১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

রমজানে যাচাই করি নিজেকে

-

রোজা এমন এক ইবাদত যার প্রতিদান ফেরেশতারা লিখতে অপারগ। কলমের কালি যার হিসাব লিখতে অক্ষম। রোজা একমাত্র মহান রবের জন্য। মহান আল্লাহ নিজ হাতে তার প্রতিদান দেবেন। এমন বরকতময় রমজান প্রতিবার আমাদের কাছে আসে মাস পেরিয়ে আবার সে এক বছরের জন্য বিদায় নেয়। এভাবে আমাদের জীবনে অনেকগুলো রমজান পেরিয়ে আমরা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ি। পৃথিবীর সব আমল শেষ হয়ে যায়। শুরু হয় তার ফল লাভ।
আমাদের জীবনে ৩০, ৪০, ৫০ বা ৬০ বা তারও বেশি মাস আমরা রোজা আদায় করি। ফল যেই সেই। রোজার আগে আমার চরিত্র আর পরের চরিত্র কোনো পার্থক্য নেই। পুরো মাস আমার আত্মার চিকিৎসা করলাম। কিন্তু আত্মার রোগ বালাই দূর হলো না। আমার আত্মা পরিশুদ্ধ হলো না। আসুন একটু যাচাই করিÑ
সংযমের, নাকি অপচয়ের: রোজাকে আমরা সবাই সংযমের মাস বলি। আসলে রোজা সংযমের মাস। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, রোজাকে আমরা অপচয়ের মাস বানিয়ে নিয়েছি। রমজান এক উৎসবের মাসে রূপ নিয়েছে। এই মাসে খরচ বেশি। এই মাসে বাজার বেশি। রোজার মাসে আমরা সবচেয়ে বেশি খাবার খাই। সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট করি। ইফতারি আর সাহরিতে এত আইটেম আর এত খাবার তৈরি হয়, যা আমরা প্রচুর খেয়েও শেষ করতে পারি না। অনেক খাবার নষ্ট হয়। অপরদিকে অনেক মানুষ এমন আছে না খেয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে তাদের খবর রাখারও সুযোগ হচ্ছে না। রোজা যতই মর্যাদাপূর্ণ ইবাদত হোক না কেন, নিশ্চয়ই রোজা উপলক্ষে অপচয় করলে সেটি আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন না। কেননা, অপচয়কারী শয়তানের ভাই। শয়তানের ভাই সেজে আমি কিভাবে মাওলার প্রিয় হতে পারি? এই অপচয় আমাকে আমার প্রভুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। তাই রমজানে বেশি খাওয়ার আইটেম নয়। বেশি খাওয়া নয়। অপচয় নয়। তবেই রমজান হবে সংযমের মাস।
ইবাদতের নাকি খেলাধুলার : রমজানে একটি নফল আদায় করলে অন্য মাসের একটি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। একটি ফরজ আদায় করলে অন্য মাসের ৭০টি ফরজ আদায়ের সওয়াব পাওয়া যায়। এই মাসে যত বেশি ইবাদত করা যাবে ততই বেশি লাভ হবে। কিন্তু আমরা রমজানকে আমোদ-প্রমোদ, বিনোদন আর খেলার মাস বানিয়ে নিয়েছি। সময় কাটানোর জন্য আমরা ক্রিকেট খেলা দেখাসহ আরো বিভিন্ন খেলায় লিপ্ত থাকি। আপনি যত খেলাই বলুন না কেন খেলা কি সওয়াবের কাজ; কোনো খেলাধুলা কি ইবাদততুল্য? অবশ্যই না। তাহলে রমজানে আমি মূল্যবান সময়টাকে যদি খেলায় না কাটিয়ে ইবাদত, তিলাওয়াত, ইস্তিগফার, দরূদ পাঠ ইত্যাদি কাজে ব্যয় করি। তবেই রমজান আমাকে সুফল এনে দেবে। রমজানকে খেলার মাস বানিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশা করা কি কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে?
ইবাদতের নাকি বিনোদনের : রমজান মাসে অন্য মাসের তুলনায় একটু অবসর বেশি। অফিস সময় কম। ব্যবসায় সময় কম। এই অবসর সময়কে নিয়ামত মনে না করে কষ্টকর মনে করি। তাই এই সময় কাটানোর জন্য টিভি দেখা, ফেসবুকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যস্ত থাকা ইত্যাদি বিনোদনে লিপ্ত হয়ে যাই। অথচ আমার উচিত ছিল, এই অবসর সময়ে ইবাদতের মিষ্টতা গ্রহণ করা। কুরআনুল কারিমের তিলাওয়াতের স্বাদ গ্রহণ করা। কুরআনের মাসে কুরআন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করা।
