০২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১, ২২ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বৃহৎ শক্তিগুলোর অস্ত্র প্রতিযোগিতাই দারিদ্র্যের প্রধান কারণ

-

পরাশক্তিগুলো নিত্যনতুন মারণাস্ত্র তৈরিতে মগ্ন থেকে বিশ্বে সত্যিকার অর্থে কোনো শান্তি আনা সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো এমন মারাত্মক অস্ত্র তৈরি করছে, এগুলো ব্যবহারে শুধু যুদ্ধরত দেশগুলো ধ্বংস হবে না, অন্য দেশগুলোও বিভিন্নভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই যুদ্ধে জেতার কারো সম্ভাবনাই নেই। অবিশ্বাস্য রকমের শক্তিশালী আণবিক বোমা ও অন্যান্য অস্ত্র তৈরি হচ্ছে; অর্থাৎ ১৯৬০ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ক্রুশ্চেভ। তিনি পারমাণবিক যুদ্ধ ও তার ভয়াবহতা সম্পর্কে তখন বলেছিলেন, ‘There are those who do not seem able to get into their heads that in the next war, victor will be barely distinguishable from vanquished. A war between soviet union and the united states would almost certainly end in mutual defeat’. অনেকেই আছেন যাদের মাথায় ঢুকছে না যে, আগামী যুদ্ধে বিজয়ী ও পরাজিতের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যদি যুদ্ধ হয় সে ক্ষেত্রে এটি সুনিশ্চিত যে, উভয়েই পরাজিত হবে।’

বিশ্বে দারিদ্র্যের অনেক কারণ রয়েছে। একটি কারণ সব যুগে অব্যাহতভাবে বিরাজ করছে তা হলো- যুদ্ধের জন্য অস্ত্র উৎপাদন। বিশ্বের সভ্যতা যতই উৎকর্ষ হয়েছে উৎপাদিত অস্ত্রও ধ্বংস শক্তি ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। একই মানবজাতি বিশ্বে এই স্ববিরোধী কাজের জন্য বিশ্বের কোনো অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রতিবাদ বা আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখা যায়নি। আরো আশ্চর্যের বিষয়, কোনো দল অর্থনৈতিক মুক্তির নামে, কোনো দল বিশ্বশান্তির নামে, কোনো দল গণতন্ত্র কায়েমের নামে বিভিন্ন অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে।

অথচ যুদ্ধ ও অস্ত্র বিক্রিই যে যুদ্ধের এবং বিশ্বের দারিদ্র্যের মূল কারণ এটি বুঝেও বিশ্বের স্বার্থান্বেষী মহল না বোঝার ভান করে যাচ্ছে। বিশ্বে অস্ত্রের রমরমা ব্যবসার ফলে কিছু লোকের পকেট ভারী হলেও বিশ্বের কোটি কোটি লোক দরিদ্রতার কশাঘাতে বিশ্বব্যাপী অনাহারে-অর্ধাহারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বের কোথাও যখন যুদ্ধের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় তখন এটি শুধু প্রাণহানিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। যুদ্ধ মানুষের প্রাণহানি ছাড়াও বাসস্থান, হাসপাতাল, ব্যবসায়প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে দেয়। ফলে যেকোনো যুদ্ধ শুরু হলেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ নষ্ট হওয়া ছাড়াও সংশ্লিষ্ট দেশের অর্থনীতি অচল হয়ে যাওয়ায় লাখ লাখ মানুষ বেকারত্বের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে থাকে এবং সে দেশে চরম দারিদ্র্যের আর কোনো বিকল্প থাকে না।

Institute for Economics and Peace-এর ২০২০ সালের দেয়া হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের ফলে সর্বমোট খরচ হয়েছে ১৪.৯৬ ট্রিলিয়ন ডলার। এই সংখ্যাটা সারা বিশ্বের জিডিপির ১১.৬ শতাংশ। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি ১৭ ট্রিলিয়নের বেশি নয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের কারণে যদি ১৪.৯৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়ে যায়, বিশ্বে বিরাজমান যুদ্ধ পরিস্থিতি মানবজাতির জন্য কত ভয়াবহ তা সহজেই অনুমেয়।

বর্তমান বিশ্বে প্রায় ৫০টির মতো সঙ্ঘাতময় অঞ্চল রয়েছে, ওই সব অঞ্চলে প্রায় ১৫০ কোটির মতো মানুষ অহরহ হিংস্রতার শিকার হচ্ছে এবং এই অহরহ সংঘর্ষের কারণে সে সব অঞ্চলে তাদের জিডিপির প্রায় ৫৯ শতাংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে। এক হিসাবে দেখা যায়, ২০১৯ সালে সিরিয়ার গৃহযুদ্বের ফলে সে দেশের জিডিপির প্রায় ৬০-৫৯ শতাংশ খরচ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সে সালে সিরিয়ার জিডিপির ৫৯ শতাংশই হারিয়েছে।

