১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


ভারতের মাদরাসাগুলোতে রামায়ণ পড়ানো হবে

ভারতের মাদরাসাগুলোতে রামায়ণ পড়ানো হবে - ছবি : সংগৃহীত

ভারতের সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোতে এবার হিন্দু ধর্মীয়গ্রন্থগুলো পড়ানো হবে। আর এখানকার ছাত্রদের শতভাগ ‘হিন্দুস্তানি’ বানানো হবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার অধীনস্থ দফতর এনআইওএসের মাধ্যমে এই কাজের সূচনা করেছে যারা দূরশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও সিনিয়র সেকেন্ডারি স্তরের শিক্ষার্থীদের রামায়ণ, গীতা, সংস্কৃত ও যোগব্যায়াম বা ইয়োগা শিক্ষাতেও শিক্ষিত করে তুলবে। ১০০টি মাদরাসায় হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির এই শিক্ষায় সূচনা করা হচ্ছে যেখানে ৫০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। ভবিষ্যতে ৫০০ মাদরাসা পর্যন্ত এই কর্মসূচির সীমা বাড়ানো হবে।

বিজেপি যখন থেকে পরিপূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, তখন থেকেই তারা ভারতকে হিন্দুত্ববাদের ছাঁচে ঢালার এজেন্ডা দ্রুত বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর। এমনিতেই সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ শাখাকে গেরুয়া রঙে রাঙানো হচ্ছে। কিন্তু এই মিশনে শিক্ষাসংক্রান্ত শাখাগুলোকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে, যাতে শিক্ষার্থীদের একটি বিশেষ মতাদর্শের ভিত্তিতে মগজ ধোলাই করা যায় এবং হিন্দুত্ববাদে শামিল করা যায়। ভারতের সেক্যুলার শিক্ষাব্যবস্থা তো আগে থেকেই হিন্দুত্ববাদের প্রভাবাধীন; এখন দ্বীন শিক্ষার এই মাদরাসাগুলোর পালা, যা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শরিয়ত শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট; যেখানে সংবিধানের ২৫ নং ধারা অনুযায়ী অর্জিত অধিকারের বলে ইসলামের শিক্ষা দেয়া হয়। সংবিধানের এই ধারায় সব ধর্মের অনুসারীদের নিজস্ব শিক্ষা কারিকুলাম প্রতিষ্ঠা করা এবং সেখানে নিজেদের ধর্মানুসারে শিক্ষা দেয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমান সরকার তাদের গেরুয়া এজেন্ডা বাস্তবায়নে সংখ্যালঘুদের অর্জিত সাংবিধানিক অধিকারকেই হরণ করতে প্রস্তুত। এনআইওএস বলেছে, এই পাঠ্যসূচিগত পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য, শিক্ষার্থীদের ভেতর প্রাচীন ভারতের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করা। দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়াতে (৩ মার্চ, ২০২১) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ শাখা এনআইওএসের (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং) সাথে যুক্ত মাদরাসাগুলোর শিক্ষার্থীদের জন্য হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ বেদ, মহাভারত ও গীতা প্রভৃতির ভিত্তিতে পাঠ্যসূচি তৈরি করা হবে। এ মৌলিক কোর্স তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য প্রণীত হবে। প্রকাশ থাকে যে, বর্তমানে ভারতজুড়ে প্রায় ১০০টি মাদরাসা এনআইওএসের সাথে যুক্ত রয়েছে, যেখানে ৫০ হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছে। এর সাথে আরো ৫০০টি মাদরাসা যুক্ত করা হবে। এই ‘ভালো কাজের’ জন্য পশ্চিম উত্তর প্রদেশ বা ইউপির মাদরাসাগুলোতে প্রভাব রাখেন, এমন আলেমদের একটি দল সরকারকে সহায়তা করতে প্রস্তুত হয়ে গেছে। সে দলের জেনারেল সেক্রেটারি সম্প্রতি এ ব্যাপারে যে পরিকল্পনা পেশ করেছেন, তাকে ‘গৃহপালিত মিডিয়া’ বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, কিছুদিন আগে আসাম অ্যাসেম্বলিতে একটি বিল পাস হয়েছে, যার মাধ্যমে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত মাদরাসাগুলোর চিরাচরিত শিক্ষা বন্ধ করে দিয়ে সেখানে আধুনিক শিক্ষার পাঠ্যসূচি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই পরিবর্তনের মূল উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, এখন মাদরাসাগুলোকে মান্ধাতা আমলের চিন্তাভাবনা থেকে বের করে ‘মেইন স্ট্রিম’-এর অংশ বানানো হবে। শাসক দলের ধারণা, ‘মাদরাসাগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মৌলবাদ ও উগ্রপন্থার শিক্ষা দেয়া হয়। সুতরাং তাদের এখান থেকে বের করে আধুনিক শিক্ষার দিকে নিতে হবে, যাতে তারা ‘সসম্মানে’ জীবন যাপন করতে পারে। সাধারণত মাদরাসা থেকে শিক্ষা সমাপনকারী শিক্ষার্থীরা অর্থ রোজগারের ক্ষেত্রে পিছে থেকে যায়, এ জন্য তাদের আধুনিক শিক্ষা দিয়ে বেকারত্বের সমস্যা দূর করা যেতে পারে। পার্থিব দিক দিয়ে এ চিন্তাভাবনা বেশ চিত্তাকর্ষক এবং এতে একটি বিশেষ ধরনের আবেগও আছে। কিন্তু সচেতন মানুষ বেশ ভালো করেই জানেন, দ্বীনি মাদরাসাগুলো মূলত ইসলামের অবশিষ্ট থাকা ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যে শক্তিগুলো ভারতে ইসলাম ও মুসলমানদের নামনিশানা মিটিয়ে দিতে চায়, তাদের দৃষ্টিতে মাদরাসাগুলো কাঁটার মতো যন্ত্রণাদায়ক। ‘প্রথম সুযোগেই একে শেষ করে দেয়া উচিত’। প্রকাশ থাকে, যে মাদরাসাগুলো মুসলমানরা নিজেদের অর্থে পরিচালনা করছেন, সেগুলোকে বন্ধ করা সহজ নয়। এ জন্য এই কাজের সূচনা সবার আগে ওই মাদরাসাগুলো থেকে করা হয়েছে, যারা সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত এবং যাদের ধরন ও রূপ পরিবর্তন করা তুলনামূলকভাবে সহজ।

