সামাজিক উপকারভোগীদের তালিকায় গলদ, প্রকৃত হকদাররা ভাতা থেকে বঞ্চিত

সামাজিক সুরক্ষার তালিকা সংশোধনে গাফিলতির বিষয়টি স্পষ্ট। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এ ব্যাপারে জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। দ্রুততার সাথে সংশোধিত তালিকা প্রণয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।

বাংলাদেশে বিপুল দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী রয়েছে। এ জন্য সামাজিক সুরক্ষা খাতে বড় ধরনের ব্যয় হয়। ২৬টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৪০টি কর্মসূচির আওতায় বিশাল কর্মকাণ্ড বাস্তবায়িত হয়। চলতি অর্থবছরে এ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক লাখ ৩৬ হাজার ২৬ কোটি টাকা। সুরক্ষা প্রকল্পের অর্থ প্রদানের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ করে সুফলভোগী বাছাইয়ে হয়েছে অনিয়ম। বিপুল অর্থ খরচ হলেও প্রকৃত হকদাররা এর যথার্থ সুফল পাচ্ছে না।

চলতি অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন ৬০ লাখ, মাথাপিছু ৬০০ টাকা করে। বিধবা ভাতা পাচ্ছেন ২৮ লাখ, মাথাপিছু ৫৫০ টাকা করে। অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা পাচ্ছেন ৩২ লাখ, মাথা পিছু ৮৫০ টাকা করে। হিজড়া জনগোষ্ঠীর ১৩ লাখ, ৬০০ টাকা করে। এভাবে ২৭ ধরনের ভাতাসহ আরো শতাধিক কর্মসূচি রয়েছে। সামাজিক সুরক্ষা পাচ্ছেন এমন মানুষ দেশে আনাচে-কানাচে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় রয়েছে। বিপুল বাজেট বিশাল জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছালে সামাজিক ব্যবস্থায় এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ার কথা। এতে সহজে জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দরিদ্র থেকে উঠে আসতে পারত। কিন্তু বাস্তবে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বিপুল ব্যয় হলেও এর ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান নয়।

মূলত অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রকৃত হকদাররা সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আসছে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপকারভোগীদের তালিকা করেন। সিপিডির করা গত বছরের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, বয়স্ক ভাতার কার্ড পেতে গড়ে দুই হাজার ৬৫৩ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। একটি কার্ডের জন্য ৫০০ থেকে ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ লেনদেন হয়। ইউনিসেফের জরিপ বলছে, সামাজিক সুরক্ষার উপকারভোগীদের ৪৩ শতাংশ ত্রুটিপূর্ণ। যারা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন তাদের অনেকে যোগ্য নয়। মোট কথা, ঘুষের বিনিময়ে তালিকা করা হয়েছে। চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ঘুষ গ্রহণ ছাড়াও নিজেদের কর্মী-সমর্থক ও আত্মীয়দের এর সুবিধাভোগী করেছেন। দরিদ্রদের বদলে সচ্ছলরা সুবিধা পাচ্ছেন। ফলে সামাজিক সুরক্ষা নেটওয়ার্ক উদ্দেশ্য সাধনে ব্যর্থ হচ্ছে। এ অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকার তালিকা সংশোধনের সিদ্ধান্ত নিলেও সাত মাস চলে গেলেও কোনো অগ্রগতি নেই। এখনো আগের তালিকায় বিভিন্ন ভাতা বণ্টন করা হচ্ছে।

সামাজিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি ৩০ মার্চের মধ্যে উপকারভোগীর তালিকা যাচাই করে চূড়ান্ত করার নির্দেশনা দিয়েছিল। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাচাই-বাছাই কার্যক্রম শুরু করাই যায়নি। এ কাজ করতে কমপক্ষে তিন মাস লাগবে। সমাজসেবা অধিদফতরের তরফ থেকে জানা গেছে, কোন প্রক্রিয়ায় যাচাই হবে সেই নীতি এখনো ঠিক হয়নি। অর্থাৎ আগামী তিন মাসের মধ্যে তালিকা যাচাই করা সম্ভব হবে না। অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও (জানুয়ারি-মার্চ) আগের তালিকা অনুযায়ী ভাতা দেয়া হয়েছে। শেষ প্রান্তিকেও তাই আগের তালিকা অনুযায়ী ভাতা বণ্টন করতে হবে।

সামাজিক সুরক্ষার তালিকা সংশোধনে গাফিলতির বিষয়টি স্পষ্ট। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের এ ব্যাপারে জবাবদিহি নিশ্চিত করা উচিত। দ্রুততার সাথে সংশোধিত তালিকা প্রণয়নে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।