একই সালে যুদ্ধের কারণে আফগানিস্তান হারিয়েছে জিডিপির ৫০ শতাংশ এবং সুদান হারিয়েছে জিডিপির ৪৬ শতাংশ। সিরিয়া থেকে ইয়েমেন, হাইতি থেকে মালি, দক্ষিণ সুদান থেকে মালি, দক্ষিণ সুদান থেকে ভেনিজুয়েলা, আফগানিস্তান থেকে মিয়ানমার রাজনৈতিক সঙ্কট এবং যুদ্ধের ফলে কয়েক মিলিয়ন লোক তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের বাস্তুচ্যুত সংক্রান্ত হাইকমিশনারের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ আট কোটি ২৪ লাখ মানুষকে যুদ্ধসংক্রান্ত অত্যাচার থেকে বাঁচতে বাসস্থান ছেড়ে পালাতে হয়েছে। মাত্র পাঁচটি দেশ থেকে ২-৩ শতাংশ লোক পালাতে হয়েছে। সিরিয়া থেকে ৬৮ লাখ, ভেনিজুয়েলা থেকে ৫৪ লাখ, আফগানিস্তান থেকে ২৮ লাখ, দক্ষিণ সুদান থেকে ২২ লাখ এবং মিয়ানমার থেকে ১১ লাখ পালাতে হয়েছে। এসব বাস্তুচ্যুত লোক প্রতিবেশী দেশেই আশ্রয় নিয়েছে। এসব লোক বছরের পর বছর দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষকে এই দুর্বিষহ অবস্থায় রেখে যারা বিশ্ব শান্তির কায়েম করার স্বপ্নে বিভোর, কী পান করে এদের মধ্যে এই ভয়াবহ মাতলামি সৃষ্টি হয়েছে, তা কঠিন গবেষণার বিষয়। জাতিসঙ্ঘের বাস্তুচ্যুত সংক্রান্ত হাইকমিশনারের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২০ সালের শেষ নাগাদ আট কোটি ২৪ লাখ লোককে যুদ্ধ বা অত্যাচার থেকে বাঁচতে বাসস্থান ছেড়ে পালাতে হয়েছে।

বর্তমান সময়ে বিশ্বের জনসংখ্যার ৯.২ শতাংশ মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে জীবনযাপন করছে। তারা প্রতিদিন মাথাপিছু ১.৯ ডলারের বেশি খরচ করার সক্ষমতা রাখে না। অথচ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে অন্যতম হলো ২০৩০ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করার কর্মসূচি। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় যে হারে যুদ্ধ চলছে এবং বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর যে তাণ্ডব চলছে, এ পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, চরম দারিদ্র্য নির্দিষ্ট সময়ে দূর করা প্রায় অসম্ভব। বর্তমান হিসাব মতে দেখা যাচ্ছে- ২০২১ সালে বিশ্বের প্রায় ৭৫ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের মধ্যেই থাকতে হবে। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংক ও বিশ্বের অন্যান্য অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মতামত দেখা যায়, ২০৩০ সালের মধ্যে ৫০ থেকে ৬৪ শতাংশ বিশ্বের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ ওই সব দেশে বাস করবে যেগুলো যুদ্ধবিধ্বস্ত এবং সেসব দেশে ব্যাপকহারে উৎপীড়নও চলছে।

অতি দুঃখের বিষয় হলো- সারা বিশ্বে এক মুনাফেকি অবস্থা বিরাজ করছে; যা বলা হয় তা করা হয় না, আর যা করা হয় তা বলা হয় না। বিশ্বের ধনী এবং যুদ্ধাস্ত্রে শক্তিশালী সব দেশের ব্যাপারে এ বক্তব্য প্রযোজ্য। ২০২০ সালে সামরিক খাতে সারা বিশ্বে যত ডলার খরচ হয়েছে তার ৬২ শতাংশ খরচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, রাশিয়া ও ইংল্যান্ড। Stockholm International Peace Research Institute (SIPRI)-এর অনুসন্ধানী রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২০ সালে শুধু বিশ্বের যত অর্থ সামরিক খাতে খরচ হয়েছে তার ৩৯ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্র একাই করেছে এবং এর পরের স্থান হলো চীনের যা ছিল ২৫২ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় ১৩ শতাংশ। ভারত ৭২.৯ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩.৭ শতাংশ, রাশিয়া ৬১.৭ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ৩.১ শতাংশ এবং যুক্তরাজ্য ৫৯.২ বিলিয়ন ডলার যা ৩ শতাংশ। ২০১৯ সালে ইউরোপের দেশগুলো সম্মিলিতভাবে (২৭টি দেশ) ১৮৬ বিলিয়ন ইউরো সামরিক খাতে খরচ করেছিল। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সে সময়ে বিশ্বব্যাপী ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছিল। এই যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আট ট্রিলিয়ন ডলার এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে, এই পর্যন্ত ৯ লাখ ২৯ হাজার লোক মারা গেছে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাও রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধের সেনারাও রয়েছে। সারা বিশ্বে বর্তমানে মানুষের যুদ্ধবিগ্রহ মনুষ্যত্বহীন বর্বর আচরণ এবং কপটতা চলছে যা সম্পূর্ণ অসহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। হিসাব করলে দেখা যাবে, এ পর্যন্ত যত মুদ্রা মানুষকে মারার জন্য খরচ করা হয়েছে মানুষকে বাঁচানোর জন্য তার সিকিভাগও খরচ করা হয়নি। শুধু আফগানিস্তানের বিষয়টি বিশ্লেষণ করলেই সত্যিকার পরিস্থিতি বোঝা যাবে- আফগানিস্তান যুদ্ধে এই পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে। এই বিপুল অঙ্কের ডলার দিয়ে চিরতরে আফগানিস্তানের মানুষকে দারিদ্র্যমুক্ত করা যেত। অথচ আজকে আফগানিস্তান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই বিশাল অঙ্কের ডলার খরচ হওয়ার পরও আফগানিস্তানের ৪৭.৩ শতাংশ মানুষ দরিদ্রই রয়ে গেল। বর্তমান বিশ্বের সর্বমোট জিডিপির ২.৩ শতাংশ বিশ্বের সামরিক খাতে ব্যয় হয়, সামরিক খাতের এই ব্যয়ের মাত্র ১০ শতাংশ বিশ্বের দারিদ্র্য ও ক্ষুধা নিরসনে যদি ব্যয় করা হয়, তা হলে সারা বিশ্ব চিরতরে ক্ষুধামুক্ত হবে। এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।


আরো সংবাদ



premium cement