১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফিলিস্তিন ও ইসরাইল

আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজম - ছবি সংগৃহীত

চৌধুরী সাহেব অতুলনীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। ইংরেজি, উর্দু ও পাঞ্জাবি সাহিত্যে তার দক্ষতা তার সাথে বৈঠক ও মাহফিলকে এতটাই মনোমুগ্ধকর বানিয়ে দিত যে, মাহফিল থেকে উঠে আসা কঠিন হয়ে যেত। হাজার হাজার কবিতা তার মুখস্থ। কিছু কথা তিনি মাহফিলে বলতেন না, নির্জনে বলতেন। একবার চৌধুরী সাহেব আমাকে বললেন, ‘জেনারেল জিয়াউল হকের শাসনামলে তিনি ফিলিস্তিন স্বাধীনতা সংগঠনে যোগ দেন। শুধু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা নয়, বরং পাকিস্তানের স্বাধীনতাও উদ্দেশ্য ছিল। কিছু দিন পর তিনি অনুভব করলেন, জেনারেল জিয়ার মার্শাল ল’র মোকাবেলা সশস্ত্র আন্দোলনের মাধ্যমে নয়, বরং রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে করা উচিত। তিনি পাকিস্তান ফিরে এলেন। তিনি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন এবং জাতীয় অ্যাসেম্বলির সদস্য হলেন।’

পিএলও-এর সাথে অতিবাহিত দিনগুলোর কাহিনী তিনি বর্তমানে প্রকাশ্যে আনতে চাচ্ছেন না। কেননা তার পরিবার রাজনীতিতে রয়েছে। তবে তিনি বলেন, একদিন আমি এ কাহিনী অবশ্যই সামনে আনব। কেননা আমি একাই পিএলওতে যাইনি। অনেক পাকিস্তানি পিএলওতে যোগ দিয়েছিলেন এবং শহীদও হয়েছেন। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার জন্য এসব পাকিস্তানির আত্মত্যাগের কাহিনী একটি কলাম পড়ে আমার মনে পড়ল।

ওই কলামে বেশ কটাক্ষ করে বলা হয়েছে, ‘আমরা পাকিস্তানিরাও বেশ মজার জাতি। আমরা ফিলিস্তিনিদের ভালোবাসায় ইসরাইলকে স্বীকৃতিও দিইনি, আবার আমরা সক্রিয়ভাবে আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য কিছুই করিনি। আপনারা ইতিহাস বের করে দেখুন, আমাদের কোন প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিন গেছেন? অথবা আমরা আজ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের জন্য কোন ত্যাগটা করেছি?’ কলাম লেখক এ কথা ভুলে গেছেন যে, ফিলিস্তিন ইসরাইলের অবরোধে রয়েছে। ১৯৯৪ সালে প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো বসনিয়ার পর গাজা সফর করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিসরের প্রশাসন যখন তাকে বলল, গাজা যেতে হলে ইসরাইলের অনুমতি নেয়া জরুরি। তখন তিনি ফিলিস্তিন সফরের ইচ্ছা স্থগিত করলেন। কলাম লেখক ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদানের পক্ষে বেশ বিস্ময়কর ও হাস্যকর যুক্তি উত্থাপন করেছেন। আর এ ব্যাপারে ভদ্রোচিতভাবে জ্ঞানগত ও যুক্তিগত প্রমাণ উপস্থাপনের পরিবর্তে ফিলিস্তিনের ব্যাপারে আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের চিন্তাভাবনার উদ্ধৃতি প্রদানকারীদের বিদ্রূপ করেছেন।

