১৬ মে ২০২৪, ০২ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫
`


নৌ অধিদফতরের লাইট হাউজ প্রকল্পে দুর্নীতি

অনুমোদন ছাড়া ঠিকাদারকে সাড়ে ৬ কোটি টাকা বিল পরিশোধ
-


উপকূলীয় এলাকায় রেডিও স্টেশন ও লাইট হাউজ স্থাপন প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। এই প্রকল্পের পরিচালকের (পিডি) বিরুদ্ধে নৌ পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) অনুমোদন ছাড়াই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ছয় কোটি ৩৭ লাখ টাকা বিল পরিশোধের অভিযোগ উঠেছে।
লাইট হাউজ বা বাতিঘর প্রকল্প হিসেবে জনশ্রুত এস্টাবিলিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগেটেড নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস) শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি পিডি ও ঠিকাদারের বিরুদ্ধে এমন তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে।

এ ছাড়া উপ প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ও সহকারী প্রকল্প পরিচালক (এপিডি) এবং নৌ পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের (ডিজি) বিরুদ্ধেও আনা কিছু অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সংশ্লিষ্ট নির্ভরযোগ্য সূত্র এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সঞ্জয় কুমার বণিকের নেতৃত্বে ২৬ এপ্রিল পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এ তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সম্প্রতি নৌ সচিবের কাছে আটটি সুপারিশসহ ৪২২ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দিয়েছে কমিটি। বহুল আলোচিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে নৌ পরিবহন অধিদফতর। এটি বাস্তবায়নের সর্বশেষ বর্ধিত সময়সীমা আগামী বছরের জুন মাস।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ডিজির অনুমোদন না নিয়ে ঠিকাদারের বিল পরিশোধ ছাড়াও পিডির বিরুদ্ধে আইসিটি ইকুইপমেন্ট মোবিলাইজেশনের কাজ শেষ করার আগেই এ খাতের টাকা ব্যয় করার প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের দুবলার চর ও ভোলার চর কুকরি-মুকরিতে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ কাজের বিল পাসের তৎপরতার কথাও উল্লেখ করেছে কমিটি। তদন্ত প্রতিবেদনে ডিপিডিসহ এপিডিদের বিরুদ্ধেও নানা অনিয়মের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে ।

এ ছাড়া পিডির বিরুদ্ধে সমন্বয়হীনতার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সমন্বয়হীনতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘ কালক্ষেপণ হচ্ছে। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নে অচলাবস্থার জন্য পিডি, ডিজি ও ঠিকাদার- তিন পক্ষকেই দায়ী করেছে কমিটি। তারা হলেন- পিডি ও অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান, মহাপরিচালক (সদ্য প্রত্যাহার হয়েছেন) কমোডর মো: নিজামুল হক এবং কোরিয়ান ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহ। তদন্তে তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে আলাদা আলাদা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে সহ-ঠিকাদার নিয়োগ, বেআইনিভাবে দরপত্র প্রক্রিয়াকরণ ও ভীতি প্রদর্শনসহ সাতটি অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। নির্ভরযোগ্য সূত্র মতে, তাকে মহাপরিচালকের দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহারের সুপারিশও করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ দিকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবেদন প্রকাশ করা না হলেও কমোডর নিজামুল হককে ইতোমধ্যে মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহার করে নৌবাহিনীতে ফেরত পাঠিয়েছে সরকার। তার স্থলে প্রেষণে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, নৌবাহিনীতে কর্মরত কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলমকে। রোববার (২১ মে) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পিডি আবু সাইদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের বিরুদ্ধে প্রকল্প বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্টদের সাথে সমন্বয়ের ঘাটতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের কয়েকটি অভিযোগ যাচাইয়ে ‘কারিগরি কমিটি’ গঠনের সুপারিশ করেছে কমিটি। মূল ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এলজি আল সামিহ কনস্ট্রাকশনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
সূত্র মতে, এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে- পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ না দেয়া, সংস্থাপ্রধান, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সাথে সমন্বয়ের অভাব, যথাসময়ে কাজ না করা ইত্যাদি।
এ ছাড়া কয়েকটি কাজের বিল যথাযথ প্রক্রিয়ায় দেয়া হয়েছে কি না এবং কাজের গুণগত মান ঠিক আছে কি না- তা খতিয়ে দেখতে অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ-সংক্রান্ত সুপারিশে বলা হয়, ওই কমিটি এসব ঘটনায় প্রকল্পের কোন কোন কর্মকর্তা দায়ী তা নির্ধারণ করবে।

সূত্র মতে, তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে নৌ মন্ত্রণালয় কমোডর নিজামকে অধিদফতরের মহাপরিচালকের পদ থেকে প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছিল। এরপর তাকে প্রত্যাহারের প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে সরকার। তবে তদন্ত প্রতিবেদনে দায়ী অন্যদের বিরুদ্ধে বিশেষ করে পিডি, ডিপিডি, এপিডি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে সরাসরি কোনো সুপারিশ করা হয়নি। কারিগরি কমিটি গঠন করে এই কমিটির মাধ্যমে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের দায়দায়িত্ব যাচাই-বাছাইয়ের পর তাদের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, তদন্তকালে বিভিন্নজনের মৌখিক (অনানুষ্ঠানিক) জবানিতে ডিপিডি ও এপিডিদের বিরুদ্ধে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে কাজ না করে বিল পরিশোধের নামে প্রকল্পের টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া কমোডর এ জেড এম জালালউদ্দিন নৌ অধিদফতরের ডিজি থাকাকালে তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ-সংক্রান্ত এক বৈঠকে আরো বিস্ময়কর তথ্য উঠে আসে। প্রকল্পের কর্মকর্তাদের কোন কাজে কে কত টাকা ঘুষ দিয়েছেন, তার বর্ণনা রয়েছে। ঘুষ বাবদ টাকা লেনদেনের এ ভয়ঙ্কর বক্তব্য ওই বৈঠকের কার্যবিবরণীতেও স্থান পেয়েছে।

তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে মহাপরিচালক পদ থেকে সদ্য প্রত্যাহার হওয়া কমোডর নিজামুল হক বলেন, বহুল আলোচিত ও জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি যথাসময়ে ও যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য আলাদা দু’টি প্রস্তাব দিয়েছিলাম। একটি হলো- প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতি তদন্তে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন এবং অপরটি হচ্ছে- পিডিকে সরিয়ে দিয়ে এ পদে নতুন কাউকে নিয়োগ। এর সপক্ষে সুনির্দিষ্ট অনেক কারণও উল্লেখ করেছিলাম। তবে নৌ মন্ত্রণালয় আমার প্রস্তাব না মেনে নিজেরা একটি কমিটি গঠন করেছিল, যেখানে অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কোনো প্রতিনিধি নেই। এ ছাড়া পিডিকেও স্বপদে বহাল রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

 


আরো সংবাদ



premium cement