২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`


রসুলের সা: রওজা জিয়ারত করলেই শাফায়াত ওয়াজিব?

- ছবি : সংগৃহীত

কবিরাগুনাহকারী এবং পাপের কারণে যাদের শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে তাদের জন্য হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াত অবধারিত। রসুলের রওজা মুবারক জিয়ারত করলে তার জন্য রসুলের শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যায়। মাদরাসার পাঠ্যবইয়ে লেখা হয়েছে এ ধরনের কথা।

মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণীর জন্য পাঠ্য ‘আকাইদ ও ফিকহ্’ বইয়ের ৭ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম হলো ‘আখেরাতে নবী সা:-এর শাফায়াত’। এখানে লেখা হয়েছে- নবীগণের শাফায়াত সত্য। পাপী মুমিনরা এবং কবিরা গুনাহগারীগণের জন্য পাপের কারণে যাদের শাস্তি অপরিহার্য তাদের জন্য কেয়ামতের দিন আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শাফায়াত করবেন।

৭২ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে- আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আমার উম্মতের কবিরা গুনাহকারীদের জন্য আমার শাফায়াত অবধারিত।

মাদরাসায় নবম-দশম শ্রেণীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যবইয়ের নাম ‘আকাইদ ও ফিকহ্’। এ বইয়ের ১৩৩ পৃষ্ঠার একটি পাঠের শিরোনাম হলো নবী করিম সা:-এর রওজা মুবারক জিয়ারতের ফজিলত। এখানে লেখা হয়েছে ‘নবী করিম সা: হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, যে আমার রওজা জিয়ারত করবে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (বায়হাকি, দারেকুতনি)।

আল্লাহর হাবিব সা: আরো বলেন, যে ব্যক্তি আমার ইন্তেকালের পর আমার রওজা জিয়ারত করবে সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল। (তবারানি, মুজামুল আওসাত)।

বিশিষ্ট আলেমদের অভিমত : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল হাদিস বিভাগের প্রফেসর ও হাদিস গবেষক ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর বলেন, ‘যে আমার রওজা জিয়ারত করবে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যাবে’ এটি একটি জাল হাদিস। তা ছাড়া ‘যে ব্যক্তি আমার ইন্তেকালের পর আমার রওজা জিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায়ই আমার সাথে সাক্ষাৎ করল’ এটিও একটি জাল হাদিস।

শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিচার্স সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মুহাদ্দিস এম মিজানুর রহমান বলেন, আমার উম্মতের কবিরা গুনাহগারীদের জন্য আমার শাফায়াত অবধারিত মর্মে যে হাদিসটি পাঠ্যবইয়ে লেখা হয়েছে সে হাদিসটিতে গুনাহগারীদের আগে ‘কবিরা’ শব্দটি নেই। এটি বানিয়েছে।
রসুল সা:-এর শাফায়াত বিষয়ে তিনি বলেন, রসুল সা:-এর একটি উপাধি হলো শাফিউল মুজনিবীন। মুজনিবীন শব্দটি এসেছে জামবুন থেকে। জামবুন মানে সগিরা বা ছোট গুনাহ। অর্থাৎ রসুল সা: ছোট ছোট গুনাহগারদের জন্য শাফায়াত করবেন। এ জন্য তাকে বলা হয় শাফিউল মুজনিবীন।
কবিরা গুনাহকে বলা হয় মা’ছিয়াত। হজরত মুহাম্মদ সা:-কে শাফিউল আছিয়ীন বলা হয় না।

শাফায়াত পাওয়ার শর্তই হলো কবিরা গুনাহ না করা। আর পাঠ্যবইয়ে যে লিখল কবিরা গুনাহগারীদের তিনি শাফায়াত করবেন এটা তারা পেল কোথায়? এর পক্ষে যেসব হাদিস পাঠ্যবইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে তা খুবই দুর্বল।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আল ফিকহ বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবু বকর মুহাম্মদ জাকারিয়া মজুমদার বলেন, পাপী কবিরাগুনাহগারের জন্য রসুলের শাফায়াত অবধারিত এটি অসত্য। গুনাহগারীর জন্য রসুল সা: শাফায়াত করবেন তবে তা আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে। ঢালাওভাবে তিনি সব কবিরাগুনাহগারের জন্য শাফায়াত করবেন এ কথা বিশ্বাস করা যাবে না।

