২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

যে কারণে মাঝপথে বন্ধ হলো অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল

যে কারণে মাঝপথে বন্ধ হলো অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল - প্রতীকী ছবি

হঠাৎ করেই মঙ্গলবার অ্যাস্ট্রাজেনিকা তাদের চ্যাডক্স-১ অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির তিনটি দেশে পরিচালিত শেষ ধাপ বা ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সকল কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। কারণ হিসেবে তারা বলেছে, যুক্তরাজ্যের ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের মধ্যে একজন হঠাৎ করে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তারা এখন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান চালাবে এটা দেখার জন্য যে এই অসুস্থতাটা কী ভ্যাকসিন থেকে হয়েছে না কি অন্য কোনো কারণে। অ্যাস্ট্রাজেনিকা অবশ্য এই ‘মারাত্মক অসুস্থতার’ ধরণ সমন্ধে পরিস্কারভাবে কিছু বলেনি।

কোন অবস্থায় আছে ভ্যাকসিনটি এখন?

অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনিকার যৌথ উদ্যোগে উদ্ভাবিত করোনা ভ্যাকসিনটি একটি অ্যাডিনোভাইরাস ভেক্টর ভ্যাকসিন যা করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিন বহন করে এবং টিকা দেয়ার পর মানুষের শরীরে করোনাভাইরাসের বিপরীতে রোগ প্রতিরোধক ব্যাবস্থা গড়ে তোলে। এই ভ্যাকসিনে তারা বিশেষভাবে রূপান্তরিত শিম্পাঞ্জির অ্যাডিনোভাইরাস ব্যবহার করেছে যা মানুষের দেহে কোনো প্রকার রোগ তৈরী করতে অক্ষম। হাজারখানেক মানুষের উপর চালানো ফেজ-১/২ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে এই ভ্যাকসিনটি কার্যকরী এবং নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এই ট্রায়ালে ভ্যাকসিনটি যে ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া করেছে তার ভেতরে কোনোটিই মারাত্মক ছিল না। ভ্যাকসিনের সাথে প্যারাসিটামল ট্যাবলেট দিয়ে এই ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দমন করা সম্ভব হয়েছিল।

কতদূর পিছিয়ে পড়ল ভ্যাকসিনটির অগ্রগতি?

ফেজ-৩ ট্রায়ালে এ ভ্যাকসিনটি এখন পর্যন্ত যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের মোট ১৭ হাজার ভলান্টিয়ারের দেহে প্রয়োগ করা হয়েছে যার ভেতরে অনেকেই আছে যাদের বয়স ৭০-এর ওপরে। যুক্তরাষ্ট্রের ৩০ হাজার ভলান্টিয়ারের ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটির ফেজ-৩ ট্রায়াল হচ্ছে বৃহৎ পরিসরে এবং এ ভ্যাকসিনটিই আর সবার চেয়ে এগিয়ে আছে ভ্যাকসিন দৌড়ে। আশা নিয়ে সবাই তাকিয়ে আছে ভ্যাকসিনটির দিকে। অ্যাস্ট্রাজেনিকাও আশাবাদী ছিল যে তারা স্বল্প মূল্যে ভ্যাকসিনটি এই অক্টোবরেই সবার জন্য বাজারে নিয়ে আসতে পারবে। এর প্রতি ডোজের দাম হবে ৪৫০ টাকার মতো। কিন্তু হঠাৎ এই ছন্দ পতনে তারা কিছুটা পিছিয়ে পড়ল। ধারণা করা হচ্ছে, এক থেকে দেড় মাসের আগে তারা পুনরায় তাদের ভ্যাকসিনটির ট্রায়াল শুরু করতে পারবে না। একটা নিরপেক্ষ সেইফটি কমিটি এখন অনুসন্ধান চালাবে, কেন ভ্যাকসিন গ্রহীতাটি এত মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ল।

কী এমন মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটেছিল?

৮ সেপ্টেম্বরের নিউইয়র্ক টাইমস থেকে জানা যায় যে ওই মারাত্মকভাবে অসুস্থ ভ্যাকসিন গ্রহীতাটি আসলে ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিসে আক্রান্ত। এটা এক ধরণের মারাত্মক স্পাইনাল কর্ড বা মেরুরজ্জুর প্রদাহ জনিত সমস্যা। ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিস বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাস ইনফেকশনের কারণে হয়ে থাকে। অসুখটা তীব্র ও মারাত্মক হলেও স্টেরয়েড চিকাৎসার মাধ্যমে সারিয়ে তোলা সম্ভব। এধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ১৭ হাজার ভ্যাকসিন গ্রহীতাদের ভেতরে এই প্রথম দেখা দিলো। নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি এখন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখছে যে এই ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিসের সাথে ভ্যাকসিনটির অ্যাডিনোভাইরাসের সরাসরি কোনো সম্পর্ক আছে কি না। না কি ওই ভলান্টিয়ারের এ রোগটি হয়েছে অন্য কোনো কারণে। তদন্তে যদি দেখা যায় যে ভ্যাকসিনের কারণেই এই মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়েছে অথবা নতুন করে ভলান্টিয়ারদের ভেতরে আরো কয়েকজন একই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করছে তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যিই অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনটি সমস্যার ভেতরে পড়বে।