ইহসানের নাকি অন্যের কষ্ট বাড়ানোর : রমজান মাস অন্যের কষ্ট অনুধাবন করার মাস। অন্যের কষ্ট দূর করার মাস। কিন্তু রমজান মাসে আমার ইফতার-সাহরিতে এত বেশি আইটেম থাকতে হয় যে, ঘরের মা, বোন, স্ত্রী, মেয়ে তাদের সারা দিন এই রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। তারা কোনো ইবাদতের সুযোগ পান না। তারপরও আমার মন ভরে না। আরো বেশি চাই, আরো বেশি চাই। অথচ একটু চিন্তা করলেই আমার খাবার আইটেম কমাতে পারি। তাদের সময় বাঁচিয়ে ইবাদতের সুযোগ করে দিতে পারি। তাদের কষ্ট কমাতে পারি। এতে তাদেরও লাভ হয়। আমারও লাভ হয়।
দানের নাকি বেশি লাভ করার: রমজান মাস দানের মাস। রাসূলুল্লাহ সা: এই মাসে সবচেয়ে বেশি দান করতেন। তিনি প্রবাহিত বায়ুর চেয়ে আরো বেশি প্রসারিত, মুক্ত হস্তে দান করতেন। এই মাসে সব ভালো কাজেই বেশি সওয়াব। কিন্তু আমরা দানের পরিবর্তে এই মাসকে ব্যবসায় বেশি লাভের মাস বানিয়ে নিয়েছি। এই এক মাসেই সারা বছরের লাভ করে নিতে হবে। তাই রমজান আসার আগেই জিনিসপত্রের দাম আগুনের মতো বাড়তে থাকে। অনেকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে দাম চলে যায়। কোনো ব্যবসায়ীই দাম কমানোর উদ্যোগ নেন না। কিভাবে আরো বেশি লাভ করা যায় এই ধান্ধায় ব্যস্ত থাকেন। একটু ভাবুন তো এ অবস্থায় আমি কিভাবে রমজানের বরকত লাভে ধন্য হতে পারি!
অন্যের কষ্ট বোঝার নাকি ঘুমিয়ে কাটানোর : রমজান গরিবের ক্ষুধার জ্বালা, অনাহারের কষ্ট বোঝার মাস। কিন্তু আমি যদি সারা দিন ঘুমিয়ে কাটাই তবে আমার পক্ষে তাদের কষ্ট বোঝা সম্ভব হবে? কোনোভাবেই না। আমরা অনেকেই রমজানের অবসর ঘুমিয়ে কাটাই। অন্যের কষ্ট অনুধাবন করতে হলে আমাকে অবশ্যই দিনের ঘুম ছেড়ে দিতে হবে। প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে হবে। ক্ষুধার কষ্ট অনুধাবন করার চেষ্টা করতে হবে।
কাজের নাকি ফাঁকি দেয়ার: স্বাভাবিকভাবেই রমজানে অন্য মাসের তুলনায় কাজ কম থাকে। যারা আল্লাহর প্রিয় হতে চান তারা তাদের কর্মীদেরকে কাজ কমিয়ে দেন। আমাদের দেশে রমজানে অফিস সময়ও কম। কিন্তু এই অফিস সময়ের মধ্যে আমরা অনেকেই রোজার দোহাই দিয়ে আরো কাজ কম করতে চাই। রমজানের কষ্ট বলে চালিয়ে দেই। একটু লক্ষ করলে দেখতে পাই, রমজান সবচেয়ে বেশি কষ্ট করার মাস। এই মাসে রাসূলুল্লাহ সা:-এর নেতৃত্বে মুসলমানদের প্রথম যুদ্ধ বদরের বিজয় অর্জিত হয়েছে। এই মাসেই ইসলামের চূড়ান্ত বিজয়, মক্কা বিজয় সাধিত হয়েছে। এই মাসে মহাবীর তারিক বিন জিয়াদ রাহ:-এর নেতৃত্বে স্পেনের মাটিতে কালিমার বিজয় পতাকা পতপত করে উড্ডীন হয়েছে। এই বরকতময় মাসে মুহাম্মদ বিন কাসিম রাহ: আমাদের এই প্রিয় ভারত ভূমি জয় করেছেন। তাই এই মাস কাজ কম করার মাস নয়। সবচেয়ে কঠিনতম কাজ করে সফলতা অর্জনের মাস এই রমজান। তাই এই মাসে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব খুব ভালোভাবে আঞ্জাম দেয়ার এই রমজান মাস।
ব্যস্ততার না অলসতা আর গল্পের: রমজান রহমতের বসন্তকাল। এই মাসে যে আজলা ভরে রহমত কুড়িয়ে নেবে সেই সফল। এই মাসে আমরা বেখেয়ালে সময় কাটানোর জন্য আড্ডা আর গল্পে সময় ব্যয় করি। এই আড্ডায় সময় ব্যয়ে আমরা গিবত, মিথ্যা অনেক পাপকাজে জড়িয়ে পড়ি। অথচ রমজানের এক একটি মুহূর্ত অনেক অনেক মূল্যবান। এই একেকটি সময় আমার কাছে আর কখনো ফিরে আসবে না, শুধু আফসোস রেখে যাবে। আমার সময় যদি আড্ডা, গল্প, গিবত আর মিথ্যায় লেগে যায় তবে আমার উপোস থাকায় কোনো লাভ হবে না। আসুন রমজানকে রমজানের মতো করেই কাটাই। রমজান নিয়ে একটু চিন্তাভাবনা করি। নিজের কাজগুলোকে ঢেলে সাজাই। নিজের ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করি এবং শোধরানোর চেষ্টা করি।


আরো সংবাদ



premium cement