২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`
বাংলাদেশে নতুন লকডাউন

দুর্দান্ত কোনো ফলাফলের বিষয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা

দুর্দান্ত কোনো ফলাফলের বিষয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা - ছবি - সংগৃহীত

কোভিড-১৯ এর ক্রমবর্ধমান সংক্রমণে লাগাম টানতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে বুধবার থেকে নতুন একটি লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নের প্রস্তুতির অভাবে এই লকডাউনে কোনো দুর্দান্ত ফল লাভের সম্ভাবনা নেই।

তারা বলছেন, লকডাউনের সময় নিয়মিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন করে জনগণকে জোরপূর্বক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং বাড়ির অভ্যন্তরে থাকতে বাধ্য করে 'কারফিউ জাতীয়' পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা লকডাউনের সময় কল-কারখানাগুলো খোলা রাখার বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতাও করেছেন। কারণ তারা আশঙ্কা করছেন এতে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত থাকবে।

তারা বলছেন, লকডাউন কার্যকর করার আগে সরকারের উচিত হতদরিদ্র, দিনমজুর ও বস্তিবাসীদের জীবন চালাতে খাদ্যের ব্যবস্থার জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরবরাহ করা।

৫ এপ্রিল থেকে প্রায় সবকিছু খোলা রেখে এক সপ্তাহের জন্য দেশব্যাপী লকডাউন কার্যকর করা হয়েছিল। আর এই লকডাউনের কোনো ইতিবাচক প্রভাব দৃশ্যমান নয়। কারণ দেশে এই সময়ে ৪৭ হাজার ৫১৮ জন নতুন করে আক্রান্ত হয় এবং ৫০৪ জনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভাইরাসের সংক্রমণ ও প্রাণহানির সাপ্তাহিক বৃদ্ধি সর্বোচ্চ দেখা গেছে।

এমন পরিস্থিতিতে বুধবার থেকে সকল অফিস এবং গণপরিবহন বন্ধ করে সাত দিনের কঠোর লকডাউন কার্যকর করার জন্য সরকার সোমবার নতুন কতগুলো নির্দেশনা জারি করে। তবে, লকডাউনের সময় কারখানাগুলো খোলা থাকবে।

লকডাউনের প্রস্তুতি

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নাজির আহমেদ বলেন, লকডাউন কঠোরভাবে বাস্তবায়নের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন।

তিনি বলেন, `বড় সমস্যা হলো সরকার কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই আবারও লকডাউন বাস্তবায়ন করতে চলেছে। আপনি ১৭ কোটি লোককে সাত দিনের জন্য বাড়ির ভিতরে রাখতে চাইলে অনেক প্রস্তুতি নেয়াও জরুরি। এর সফল বাস্তবায়নের জন্য এমন পদক্ষেপে বিপুল সংখ্যক লোককে ব্যস্ত থাকার কথা।'

এই বিশেষজ্ঞ জানান, প্রতিটি এলাকায় অস্থায়ী দোকান তৈরি করা উচিত ছিল যাতে মানুষ রমজান মাসে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সেখান থেকে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে সংগ্রহ করতে পারে।

তিনি বলেন, প্রণোদনার মাধ্যমে স্বল্প আয়ের লোকদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে এবং বাড়িতে থাকতে উৎসাহিত করা উচিত ছিল।

`একজন বস্তির বাসিন্দা প্রতিদিন রোজগার না করে বাঁচতে পারে না। আমাদের প্রয়োজন হতদরিদ্র মানুষের তালিকা তৈরি করা এবং তাদের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সরবরাহ করা যেন তাদের লকডাউনে জীবিকার জন্য বাইরে যেতে না হয়।'

পাশাপাশি, বে-নাজির বলেন, কোভিড-১৯ রোগীদের পরিবারের সদস্যদের আইসোলেশন নিশ্চিত করতে এবং সরকারকে এর নির্দেশনা এবং বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সহায়তা করতে প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসেবীর একটি দল থাকতে হবে।

'আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারের কোনো প্রস্তুতি এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনা নেই। এ কারণেই তারা উপযুক্ত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ব্যতীত খামখেয়ালী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে এবং লকডাউন কার্যকর করতে যাচ্ছে।

ভাইরাস সংক্রমণের চক্র ভাঙতে হবে

ডা. বে-নাজির বলেন, ভাইরাসের সংক্রমণ কমিয়ে আনতে জরুরি স্বাস্থ্য বা একটি কঠোর লকডাউন কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য প্রয়োগ করা উচিত।

তিনি বলেন, `গত সাতদিন ধরে দেশে যে ঢিলেঢালা লকডাউন কার্যকর ছিল তা ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ বলে মনে হচ্ছে। বরং, আমরা একটি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে এগুচ্ছি। দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটি অত্যন্ত মারাত্মক যা বর্তমানে দেশে অধিক হারে ছড়িয়ে পড়েছে। কারণ এই ধরনটি আক্রান্ত মানুষের ফুসফুসকে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। আর এজন্যই মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে।'

এই বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, জনসাধারণের চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করে ভাইরাস সংক্রমণে বিদ্যমান চক্রটি ভাঙা যায় না। 'আমরা যদি আমাদের জনগণকে কমপক্ষে ১৪ দিনের জন্য বাড়িতে রাখতে পারি তবে ভাইরাসের সংক্রমণ অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।'

