১৭ মে ২০২৪, ০৩ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫
`


মালয়েশিয়ায় ৩০ হাজার প্রবাসী কর্মীর চাকরি নেই

হাইকমিশনে লিখিত অভিযোগ দিয়েও সুরাহা হয়নি
-


বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমানোদের মধ্যে ২৫-৩০ হাজার শ্রমিক চুক্তি অনুযায়ী কাজ পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের বেশির ভাগ বর্তমানে থাকা-খাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিনিয়ত মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। শুধু তা নয়, অনেকে আবার উপায় না পেয়ে দেশ থেকে টাকা নিয়ে দৈনন্দিন চাহিদাও মেটাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ দিকে যেসব শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গিয়ে কাজ না পেয়ে মাসের পর মাস বেকার সময় কাটাচ্ছেন ইতোমধ্যে তাদের কারো কারো পরিবারের পক্ষ থেকে ঢাকা ও কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনে দেশটির নিয়োগকর্তা এবং দুই দেশের এজেন্টের নাম ঠিকানা উল্লেখ করে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ কর্মীর অভিযোগের সুরাহা অদ্যাবধি বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কল্যাণ উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা করতে পারেননি। যার ফলে দেশটির বনজঙ্গলসহ নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকাদের ভোগান্তি প্রতিনিয়ত আরো বাড়ছে।

গত সপ্তাহে মালয়েশিয়া থেকে একজন বাংলাদেশী ব্যবসায়ী নয়া দিগন্তের এই প্রতিবেদকের মোবাইলে (হোয়াটসঅ্যাপে) একটি ভিডিও লিংক পাঠান। ওই ভিডিও লিংকের মধ্যে দেখা গেছে, শত শত শ্রমিক একটি খোলা মাঠের মধ্যে অবস্থান করছেন। তাদের অনেকের পাশে রাখা লাগেজ, ব্যাগ। অদূরে থাকা একটি মাইক্রোবাস থেকে শ্রমিকদের প্যাকেট খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। এ সময় একজন শ্রমিককে ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, ‘আমরা বিএম ট্র্যাভেলস থেকে এখানকার একটি কোম্পানিতে (কোম্পানীর নাম অস্পষ্ট) আসছি। ৪ মাস যাবৎ মালয়েশিয়াতে। আমাদের অবস্থা খুব খারাপ। আমরা ঠিকমতো খাবার দাবার এবং ঠিকমতো কাজ পাইনি। আমাদের যে অবস্থা, দেখেন দুই দিন পর আমাদেরকে খাবার দিছে, এই কয়টা খাবার (অল্প ভাত-একটি পিছ মাছ ও ঝোল)। এই খাবার খেয়ে আমরা কি করব? আমরা মালয়েশিয়াতে আসছি পাঁচ লাখ টাকা দিয়্যা। আমাদের যে অবস্থা আমাদের জীবনমরণ নিয়ে খেলা করতেছে। আমাদের কোম্পানি বিএম ট্র্যাভেলসকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে এখানে আইছি। আমাদেরকে কি মাইর‌্যা ফেলবে? আমাদের বলে আইজ-কালের ভেতর কাজ দেবো। কিন্তু কাজ দেয় না। প্রতিদিন আমাদের ঘুরাচ্ছে। আমরা এই অবস্থায় আছি। বিএম ট্র্যাভেলস কিছুই করতেছে না। অ্যাম্বাসিতে যাইতে চাইছিলাম। বাট পুলিশ-কোম্পানির লোক এসে আমাদের অবস্থা খারাপ করে দিছে। দেখেন খাবার নিয়ে মারামারি। কি একটা অবস্থা। জীবন একবারে শেষ করে দিছে। কি বলব আমরা। দেখেন, আপনারা যদি আমাদের পাশে না আসেন তাহলে কেমনে কি করব। একটু সহযোগিতা করেন। আমরা এইভাবে চলতে পারছি না। না খেয়ে, না খেয়ে মরতেছি। প্রত্যেকটা লোক অ্যাম্বাসিতে যাইতে চাইছি। কিন্তু যাইতে দিচ্ছে না। পুলিশ আমাদের আটকাই ফালাইছে। কোম্পানি বলতেছে আজ তোমরা থাক, দিনের মধ্যে কাজ দেবো। এর আগে প্রতিদিন ডেট দিছে। বিএম ট্র্যাভেলস আমাদের নিয়ে এসে জীবন-সংসার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে।’