এনআইওএসের চেয়ারম্যান সরোজ শর্মার বক্তব্য, ‘নতুন শিক্ষানীতির অধীনে ভারতের প্রাচীন শিক্ষা ও ভারতীয় সংস্কৃতিকে আধুনিকভাবে নিউ জেনারেশন পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রক্রিয়ায় এই পাঠ্যসূচি ১০০টি মাদরাসায় শুরু করা হচ্ছে। আগামীতে এটা বাড়িয়ে ৫০০টি মাদরাসায় ছড়িয়ে দেয়া হবে।’ প্রকাশ থাকে যে, এনআইওএস শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ একটি স্বায়ত্তশায়িত দফতর। এ দফতর প্রাচীন শিক্ষার উন্নয়ন ঘটানোর জন্য ‘ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরা’ শিরোনামে যে ১৫টি কোর্সের সূচনা করেছে, তাতে বেদ, ইয়োগা, বিজ্ঞান, সংস্কৃত, রামায়ণ, ভগবতগীতা প্রভৃতির শিক্ষা দেয়া হবে। এ কোর্স তৃতীয়, পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পড়ানো হবে আবশ্যিক হিসেবে। এর আওতায় ওই সব মাদরাসাকেও শামিল করা হয়েছে, যারা এনআইওএসের অধীনে রয়েছে।

কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরেল এনআইওএসের পাঠ্যসূচি চালু করতে গিয়ে বলেন, ‘এনআইওএস ভারতের প্রাচীন শিক্ষাকে ভিত্তি করে পাঠ্যসূচি তৈরি করে ভারতীয় শিক্ষা ও দর্শনকে সহজ ও বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করার এই প্রচেষ্টাকে স্বামী বিবেকানন্দের বাণীকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রাচীন ধারাকে উপেক্ষা না করে ভবিষ্যতের কর্মপন্থা প্রণয়ন করতে হবে।’ পোখরেল আরো বলেন, ‘এ পাঠ্যসূচি শিক্ষানীতির সমতা ও দক্ষতা নির্ভর উদ্দেশ্যকে প্রকাশ করছে। এতে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রাচীন ধারার শিক্ষার পাশাপাশি দেশপ্রেমের আবেগ উন্নয়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা এই কোর্সের উপকারিতা মাদরাসা পর্যন্ত পৌঁছাব। আর আমাদের উদ্দেশ্য, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভারতীয় কমিউনিটি পর্যন্তও এটাকে প্রতিষ্ঠিত করা। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, দর্শন ও প্রাচীন শিক্ষাকে আধুনিকভাবে নিউ জেনারেশনের কাছে পৌঁছানোর জন্য এনআইওএসের এই প্রচেষ্টা মাইলফলক বলে প্রমাণিত হবে।’

প্রকাশ থাকে যে, এনআইওএস দূরশিক্ষণ ও উন্মুক্ত শিক্ষার মাধ্যমে প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও সিনিয়র সেকেন্ডারি স্তরের কোর্স পরিচালনা করে থাকে এবং এর পাঠ্যসূচি জাতীয় ও প্রাদেশিক স্তরের বোর্ড কর্তৃক স্বীকৃত। এর ইয়োগা শিক্ষার পাঠ্যসূচিতে পাতঞ্জলি, ইয়োগা, সূর্য নমস্কার ও বিভিন্ন ‘আসন’ও শামিল রয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় ভোকেশনাল স্কুল প্রোগ্রামে গরুর দেখভাল, গরুর গোয়াল পরিষ্কার করা ও চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী তাদের যত্ন প্রভৃতিও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী রমেশ পোখরেলের বক্তব্য, ‘নতুন শিক্ষানীতি ২০২০-এ বিশেষ জোর দেয়া হয়েছে যে, আমাদের নিজেদের ভারতীয় হওয়ার বিষয়ে গর্ব হওয়া উচিত। মাদরাসাগুলোতে রামায়ণ পড়ানো সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশের পর অবশ্য শিক্ষামন্ত্রী এই বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন যে, এনআইওএস কর্তৃক মঞ্জুরকৃত মাদরাসাগুলোতে যেখানে বিভিন্ন ঐচ্ছিক কোর্স পড়ানো হয়, সেখানে তাদের ওপর চাপ নেই যে, তারা ওই কোর্সই পড়াবে। সেন্টার ফর এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ ট্রেনিং (সিইআরটি) এই পদক্ষেপের সমালোচনা করে বলেছেন, ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম বা ভারতীয় জ্ঞান পরম্পরার আওতায় ইয়োগা, সংস্কৃত, রামায়ণ ও ভগবতগীতা শিক্ষা ভারতীয় সাহিত্য ও ইতিহাসের একতরফা কল্পনা এবং ভারতের মতো বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির ঐক্যের জন্য ভয়ঙ্কর। সেন্টারের পরিচালক ফুয়াদ শাহীনের বক্তব্য, ‘ভারতীয় শিক্ষাকে কোনো একটি ধর্মের সাথে জুড়ে দেয়া সাংবিধানিক ধারা পরিপন্থী।’

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ৭ মার্চ, ২০২১ হতে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


আরো সংবাদ



premium cement