীবনে আমাকে থাকতে হয়েছে। চার বছরের মতো কারাগারে কাটিয়েছি। কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে সবসময়ে চাওয়া ছিল- দলের নেতাকর্মী, সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু বিগত স্বৈরাচার সরকারের কারণে সেটা এতদিন হয়ে উঠেনি। এবার সেটা পুষিয়ে নিতে দিনরাত একাকার করে কাজ করছি।

স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজীব আহসান বলেন, সর্বশেষ তিনি তার এলাকায় গিয়েছিলেন ২০১৩ সালে। ওই বছর ২৫ রোজায় তার বাবা স্কুলশিক্ষক মিজানুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। এ উপলক্ষে শেষবার নিজ বাড়িতে গিয়েছিলেন। এবার অনেকবছর পর নিজ বাড়িতে মা, বোনদের সাথে এবং নিজ আসনের নেতাকর্মী, সমর্থক আর সাধারণ মানুষের সাথে ঈদ করবেন।

নেতাকর্মীরা জানান, দলের প্রত্যেক নেতাকর্মী মুক্ত বাতাসে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে নানামুখি পরিকল্পনা করছেন। এর মধ্যে আগামী নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা ছুটছেন তৃণমূলের আস্থা অর্জন করতে। বিগত দিনে নির্যাতিত নেতাকর্মী ছাড়াও গুম, খুনের শিকার নেতাকর্মীদের পরিবারের কাছে যাচ্ছেন। তাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ঈদসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। জনসংযোগের পাশাপাশি যোগ দিচ্ছেন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোয়। জলসা ও তাফসির মাহফিলে অংশ নিয়ে ঐক্য ও শান্তির বার্তা দেয়ার সাথে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতিও।

দলের নেতারা জানান, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হবে- এমনটা ধরেই তারা মাঠে নেমেছেন। বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী ছাড়াও সিনিয়র নেতারাও এখন ঘন ঘন যাচ্ছেন নির্বাচনী আসনে। সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন তারা। এসবের মূল উদ্দেশ্যে জাতীয় নির্বাচনের ঢেউ তোলা।

চট্টগ্রাম-১ (মিরসরাই) আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী শাহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা নির্বাচন শব্দটির কবর রচনা করেছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি, আগামীর নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক। সেই নির্বাচনে জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পেতে আমরা রাতদিন কাজ করে যাচ্ছি। ঈদকে ঘিরেও নানা আয়োজনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।

নেত্রকোনা-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রকৌশলী মো: মোস্তফা-ই জামান সেলিম বলেন, ঢাকায় ঈদ উদযাপন করে এলাকায় গিয়ে গণসংযোগ করব। এই ঈদে জনগণের পাশে থাকাই হবে আমাদের একমাত্র কাজ।

বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঈদ উপহার নিয়ে ইতোমধ্যে তৃণমূলে রয়েছেন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। গণমাধ্যমের সম্পাদক, কূটনীতিকসহ বিশিষ্টজনদের মাঝে তারেক রহমানের পক্ষ থেকে ঈদুল ফিতরের শুভেচ্ছা কার্ড ও মিষ্টান্ন পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দীর্ঘ সময় ধরে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলন-সংগ্রামে গুম-খুন ও নির্যাতনের শিকার নেতাকর্মীদের খোঁজ নিতে ও তাদের পরিবারের সদস্যদের পাজামা-পাঞ্জাবি ও শাড়ি উপহার দিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে টিম গঠন করা হয়েছে। এ কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন ‘আমরা বিএনপি পরিবার’।

অর্ধযুগ পর পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ করবেন খালেদা জিয়া

অর্ধযুগেরও বেশি সময় পর এবার লন্ডনে পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ উদযাপন করবেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। চিকিৎসার জন্য গত জানুয়ারি থেকে লন্ডনে আছেন তিনি। সেখানে বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, পুত্রবধূ, ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী ও তিন নাতনীর সাথে পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন তিনি।

উন্নত চিকিৎসার জন্য গত জানুয়ারি মাসে লন্ডনে যান বিএনপি চেয়ারপারসন। ৮ থেকে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি লন্ডনের দ্য ক্লিনিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এরপর তারেক রহমানের বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাসায় ফেরার পর গত দুই মাসে খালেদা জিয়াকে আর হাসপাতালে নিতে হয়নি। কোনো পরীক্ষার প্রয়োজন হলে দ্য ক্লিনিকের চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা বাসায় গিয়ে তার স্বাস্থ্যের পরীক্ষা করছেন।

খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, লন্ডন ক্লিনিকের অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও জেনিফার ক্রসের অধীনে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন বেগম খালেদা জিয়া। এ ছাড়া তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল টিমের সদস্যরা সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছেন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দিচ্ছেন।

খালেদা জিয়া কবে দেশে ফিরতে পারেন, এমন প্রশ্নের উত্তরে জাহিদ হোসেন বলেন, ঈদের পর তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল টিমের পরামর্শে তিনি এপ্রিলের যেকোনো দিন দেশে ফিরতে পারেন। তবে পুরো বিষয়টি মেডিক্যাল টিমের অনুমতির ওপর নির্ভর করছে।

বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা ঢাকায় ঈদুল ফিতর উদযাপন করবেন। ঈদের দিন প্রধান উপদেষ্টার আমন্ত্রণে মহাসচিব শুভেচ্ছা জানাতে যাবেন। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডক্টর আব্দুল মঈন খান লন্ডনে ঈদ করবেন। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকার ঈদ করবেন। এ ছাড়া ঈদুল ফিতরের দিন সকালে রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ ও দোয়া মুনাজাত করবেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সিনিয়র নেতারা।

এ ছাড়া দলের ভাইস চেয়ারম্যান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, যুগ্ম মহাসচিব, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যদের বেশির ভাগ ঢাকায় ঈদ পালন করবেন। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমিনুল হক, সদস্যসচিব মোস্তফা জামান, দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল আলম মজনু, সদস্যসচিব তানভীর আহমেদ রবিন ঢাকায় নিজ নির্বাচনী এলাকায় ঈদ করবেন। যুগ্ম মহাসিচব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে, আরেক যুগ্ম মহাসচিব আব্দুস সালাম আজাদ নিজ এলাকা মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে যাওয়ার কথা রয়েছে। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবকবিষয়ক সম্পাদক ও মুন্সীগঞ্জ-১ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মীর সরফত আলী সপু শ্রীনগরে, কেন্দ্রীয় নেতা তাবিথ আউয়াল ও প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন ঢাকায় ঈদ করবেন।