ফিলিস্তিনের ব্যাপারে আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের বাণী ও বক্তৃতার কথা সবচেয়ে বেশি উল্লেখ তো আমি করেছি। যদি এই অপরাধের কারণে কলাম লেখক আমার ব্যক্তিত্ব নিয়ে সমালোচনা করতেন, তাহলে আমি এটাকে খারাপভাবে নিতাম না। তিনি আমার নাম উল্লেখ না করে আমাকে তো ভর্ৎসনা করেছেন, কিন্তু পাকিস্তানের দুই প্রতিষ্ঠাতার ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘আমাদের কাছে দলিল-প্রমাণ শেষ হয়ে গেলে আমরা কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ইস্যুতেও ইসলাম ঢেলে দিই। আর যদি ইসলাম প্রয়োগ করতে না পারি, তাহলে আমরা সেখানে আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমকে ঢেলে দিয়ে অন্যদের মুখ বন্ধ করে দিই। আমরা এ কীর্তিনামা প্রয়োগের সময় ভুলে যাই যে, আল্লামা ইকবাল জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা সত্ত্বেও ‘স্যার’ খেতাব গ্রহণ করেছিলেন। আর কায়েদে আজম ১৯৪৭ সালে সেই ব্রিটিশ রাণীর দস্তখতের দ্বারা পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হয়েছিলেন, যিনি ফিলিস্তিন দখল করে রেখেছিলেন।’

প্রথমে এ নিবেদন করছি, জেনারেল ইয়াহইয়া খানের শাসনামলে জর্দান সরকারের অনুরোধে ফিলিস্তিনিদের বিদ্রোহকে দমনের জন্য বাস্তবিকই ব্রিগেডিয়ার জিয়াউল হকের (পরে জেনারেল হন) সাহায্য নেয়া হয়েছিল। আর আমি বেশ কয়েকবার এ ঘটনার নিন্দা করেছি। কিন্তু আমাদের নিজেদের মর্জিমাফিক ইতিহাস পাঠদানকারী এ কথা কেন বলেন না যে, ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে পাকিস্তান এয়ারফোর্স জর্দান ও ইরাকের আকাশসীমায় কয়েকটি ইসরাইলি বিমান ধ্বংস করেছিল। ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একটি পূর্ণ স্কোয়াড্রন সিরিয়া পাঠান। ওই স্কোয়াড্রনের পাকিস্তানি জানবাজরা শুধু সিরিয়া নয়, বরং মিসরের আকাশসীমাতেও ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করেন এবং পুরো আরব জাহান থেকে বাহবা পান। এটা কি আরবদের জন্য সক্রিয় সাহায্য ছিল না? ১৯৪৭ সালে লাহোরে অনুষ্ঠিত ইসলামী নেতৃবৃন্দের কনফারেন্সে ইয়াসির আরাফাতকে হিরো বানিয়ে উপস্থাপন করা হয় এবং ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবি করা হয়। এটা কি ফিলিস্তিনিদের জন্য সক্রিয় সাহায্য ছিল না? ফয়েজ আহমদ ফয়েজ তার বার্ধক্যের শেষ কয়েক বছর পিএলও’র সাথে বৈরুতে কাটান এবং ফিলিস্তিনিদের জন্য কবিতা লেখেন। এটা কি এমন একজন পাকিস্তানির ফিলিস্তিনের জন্য সক্রিয় আন্দোলন ছিল না, যাকে পাকিস্তানে ‘গাদ্দার’ বলা হয়েছিল?

এখন আসুন আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের ওপর আরোপিত অভিযোগের প্রতি। আমি বেশ ভালো করেই জানি যে, অনেক শক্তিধর ও প্রভাবশালী ব্যক্তি ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে নিজে সামনে এসে বলার পরিবর্তে মিডিয়ার কিছু লোককে ব্যবহার করছেন। দুঃখ হলো, আল্লামা ইকবাল ও কায়েদে আজমের উল্লেখে তাদের বেশ ক্ষোভ চলে আসে। আর এখন ওই দুই সম্মানিত ব্যক্তিত্বকে বিতর্কিত বানিয়ে নিজেদের পসরা বেচার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যাতে কিছু আরব বাদশাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। ধন্যবাদ, সৌদি আরব স্পষ্ট ঘোষণা করেছে যে, যতক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধান না হবে, ইসরাইলকে মেনে নেয়া হবে না। এ বিবৃতি না এলে আশঙ্কা ছিল, পাকিস্তানে ইসরাইলবিরোধীদের জেলে ঢুকিয়ে দেয়া হতো।