তবে ঢাকার মিরপুর দারুর রাশাদের মুহাদ্দিস মাওলানা লিয়াকত আলী বলেন, হাদিসটি এভাবে এসেছে যে, আমার উম্মতের কবিরা গুনাহগারদের জন্য আমার শাফায়াত। এখানে অবধারিত কথাটা যোগ করা ঠিক হয়নি। হাদিসের মর্ম হলো সগিরা গুনাহ আল্লাহ তায়ালা নিজগুণে বা বান্দার নেক কাজের বদৌলতে ক্ষমা করবেন। আর কবিরাগুনাহের জন্য যেহেতু তওবা ইস্তেগফার শর্ত, তাই কেউ তা না করে গেলে আল্লাহর রাসূল এমন ব্যক্তির জন্য শাফায়াত করতে পারবেন। তবে তা যে আল্লাহর অনুমতি সাপেক্ষে তা একাধিক আয়াত দ্বারা প্রমাণিত।

কুরআন এবং হাদিস বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন পবিত্র কুরআনে শাফায়াত বিষয়ে অনেকগুলো আয়াত রয়েছে। শাফায়াত বিষয়ে আলোচনা করতে হলে এবং শিক্ষার্থীদের স্পষ্ট ধারণা দিতে হলে অবশ্যই পবিত্র কুরআনের এসব আয়াত সামনে রাখতে হবে। কিন্তু পাঠ্যবইয়ে তা করা হয়নি। তা ছাড়া শাফায়াত বিষয়ে অনেক শক্তিশালী হাদিস রয়েছে যা ঢালাওভাবে শাফায়াতকে সমর্থন করে না।

কিন্তু সে রকম কোনো হাদিসও উল্লেখ করা হয়নি মাদরাসার পাঠ্যবইয়ে। কুরআন এবং হাদিস বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ পাঠ্যবইয়ে শাফায়াতকে ঢালাও ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে শিক্ষার্থীরা ভুল শিক্ষা পাবে। তাদের মতে শাফায়াত নিয়ে আলোচনা করতে হলে অবশ্যই জেনে বুঝে সতর্কতার সাথে আলোচনা করা উচিত। কারণ পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে ভুল শিক্ষা ছড়িয়ে পড়লে তা শোধরানো খুব কঠিন।

অনেকে প্রশ্ন করেছেন খারাপ কাজ করেও রসুলের রওজা জিয়ারত করলে যদি শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যায় তাহলে আর কষ্ট করে ভালো কাজ করার দরকার কি?

শাফায়াত বিষয়ে পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত রয়েছে। আয়াতগুলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত আল কুরআনুল করীম বাংলা তরজমা থেকে তুলে ধরা হলো।

সূরা বাকারা ৪৮ : তোমরা সেই দিনকে ভয় কর যেদিন কেহ কাহারো কোনো কাজে আসিবে না, কাহারো সুপারিশ গ্রহণ করা হইবে না, কাহারো নিকট হইতে বিনিময় গৃহীত হইবে না এবং তাহারা কোনো প্রকার সাহায্যপ্রাপ্তও হইবে না। এ সূরায় ১২৩ নং আয়াতেও একই ধরনের কথা বলা হয়েছে।

বাকারা ২৫৪ : হে মুমিনগণ, আমি তোমাদেরকে যাহা দিয়াছি তাহা হইতে তোমরা ব্যয় কর সেই দিন আসিবার পূর্বে যেই দিন ক্রয়-বিক্রয়, বন্ধুত্ব ও সুপারিশ থাকিবে না এবং কাফিররাই জালিম।

সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াত যা আয়াতুল কুরসী নামে পরিচিত যেখানে আল্লাহ বলেছেন, কে সে যে তাহার অনুমতি ব্যতীত তাহার নিকট সুপারিশ করিবে?