ভ্যাকসিনের উপর ট্রাম্পের নির্বাচনের প্রভাব

রাশিয়া ও চীনের মতো যুক্তরাষ্ট্রও জড়িয়ে পড়েছে ভ্যাকসিন রাজনীতিতে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভ্যাকসিন কোম্পানিগুলোকে চাপ দিচ্ছে ৩ নভেম্বর প্রেসিডন্ট নির্বাচনের আগেই বাজারে ভ্যাকসিন আনতে। দেশের সবাইকে ভ্যাকসিন দিয়ে বিজয়ী হতে চাচ্ছে নির্বাচনে। তিনি হয়তো ভাবছেন, অ্যাস্ট্রাজেনিকা যদি অক্টোবরে যুক্তরাজ্যের বাজারে ভ্যাকসিন আনে তাহলে সে হয়তো তার দেশের মর্ডানা বা ফাইজারের ভ্যাকসিন দুটিকে শেষ ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল সম্পন্ন না করেই জনসাধারণের টিকা প্রয়োগের জন্য এপ্রোভাল দিয়ে দিতে পারবে। যেমনটি দিয়েছে চীন ও রাশিয়া। এতে অবশ্য অক্সফোর্ড নারাজ। ৮ সেপ্টেম্বর অ্যাস্ট্রাজেনিকাসহ আরো ৯টি ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান একজোট হয়েছে এই মর্মে যে তারা কেউই কারো চাপাচাপাতে নিয়ম-বহির্ভূতভাবে ফেজ-৩ ট্রায়াল সম্পন্ন না করে ভ্যাকসিন বাজারে আনবে না। অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের এই দুর্ঘটনার পর এই দাবি আরো জোরালো হলো। অতএব অক্সফোর্ড যে তাদের বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্রায়াল নভেম্বরের আগে শুরু করবে না তা কিছুটা অনুমান করা যায়।

ফেজ-৩ ট্রায়াল ছাড়া নতুন ভ্যাকসিন বিপজ্জনক

তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালের একদম শেষ পর্যায়ে এসে অক্সফোর্ড ভ্যাকসিনের এই অনাকাঙ্ক্ষিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই বলে দেয় যে একটা নিরাপদ ভ্যাকসিন উৎপাদনে বড় পরিসরে ফেজ-৩ ট্রায়াল কতটা জরুরি। অনিরাপদ ভ্যাকসিন ভালোর চেয়ে ক্ষতিই করে বেশি। ভ্যাকসিনে ব্যবহার করা হয় জীবাণু, জিন অথবা প্রোটিন। এগুলো সবই জৈবিকভাবে সক্রিয় যা পরীক্ষা করে না ব্যবহার করলে শরীরে গিয়ে নতুন রোগ সৃষ্টি করতে পারে। অতীতে দেখা গেছে, তড়িঘড়ি করে উৎপাদিত কিছু পোলিও ভ্যাকসিন প্রায় ৭০ হাজার শিশুর শরীরে মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। এতে অনেক শিশু মারাও গিয়েছিল। এত কিছুর পরও দেখা যাচ্ছে শত বিলিয়ন ডলারের বাজার ধরতে রাশিয়া বা চীন রিসার্চ এথিক্স এবং নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই কোনো প্রকার ফেজ-৩ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়াই অপরীক্ষিত ভ্যাকসিন প্রয়োগ করছে তাদের সাধারণ জনগণের ওপর। নিজ দেশের নিরীহ মানুষগুলোকে বানাচ্ছে গিনিপিগ! আমরা সবাই একটি নিরাপদ ভ্যাকসিন চাই। যথাযথ ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া কোনো ভ্যাকসিন নয়।

লেখক : এমবিবিএস, এমএসসি, পিএইচডি,
সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট,
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য
শেফিল্ড ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য


আরো সংবাদ



premium cement
কুলাউড়ায় জঙ্গল থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার ঈদগাঁওতে মাদককারবারি গ্রেফতার শিক্ষায় ব্যাঘাত : ফেসবুক-টিকটক-ইনস্টাগ্রাম-স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে ২৯০ কোটি ডলারের মামলা আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী রাশিয়ার ৯৯টি ক্ষেপণাস্ত্রের ৮৪টি ভূপাতিত করেছে ইউক্রেন আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর

সকল