এ কথা বলা যে, আল্লামা ইকবাল জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা সত্ত্বেও ‘স্যার’ খেতাব গ্রহণ করেছেন। এটা নতুন কোনো অভিযোগ নয়। আল্লামা ইকবাল জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার বিরুদ্ধে ৩০ নভেম্বর, ১৯১৯ লাহোরের মোচি গেটে অনুষ্ঠিত সমাবেশে বক্তৃতাও করেছেন এবং ওই ঘটনার ওপর কবিতাও রচনা করেছেন যার আলোচনা আমি ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘আল্লামা ইকবাল নিয়ে কিছু কথা’ (দৈনিক নয়া দিগন্তে প্রকাশ ২৯ জুন, ২০১৪) কলামে উল্লেখ করেছি। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা ঘটেছে ১৯১৯ সালে। আর আল্লামা ইকবাল স্যার খেতাব গ্রহণ করেন ১৯২৩ সালে। ওই খেতাবের কারণ ছিল তার রচনা ‘আসরারে খুদী’, যা ইংরেজদের বিরুদ্ধে সমালোচনায় ভরপুর ছিল। ওই খেতাবের কারণে ইকবালের চিন্তা-দর্শনে কোনো পরিবর্তন আসেনি। বরং ১৯৩০ সালে তিনি মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের দাবি উত্থাপন করেন। ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা আল্লামা ইকবালের ওপর আরোপিত অপর অভিযোগগুলোর জবাবের জন্য প্রফেসর ড. আইউব সাবেরের ‘ইকবাল কী শাখসিয়্যাত আরো ফিকর-ও-ফান পার এতেরাযাত কা জায়েযা’ (ইকবালের ব্যক্তিত্ব ও চিন্তা-দর্শনের ওপর আপত্তিগুলোর পর্যালোচনা) অবশ্যই পড়ে নেবেন। আর কায়েদে আজমের ব্যাপারে এ কথা বলা- ‘তিনি ব্রিটেনের রাণীর স্বাক্ষরে গভর্নর জেনারেল হওয়া কেন গ্রহণ করলেন?’-একেবারে দুর্বল যুক্তি।

আসল কথা হচ্ছে, কায়েদে আজম ও তার মুসলিম লীগ ১৯১৭ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত লাগাতার ফিলিস্তিনের সমর্থন করেছেন এবং ১৯৩৮ সালের ২৬ আগস্টের দিনকে ‘ফিলিস্তিন দিবস’ হিসেবে পালন করেছেন। বিস্তারিত তথ্যের জন্য মুনীর আহমদ মুনীর রচিত ‘কায়েদে আজম, এতেরাযাত আরো হাকায়েক’ (কায়েদ আজম, অভিযোগ ও বাস্তবতা) এবং শাহেদ রশীদ রচিত ‘আফকারে কায়েদে আজম’ (কায়েদে আজমের চিন্তাধারা) গ্রন্থগুলো পড়ুন। যারা জিজ্ঞাসা করেন, ‘প্লিজ বলুন, পাকিস্তান ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন না করে কী পেয়েছে?’, তারা আমাদের এ কথা বলুন, তুরস্ক, মিসর ও জর্দান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে কী পেয়েছে?’ বারবার স্পষ্ট করে দিয়েছি, ইসরাইলের সমালোচনার অর্থ, ইহুদিদের সাথে শত্র“তা নয়। অনেক ইহুদিও ইসরাইলের সমালোচনা করে থাকেন। আমরা ফিলিস্তিনের সমর্থন এ জন্য করি, তারা কাশ্মিরিদের মতো মজলুম। যদি আমরা ফিলিস্তিনকেন্দ্রিক জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলি উপেক্ষা করে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিই, তাহলে কাশ্মিরকেন্দ্রিক জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলির ব্যাপারে পাকিস্তানের অবস্থান শেষ হয়ে যাবে। এ জন্য যতক্ষণ ইসরাইল জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবাবলি কার্যে পরিণত না করবে, ততক্ষণ তাকে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না।

পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০ থেকে উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব

ahmadimtiajdr@gmail.com

লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)


আরো সংবাদ



premium cement