- যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর চেষ্টা বিফল
- ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ হামাসের
- ট্রাম্পের সাথে পরামর্শ করেই গাজায় ইসরাইলি হামলা
- রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম ও জাতিসঙ্ঘের উদ্বেগ
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে ফের হামলা চালাচ্ছে ইসরাইল। এই হামলায় গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অন্তত ৪১৩ জন ফিলিস্তিনির নিহত হওয়ার খবর জানিয়েছে। নিহতদের বেশির ভাগই নারী, শিশু এবং বয়স্ক নাগরিক। গাজার উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং হামাসের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাহমুদ আবু ওয়াফাহ নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। গতকাল মঙ্গলবার নিজেদের পৃথক লাইভ আপডেটে এই তথ্য জানিয়েছে বিবিসি ও আলজাজিরা।
আলজাজিরা তাদের সরাসরি সম্প্রচারিত আপডেটে জানিয়েছে, গাজায় যুদ্ধবিরতির অবসান ঘটিয়েছে ইসরাইল এবং এরপর অবরুদ্ধ এই উপত্যকাজুড়ে বিমান হামলা শুরু করেছে। বর্বর এই হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৪১৩ জন ফিলিস্তিনির নিহত এবং অন্যান্য আরো অনেকের আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও রয়েছে বলে জানিয়েছে চিকিৎসা সূত্র। গাজার উত্তরাঞ্চলেই প্রাণ হারিয়েছেন দেড় শতাধিক মানুষ।
এছাড়া বিবিসি জানিয়েছে, গাজার উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং হামাসের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কর্মকর্তা মাহমুদ আবু ওয়াফাহ এক হামলায় নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর গাজায় এটিই সবচেয়ে বড় বিমান হামলা। যুদ্ধবিরতি বাড়ানোর আলোচনা সমঝোতায় পৌঁছাতে ব্যর্থ হওয়ার পরই এই হামলা শুরু হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পবিত্র রমজান মাস হওয়ায় অনেক লোক সেহরি খাচ্ছিলেন, তখনই গাজায় হামলা ও বিস্ফোরণ শুরু হয়।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ মঙ্গলবার সকালে হামলার নির্দেশ দিয়েছেন বলে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, ‘আমাদের বন্দীদের মুক্তি দিতে হামাসের বারবার অস্বীকৃতি এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের দূত স্টিভ উইটকফ ও মধ্যস্থতাকারীদের কাছ থেকে আসা সব প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের জবাবে এই হামলা চালানো হচ্ছে। ইসরাইল এখন থেকে হামাসের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে।’
এ দিকে গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস ইসরাইলের প্রাণঘাতী হামলার বিষয়ে একটি নতুন বিবৃতি প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, ইসরাইলি আগ্রাসনে নিহতদের বেশির ভাগ হলেন নারী, শিশু এবং বয়স্ক মানুষ। এ ছাড়া হামলায় কিছু পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। মিডিয়া অফিস বলেছে, “ইসরাইলি দখলদার সেনাবাহিনীর সঙ্ঘটিত এই নৃশংস গণহত্যা আবারো সেটাই নিশ্চিত করছে যে এই দখলদার বাহিনী কেবল হত্যা, ধ্বংস এবং গণহত্যার ভাষা বোঝে।”
মিডিয়া অফিস বলেছে, ‘আমাদের ফিলিস্তিনি জনগণের ইচ্ছাকে ধ্বংস করার একটি যুদ্ধ কৌশল হিসেবে এই হামলা চালানো হচ্ছে। তবুও, গাজার জনগণ এই তাণ্ডবলীলার কারণে ভীত হবে না এবং আমাদের ভূমি থেকে ইসরাইলি দখলদারিত্ব অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত তাদের দৃঢ় এবং বৈধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবে।”
গাজার এই মিডিয়া অফিস জাতিসঙ্ঘ, মানবাধিকার গোষ্ঠী এবং সাহায্য সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে ইসরাইলের এই অপরাধের বিরোধিতা করার জন্য এবং ইসরাইলি নেতাদের জবাবদিহি করার জন্য অবিলম্বে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ব চুপ করে থাকতে পারে না’।
ইসরাইলি দৈনিক মারিভ জানিয়েছে, নিজের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাক্ষ্য স্থগিত করা হয়েছে। মঙ্গলবার ওই সাক্ষ্য নেয়ার কথা থাকলেও উদ্ভূত ‘নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে’ তা স্থগিতের অনুরোধ জানান নেতানিয়াহু। পরে তা আমলে নিয়ে সাক্ষ্য স্থগিত করে আদালত।
রয়টার্স লিখেছে, গাজার উত্তরাঞ্চল, গাজা সিটি এবং মধ্য ও দক্ষিণ গাজার দেইর আল-বালাহ, খান ইউনুস ও রাফাহসহ একাধিক স্থানে হামলার খবর পাওয়া গেছে।
যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভাঙার জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ এনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। তারা বলছে, গাজায় থাকা বাকি ইসরাইলি বন্দীদের ‘অজানা পরিণতির’ মুখে ফেলেছে ইসরাইল। তবে হামাস এখনো ফের যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দেয়নি। তার বদলে মধ্যস্থতাকারীদের এবং জাতিসঙ্ঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানিয়েছে। হামাস বলছে, গাজা যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাতিল করার জন্য ইসরাইল অবরুদ্ধ ও অরক্ষিত বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ‘বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ’ আক্রমণ চালিয়েছে। এ ছাড়া আরেক ফিলিস্তিনি সংগঠন প্যালেস্টানিয়ান ইসলামিক জিহাদও ইসরাইলের বিরুদ্ধে ‘ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ’ করার অভিযোগ করেছে।