পাশাপাশি, তিনি বলেন, সংক্রমিত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের আইসোলেশন নিশ্চিত করাও জরুরি।

জনগণের `বেপরোয়া মনোভাব' বড় উদ্বেগের বিষয়

জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, `সরকার প্রথমে প্রায় সবকিছু খোলা রেখে একটি লকডাউন প্রয়োগ করেছিল এবং এখন কল-কারখানার কার্যক্রম চালু রেখে আরো এক সপ্তাহের লকডাউন কার্যকর করতে চলেছে। আমার এই ধরনের আংশিক লকডাউনের সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহ আছে।’

এই বিশেষজ্ঞ বলেন, সরকার লকডাউন শব্দটি ব্যবহার করছে তবে এটি বাস্তব অর্থে প্রয়োগ করছে না। ‘লকডাউন মানে কিছু জরুরি পরিষেবা বাদে সবকিছু বন্ধ থাকবে এবং জরুরি অবস্থা ছাড়াই কাউকে বাইরে যেতে দেয়া হবে না।’

তিনি বলেন, লকডাউনের প্রথম সপ্তাহে সবকিছুই কমবেশি স্বাভাবিক ছিল।

‘এটি মানুষের কাছে একটি নেতিবাচক বার্তা প্রেরণ করেছে এবং তারা সরকারের নির্দেশাবলী এবং লকডাউন মেনে চলার প্রতি উদাসীনতা দেখাতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে,’ বলেন তিনি।

সেনাবাহিনী ও বিজিবি মোতায়েন

অধ্যাপক নজরুল বলেন, সরকার জনগণকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক পরতে বাধ্য করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে যেকোনো জনসমাগম এড়ানোর বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া উচিত। 'প্রয়োজনে লকডাউনটি কার্যকর করার জন্য সরকারকে অবশ্যই সেনাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন করতে হবে।'

আটটি বিভাগের জন্য সরকার কর্তৃক গঠিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ড. আবু জামিল ফয়সাল বলেন, ৫ এপ্রিল থেকে যেভাবে লকডাউন কার্যকর করা হয়েছে তার কারণে জনগণ লকডাউনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। 'এখনও জনগণের অপ্রয়োজনীয় চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যদি সেনাবাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় টহল দেয়া শুরু করে এবং সরকারের নির্দেশ অমান্যকারীদের শাস্তি দেয়।’

'আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, লকডাউন কঠোরভাবে কার্যকরের জন্য সেনাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতা জরুরি। ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে আমরা গত বছর সেনাবাহিনীর সহযোগিতা পেয়েছিলাম। সুতরাং, আমরা এবার তাদের লকডাউন কার্যকরে জড়িত করতে পারি।'

হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এম এইচ চৌধুরীও (লেনিন) মনে করেন, সেনাবাহিনী ও বিজিবির সদস্যদের মোতায়েন করে কারফিউ’র মতো পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত যেন জনগণ কোনো জরুরি প্রয়োজন ছাড়াই বাসা থেকে বের না হয়।

কারখানা খোলা রাখা একটি 'ভুল পদক্ষেপ'

লেনিন বলেন, সরকারের বিধিনিষেধের সাফল্য সেগুলোর বাস্তবায়নের ওপর নির্ভর করে।

'সরকার দেশকে লকডাউনের আওতায় আনার জন্য সোমবার নতুন নির্দেশনা জারি করেছে। তবে আমরা নিশ্চিত নই যে তারা সেগুলো যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারে কি না। সরকার কেন লকডাউনে কলকারখানা খোলা রাখার অনুমতি দেয় তা নিয়েও একটি প্রশ্ন রয়েছে।'

প্রচুর সংখ্যক মানুষ কারখানায় যাবে এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে যোগ দিতে বাড়ি ফিরে যাবে। এভাবে ভাইরাসটি ছড়ানোর সুযোগ দেবে। 'তাই, আমি মনে করি এটি একটি ভুল সিদ্ধান্ত। ভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সাফল্য পেতে কমপক্ষে দুই-তিন সপ্তাহ ধরে সবকিছু বন্ধ রেখে একটি সর্বাত্মক লকডাউন কার্যকর করা উচিত।'

জনপ্রতিনিধিদের জড়িত করা

অধ্যাপক নজরুল বলেন, সরকারের উচিত মেয়র, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও সদস্যদের মতো জনগণের প্রতিনিধিদের দুস্থদের তালিকা তৈরি ও তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সরকারি এবং বেসরকারি ও সামাজিক সংস্থার সহায়তায় সংযুক্ত করা।

তিনি বলেন, লকডাউন কার্যকর করতে এবং জনসাধারণের অপ্রয়োজনীয় চলাচল বন্ধ করতে প্রতিটি এলাকায় একটি মনিটরিং টিম গঠন করা উচিত।

এছাড়াও এই বিশেষজ্ঞ বলেন, স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে জনগণ কীভাবে খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করবে সে সম্পর্কেও একটি স্পষ্ট নির্দেশনা থাকা উচিত।

সূত্র : ইউএনবি

 


আরো সংবাদ



premium cement