সুরা ইউনুস ৩ : তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ... তাহার অনুমতি লাভ না করিয়া সুপারিশ করিবার কেহ নাই।

মারইয়াম ৮৭ : যে দয়াময়ের নিকট প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করিয়াছে সে ব্যতীত কাহারো সুপারিশ করিবার ক্ষমতা থাকিবে না।

সূরা যুমার ১৯ : যাহার উপর দণ্ডাদেশ অবধারিত হইয়াছে তুমি কি রক্ষা করিতে পারিবে সেই ব্যক্তিকে যে জাহান্নামে আছে?

যুমার ৪৩-৪৪ : তবে কি উহারা আল্লাহ ব্যতীত অপরকে সুপারিশকারী ধরিয়াছে? বল, উহাদের কোনো ক্ষমতা না থাকিলেও এবং উহারা না বুঝিলেও? বল সকল সুপারিশ আল্লাহরই এখতিয়ারে, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সর্বময় কর্তৃত্ব আল্লাহরই, অতঃপর তাহারই নিকট তোমরা প্রত্যানীত হইবে।

সূরা মুমিন ১৮ : উহাদেরকে সতর্ক করিয়া দাও আসন্ন দিন সম্পর্কে যখন দুঃখ কষ্টে উহাদের প্রাণ কণ্ঠাগত হইবে। জালিমদের কোনো অন্তরঙ্গ বন্ধু নাই, যাহার সুপারিশ গ্রাহ্য হইবে এমন কোনো সুপারিশকারীও নাই।

সূরা শুরা ৪৬ : আল্লাহ ব্যতীত উহাদেরকে সাহায্য করিবার জন্য উহাদের কোনো অভিভাবক থাকিবে না এবং আল্লাহ যাহাকে পথভ্রষ্ট করেন তাহার কোনো গতি নাই।

সূরা যুখরুখ ৮৬ : আল্লাহ ব্যতীত উহারা যাহাদেরকে ডাকে, সুপারিশ করিবার ক্ষমতা তাহাদের নাই, তবে যাহারা সত্য উপলব্ধি করিয়া উহার সাক্ষ্য দেয়, তাহারা ব্যতীত।

সূরা নাজম ২৬ : আকাশে যত ফিরিশতা রহিয়াছে উহাদের সুপারিশ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হইবে না, তবে আল্লাহর অনুমতির পর; যাহার জন্য তিনি ইচ্ছা করেন ও যাহার প্রতি তিনি সন্তুষ্ট।

সূরা মুদদাসসির ৪৮ : ফলে সুপারিশকারীদের সুপারিশ উহাদের কোনো কাজে আসিবে না।

সূরা ইনফিতার ১৯ : সেই দিন একের অন্যের জন্য কিছু করিবার সামর্থ্য থাকিবে না এবং সেই দিন সমস্ত কর্তৃত্ব হইবে আল্লাহর।

সূরা সাজদা ৪ : তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো অভিভাবক নাই এবং কোনো সুপারিশকারী নাই।

সূরা হুদ ১০৫ : যখন সেই দিন আসিবে তখন আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত কেহ কথা বলিতে পারিবে না।

সূরা নাবা : ৩৮ সেই দিন রুহ্ ও ফিরিশতাগণ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইবে, দয়াময় যাহকে অনুমতি দিবেন সে ব্যতীত অন্যেরা কথা বলিবে না এবং সে যথার্থ

বলিবে।
এ ছাড়া শাফায়াত এবং ফেরেশতা বিষয়ে সূরা আম্বিয়ায় আরো তিনটি আয়াত রয়েছে।
(এ সিরিজ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয় ২০১৪ সালে। তখন প্রফেসর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর জীবিত ছিলেন। তবে সিরিজ প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হলেও তখনকার বিদ্যমান পরিস্থিতির কারণে প্রতিবেদন প্রকাশ স্থগিত রাখা হয়।)


আরো সংবাদ



premium cement