হোয়াইট হাউজের এক মুখপাত্র ফক্স নিউজকে বলেছেন, হামলা চালানোর আগে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সাথে আলোচনা করেছে ইসরাইল। বিবিসি লিখেছে, সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্ব ১ মার্চ শেষ হওয়ার পর সেটিকে এগিয়ে নেয়ার পথ খুঁজছিলেন মধ্যস্থতাকারীরা। যুদ্ধবিরতির প্রথম পর্বের মেয়াদ মধ্য এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র, যার মধ্যে আরো বন্দিবিনিময়ের শর্ত ছিল। তবে আলোচনার সাথে সংশ্লিষ্ট এক ফিলিস্তিনি কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেছেন, পরোক্ষ আলোচনায় উইটকফের চুক্তির মূল দিকগুলো নিয়ে ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে।
ইসরাইলি এক সামরিক কর্মকর্তা গাজায় স্থল আক্রমণের হুমকি দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করা ওই ইসরাইলি সামরিক কর্মকর্তা সংবাদ সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ইসরাইলের আক্রমণ যতদিন প্রয়োজন ততদিন অব্যাহত থাকবে এবং বিমান হামলার বাইরেও বিস্তৃত হবে। যা গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি সেনাদের সম্ভাব্য স্থল অভিযানে প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত দেয়। এই পরিস্থিতিতে ইসরাইলকে জবাবদিহি করার জন্য হামাস যুদ্ধবিরতি মধ্যস্থতাকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে এবং আরব লীগ ও ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি)-কে গাজা উপত্যকায় আরোপিত অন্যায্য অবরোধ ভাঙতে ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছে।
একই সাথে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদকে জরুরি বৈঠক করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছে হামাস, যাতে ইসরাইলকে তার আগ্রাসন বন্ধ করতে বাধ্য করা যায়।
যে অজুহাতে ফের হামলা : যুদ্ধবিরতি চুক্তির মাধ্যমে গাজায় ১৫ মাস ধরে চলা সামরিক অভিযানের ইতি টেনেছিল ইসরাইল। ভয়াবহ সেই অভিযানে গাজায় নিহত হয়েছেন প্রায় ৫০ হাজার ফিলিস্তিনি। যে চুক্তির ভিত্তিতে ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছিল, সেটি তিন পর্বে বিভক্ত। প্রথম স্তরে হামাসের কব্জায় থাকা বন্দী ও ইসরাইলের কারাগারগুলোতে থাকা বন্দিবিনিময়ের পাশাপাশি গাজায় খাদ্য ও ত্রাণসামগ্রী সরবরাহ স্বাভাবিক করার শর্ত ছিল। দ্বিতীয় স্তরের শর্ত ছিল যে অবশিষ্ট সব বন্দীকে মুক্তি দেবে হামাস এবং গাজা থেকে নিজেদের সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নেবে ইসরাইল।
চুক্তির প্রথম পর্বের মেয়াদ ছিল ৬ সপ্তাহ। সেই মেয়াদ সম্প্রতি শেষ হয়েছে; তারপর থেকে দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে সমস্যায় পড়েছে ইসরাইল ও হামাস। কারণ হামাস চাইছে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, অন্য দিকে ইসরাইলের আশঙ্কা- গাজা থেকে সেনাদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে নিজেদের সংগঠিত করে ফের ইসরাইলে হামলা চালাবে হামাস। এর মধ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের দ্বৈত নাগরিক এবং ইসরাইলি বাহিনীর সেনা সদস্য ইদান আলেক্সান্দারসহ চারজন দ্বৈত নাগরিকের লাশ ইসরাইলকে ফেরত দেয় হামাস। ইসরাইলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় যে ইদান আলেক্সান্দার ও বাকি তিনজনকে ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করেছে হামাস যোদ্ধারা, তবে হামাস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই নিয়ে দু’পক্ষের টানাপড়েনের মধ্যেই গাজায় ফের হামলা শুরু করেছে ইসরাইলি বাহিনী।
রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম ও জাতিসঙ্ঘের উদ্বেগ : বিবিসি জানায়, গাজায় ইসরাইলি হামলার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। অস্ট্রেলিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী পেনি ওং সব পক্ষকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সব বেসামরিক নাগরিককে রক্ষা করতে হবে। বেলজিয়ামের উপ-প্রধানমন্ত্রী ম্যাক্সিম প্রিভোট হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। সব পক্ষকে যুদ্ধবিরতি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, আসুন আমরা পিছনে না যাই। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেছেন, চীন পরিস্থিতি নিয়ে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন এবং আশা করছে যে সব পক্ষ এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া এড়িয়ে চলবে, যা উত্তেজনার কারণ হতে পারে। রাশিয়ার মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভও পরিস্থিতি উদ্বেগজনক বলে এটিকে উত্তেজনা বৃদ্ধির আরেকটি পথ বলে অভিহিত করেছেন। জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস হামলায় মর্মাহত এবং যুদ্ধবিরতি মেনে চলার জন্য জোরালোভাবে আবেদন করেছেন।
ট্রাম্পের সাথে পরামর্শ করেই গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল : যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পরামর্শ করেই এই হামলা চালানো হয়েছে। হোয়াইট হাউসের একজন মুখপাত্র ফক্স নিউজকে বলেছেন, হামলা চালানোর আগে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসনের সাথে ইসরাইল পরামর্শ করেছে। খবর রয়টার্সের। হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিট ফক্স নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, গাজায় হামলার বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এবং হোয়াইট হাউজের সাথে ইসরাইলিরা পরামর্শ করেছে।