পাঠানো ওই ভিডিওতে কর্মীদের সমস্যার কথা বিস্তারিত থাকলেও ভিডিওটি কবেকার বা মালয়েশিয়ার কোন এলাকা থেকে করা হয়েছে সেটি ওই শ্রমিকের মুখ থেকে শোনা যায়নি। আর শুধু বিএম ট্র্যাভেলস নয়, ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ায় শ্রমিক পাঠানো অধিকাংশ রিক্রুটিং এজেন্সির শ্রমিকরা (বিশেষ করে কনস্ট্রাকশন, ক্লিনিং) চাকরি না পেয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
গতকাল সোমবার সন্ধ্যার পর রিক্রুটিং এজেন্সি বিএম ট্র্যাভেলস নামক প্রতিষ্ঠানের অফিসের দায়িত্বশীলদের সাথে যোগাযোগ করার পরও তাদের বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের শ্রম কাউন্সিলর শাখার থার্ড সেক্রেটারি সুমন চন্দ্রের সাথে গতকাল রাতে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। যার কারণে এই ডিভিওর লিংক ও অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
মালয়েশিয়া থেকে একাধিক ব্যবসায়ী নাম না প্রকাশ করার শর্তে নয়া দিগন্তকে বলেন, মালয়েশিয়ায় যাওয়া শ্রমিকদের বেকার থাকার অন্যতম কারণ হচ্ছে নিয়োগকারী কোম্পানির সার্বিক খোঁজখবর না জেনে সত্যায়ন করে দেয়া। আরো অভিযোগ রয়েছে, মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাইকমিশনের লেবার উইং বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কর্মচারীদের সত্যায়ন বাণিজ্য আর অনিয়ম দুর্নীতি আর গাফিলতির কারণে মালয়েশিয়ার সম্ভবনাময় শ্রমবাজারটি মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে।

যদিও মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ কমিউনিটির দায়িত্বশীল একজন নেতা গত শুক্রবার বিকেলে নয়া দিগন্তকে শ্রমিকদের কাজ না পাওয়া এবং বিশৃঙ্খলার ব্যাপারে বলেছিলেন, আমার জানা মতে, বাংলাদেশ হাইকমিশন নয়, যারা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রণ করছেন তাদের চাপাচাপির কারণে মালয়েশিয়াতে যাওয়ার পর ২৮-৩০ হাজার শ্রমিক জবলেস অবস্থার মধ্যে আছে। তাদের বেশির ভাগই কনস্ট্রাকশন ও ক্লিনিং কোম্পানির শ্রমিক। বরং হাইকমিশন সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ পাওয়ার পর ২৮ হাজারের মতো কর্মীর সত্যায়ন দেয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু ঢাকা থেকে উপরের চাপের কারণে হাইকমিশনের মিনিস্টার (শ্রম) নাজমুছ সাদাত এসব ফাইল ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

গতকাল রাত ৭টার দিকে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালক (ডিডি) ও মালয়েশিয়া চ্যাপ্টারের বহির্গমন শাখার অন্যতম কর্মকর্তা মো: সাজ্জাত হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমার কাছে এই মুহূর্তে মালয়েশিয়াগামী কর্মীর সঠিক তথ্য নেই। তবে সম্ভবত চার লাখ বা চার লাখ পাঁচ হাজারের মতো হতে পারে। বিএম ট্র্যাভেলস নামক প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা মালয়েশিয়ায় গিয়ে চার মাস ধরে কাজ পাচ্ছেন না- এমন ভিডিও লিংক পাঠানোর বিষয়ে অবগত করলে তিনি সংশ্লিষ্ট এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে সঠিক বক্তব্য নেয়ার অনুরোধ জানান। এরপর তিনি বলেন, আমার জানা মতে, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারটি সুন্দরভাবেই তো চলছে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে দেশটিতে কর্মীরা যেতে পারছে। যারা গেছেন তারা ভালো আছেন। আর যারা কাজ পাননি তাদের পক্ষ থেকে দু-চারটি অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। এর বিপরীতে এজেন্সি কী ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে সেটি আমাদের পক্ষ থেকে জানার চেষ্টা এবং সমাধান করা হচ্ছে। তবে মার্কেটটি টিকিয়ে রাখতে আমাদের হাইকমিশন, এজেন্সিসহ সবাইকে সম্মিলিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। ৩০ হাজার শ্রমিক এখনো জবলেস রয়েছে- এমন এক প্রশ্নের উত্তরে সাজ্জাদ হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, কিছু অভিযোগ আছে। এটা সঠিক। তবে এত শ্রমিক হবে না বলে তিনি মন্তব্য করেন।
গতকাল ঢাকার একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক নয়া দিগন্তকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার সম্পর্কে আক্ষেপ করে বলেন, আমার জানা মতে, মালয়েশিয়ার কনস্ট্রাকশন সেক্টরের কর্মীরা বেশ বিপদের মধ্যে আছেন। কেউ বললে বিশ্বাস করবেন না, বেতন পরের কথা। কোনো কোনো কর্মীকে আমরা ঢাকা থেকে এখন টাকা পাঠাচ্ছি প্রতিদিনের খাবারের জন্য।


আরো সংবাদ



premium cement