০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,
`

করোনাকালে রেমিট্যান্স বৃদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন : প্রবাহ কমে যাওয়ার শঙ্কা

এসডিজি প্ল্যাটফর্মে ভার্চুয়াল সংলাপ
-

করোনাকালে দেশে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স অনেকটা অস্বাভাবিক পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা নানা কারণ খুঁজে পেয়েছেন। তারা বলেছেন, করোনার সময় বিদেশী শ্রমিক পাঠানোর পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেলেও একই সময় রেমিট্যান্সের একটি উল্লস্ফন লক্ষ করা গেছে। রেমিট্যান্স বাড়ার পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ থাকতে পারে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, সরকার কর্তৃক রেমিট্যান্সের ওপর দুই শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া। তবে এর বাইরে আরো বেশ কয়েকটি কারণ রেমিট্যান্স বৃদ্ধির পিছনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। এর মধ্যে করোনার সময় হুণ্ডি কমে যাওয়া, এ সময় অনেকে বিদেশী চাকরি হারিয়ে তার সবটুকু সম্বল দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আবার সরকারের প্রণোদনা সুযোগ নিয়ে দেশ থেকে কালো টাকা রেমিট্যান্সে মাধ্যমে সাদা হয়ে দেশে ঢুকে থাকতে পারে। তবে বিদ্যমান সময়ে রেমিট্যান্স বাড়লেও আগামী কয়েক মাস এই গতি কমে যেতে পারে বলে তারা মত প্রকাশ করেছেন।
গতকাল ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্ল্যাটফর্ম’ আয়োজিত ‘সাম্প্রতিক রেমিট্যান্স প্রবাহ : এত টাকা আসছে কোথা থেকে’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল সংলাপে এসব কারণ তুলে ধরা হয়। সংলাপে সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
সংলাপে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
তিনি বলেন, করোনাকালীন রেমিট্যান্সপ্রবাহের রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে ছয়টি কারণ থাকতে পারে। এসব কারণের মধ্যে রয়েছেÑ করোনাকালীন আয় কমে যাওয়া ও চাকরির অনিশ্চয়তার কারণে প্রবাসীদের পরিবারের চাহিদা বৃদ্ধি; করোনাকালীন হুণ্ডি তৎপরতা কমে যাওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি; সরকার কর্তৃক দুই শতাংশ প্রণোদনা প্রদানের ইতিবাচক প্রভাব; কোনো ডকুমেন্ট ছাড়া পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত পাঠানো রেমিট্যান্স প্রণোদনার আওতায় আনা যা আগে ছিল দেড় লাখ টাকা; রেমিট্যান্স সরবরাহের ক্ষেত্রে বিকাশসহ অন্যান্য মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস অপারেটরদের এক শতাংশ অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ প্রদান এবং হজ না হওয়ার কারণে হজের জন্য জমিয়ে রাখা অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেয়া ইত্যাদি।
মূল প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যেসব দেশ বা গন্তব্য থেকে সাধারণ সময়ে গড় রেমিট্যান্সপ্রবাহের তুলনায় অধিক পরিমাণে রেমিট্যান্স এসেছে সেখানকার রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের আয়ের উৎস এবং বিদ্যমান আইন যথাযথ প্রয়োগ করা হলে প্রেরিত রেমিট্যান্সের সমপরিমাণ অর্থ পাঠানো সম্ভব হতো কি নাÑ এ বিষয়টি সরকারের গভীরভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। অন্য দিকে যেসব দেশ থেকে প্রবাসীরা সাধারণ সময়ের তুলনায় অধিক রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে ওইসব দেশের কোনো আর্থিক সীমা আছে কি না এবং করোনাকালীন সময়ে তা শিথিল করা হয়েছে কি নাÑ এটিও একটি প্রশ্ন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালীন গত ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ায় রেমিট্যান্সপ্রবাহের পরিমাণ প্রায় ২২ দশমিক এক শতাংশ হ্রাস পেতে পারে বলে বিশ্বব্যাংকের এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল। কিন্তু এটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের গড় প্রবাহের পরিমাণ জিডিপির সাত দশমিক এক শতাংশ। গত বছর (২০২০ সাল) এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক চার শতাংশ। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধির হার ৩৫ শতাংশ। অন্য দিকে গত বছর পাকিস্তানে রেমিট্যান্সপ্রবাহ দাঁড়িয়েছে জিডিপির ১৬ দশমিক সাত শতাংশ ও শ্রীলঙ্কার চার শতাংশ। অন্য দিকে ভারতের রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমেছে ৩২ দশমিক তিন শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা পরিস্থিতিতে রেমিট্যান্সপ্রবাহের ঊর্ধ্বগতি সরকারের কাছে ছিল একটি বড় ধরনের স্বস্তি। এর ফলে করোনাকালীন প্রবাসীদের পরিবারগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী আর্থিক সরবরাহ বেড়েছে। এ ছাড়া বৈদেশিক রিজার্ভ, অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার ক্ষেত্রে রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। তবে অতিরিক্ত রেমিট্যান্সপ্রবাহের কারণে চলতি অর্থবছরে প্রণোদনা বাবদ সরকারকে আরো এক হাজার ৩০০ কোটি টাকা অধিক ব্যয় করতে হতে পারে। চলতি বাজেটে এ খাতে তিন হাজার ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ইতোমধ্যে এর ৭০ শতাংশ ব্যয় হয়ে গেছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সেন্টার ফর নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশীদের (এনআরবি) চেয়ারপারসন এম এস শেকিল চৌধুরী বলেন, একটি সময় হুণ্ডির মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণ বিদেশী অর্থ দেশে আসত। কিন্তু সেটাও এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। আবার প্রবাসীরা প্রতি বছর দুই থেকে একবার দেশে আসার সময় অনেক ক্যাশ টাকা বয়ে আনতেন। এখন সেটার প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে দুই শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। তবে তিনি বলেন, আগামী কয়েক মাস পর রেমিট্যান্সে এই প্রবাহ অব্যাহত নাও থাকতে পারে।
রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রিটিং মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন অধ্যাপক তাসনীম সিদ্দিকী বলেন, রেমিট্যান্সের ঊর্ধ্বগতি মানে প্রবাসীরা ভালো আছেন এটা ভাবা উচিত নয়। কারণ আমাদের জরিপ বলছে, প্রবাসী অনেকে এখন ভালো অবস্থায় নেই। তাদের মধ্যে অনেকে দেশ থেকে টাকা নিয়ে নিজেদের জীবন নির্বাহ করছেন। আমরা জরিপ করে দেখেছি, করোনার সময় ৬১ শতাংশ পরিবার বিদেশ থেকে কোনো রেমিট্যান্স পাননি। ৩৯ শতাংশ বলেছেন, তারা রেমিট্যান্স পেয়েছেন।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, প্রবাসী আয়ের ওপর সরকারি দুই শতাংশ প্রণোদনা যদি আরো কিছুটা বাড়ানো যায় তবে এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে। এ রকম প্রণোদনা যদি পোশাক খাতের জন্য করতে পারি তাহলে আমরা আরো লাভবান হতে পারব। ইতোমধ্যেই ফিরে আসা বাংলাদেশীদের জন্য ২০০ কোটি টাকার তহবিল গঠন করেছেন প্রধানমন্ত্রী। যে টাকাগুলো ঋণ হিসেবে বিতরণ করা হবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে। তিনি আরো বলেন, এটা নিয়ন্ত্রণ করবে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু ব্যাংকটির যথেষ্ট লোকবল এবং অবকাঠামোর অভাবে টাকাগুলো এই মুহূর্তে বিতরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এটা নিয়ে মন্ত্রণালয় কাজ করছে। ফিরে আসা বাংলাদেশীদের কাজে লাগাতে মাত্র চার শতাংশ সুদে সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জামানতবিহীন এই ঋণের ব্যবস্থা করছে সরকার।
সমাপনী বক্তব্যে দেবপ্রিয় বলেন, পরিশ্রমী এসব মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা না গেলে সমস্যায় পড়বে বাংলাদেশ। কারণ কর্মসংস্থানের ওপর ভিত্তি করেই বৈশ্বিক উন্নয়ন কর্মসূচি অর্জন নির্ভর করছে। অনেকেই বলছেন, রেমিট্যান্সের প্রবাহ ২০২১ সালে শেষ পর্যন্ত চলতে পারে আবার কারো কারো মতে অব্যাহত থাকবে এই প্রবৃদ্ধি।
তিনি আরো বলেন, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে ২০০ কোটি টাকা বিতরণ কার্যক্রম নেয়া হয়েছে তার মধ্যে মাত্র কয়েক লাখ টাকা বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। নানা অসুবিধার কারণে প্রবাসীদের কাছে টাকা পৌঁছাতে পারছে না তারা। এখন প্রশ্ন উঠেছে, কেন অন্য কোনো শিডিউল ব্যাংকের মাধ্যমে এই ঋণ বিতরণ করা হবে না।


আরো সংবাদ



premium cement