২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হাইব্রিডের কবলে দেশী শাকসবজি

হাইব্রিডের কবলে দেশী শাকসবজি - নয়া দিগন্ত

দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ সমগ্র জেলায় হাইব্রিডের কবলে পড়েছে দেশীয় শাকসবজি। তা উৎপাদনে ব্যবহার করা হচ্ছে অতিরিক্ত সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন। কোনো রকম খবরদারি বা বিধিনিষেধ না থাকা এবং অতিরিক্ত লাভের আশায় চাষিরা নিজেদের অজান্তে জনস্বাস্থ্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে বিপর্যয়ের হুমকিতে ফেলে শাকসবজি উৎপাদনে ঝুঁকে পড়েছেন হাজার হাজার চাষি ।

দীর্ঘদিন ধরে এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত শাকসবজি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করায় জনস্বাস্থ্য যেমন ঝুঁকির মুখে রয়েছে তেমনি নানা রকমের জটিল রোগে ছড়িয়ে পড়ছে মানবদেহে। তা ছাড়া অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য পড়ছে হুমকিতে। এ কারণে আজকাল খাল বিলে দেশী প্রজাতির বিভিন্ন প্রজাতির মাছ অনেকটাই বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে। 

অতিরিক্ত সার কিটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন প্রয়োগে উৎপাদিত শাকসবজি মানবদেহে বিভিন্ন রোগ-ব্যাধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যও রয়েছে হুমকির মুখে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন।

এক সময়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলের চাষিরা দেশী জাতের শাকসবজি চাষ করলেও বর্তমানে অধিক উৎপাদন ও লাভের আশায় তারা ঝুঁকে পড়েছেন হাইব্রিডের দিকে। আর এই হাইব্রিড শাকসবজি উৎপাদনে চাষিরা নিজেদের অজ্ঞতাবশত কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে অতিরিক্ত সার কীটনাশকও কৃত্রিম হরমোন ব্যবহার করে আসছেন শাকসবজি উৎপাদনে। দীর্ঘদিন ধরে একই নিয়মে শাকসবজি উৎপাদন প্রক্রিয়া চলে আসার ফলে ইতোমধ্যে খাল-বিল পুকুর নালা ডোবা থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়েছে দেশী জাতের মাছ। একই কারণে কোনো বিধিনিষেধ না থাকায় অধিক ফলনের আশায় চাষিরা বিদেশী জাতের হাইব্রিড শাক-সবজি চাষে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে দেশী সবধরনের শাকসবজির বীজ। ইতোমধ্যে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ দেশী জাতের শাকসবজি হারিয়ে গেছে বলে জানা গেছে।


চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী প্রসিদ্ধ সবজি চাষি আবদুল করিম তিনি বলেন, এক সময় দোহাজারীতে দেশী জাতের বাঁধাকপি, ফুলকপি, মুলা, ঢেঁরস, লাউ, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, বেগুন, খিরা, ফল, শালগম, গাজর, ধনেপাতা, বরবটি, লালশাক, পালংশাক চাষ করেছেন, কিন্তু এতে উৎপাদন তেমন না হওয়ায় তারা এখন হাইব্রিড জাতের শাক-সবজি চাষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তিনি বলেন, এই অঞ্চলে এখন দোহাজারী জাতের শিম ও আলুর জাত এখনো টিকে আছে। তিনি বলেন, হাইব্রিড শাকসবজি চাষে রাসায়নিক সার কিটনাশক ব্যবহার ছাড়া উৎপাদন করা একেবারেই অসম্ভব। বীজ নিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখন হাইব্রিড বীজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তিনি দুঃখ করে বলেন, এই হাইব্রিড বীজ এখন ৫ টাকারটা ১০ টাকায় আর ১০ টাকার বীজ এখন ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় ক্রয় করেতে হচ্ছে। 

গতকাল ২১ সেপ্টেম্বর বিকেলে শাকসবজির জন্য সুবিখ্যাত চন্দনাইশ উপজেলার দোহাজারী বাজারে গিয়ে বেশ কয়েকজন শাকসবজির বীজ বিক্রেতার সাথে আলাপ করে জানা গেছে, প্রতিটি বীজ বিক্রেতার দোকানে এখন ৯০-৯৫ ভাগ বিক্রি হচ্ছে হাইব্রিড শাকসবজির বীজ, কিছু রয়েছে উচ্চফলনশীল জাতের শাকসবজির বীজ। দেশী প্রজাতির রয়েছে মাত্র দোহাজারীর শিম ও শসার বীজ আর কোনো দেশী বীজই তাদের দোকানে নেই বললেই চলে। এ সময় দোহাজারী চাষি কল্যাণ বীজ ভাণ্ডারের মালিক আবদুল মালেকের দোকান, দোহাজারী বীজ ভাণ্ডার ও মেসার্স কৃষি ভাণ্ডারে গেলে দেখা গেছে, এদের কোনো দোকানেই পর্যাপ্ত পরিমাণে দেশী বীজ নেই। মেসার্স কৃষি ভাণ্ডারের মালিক মো: লিটন বলেন, ৯০ ভাগ বীজ এখন হাইব্রিড, হাইব্রিড ছাড়া এখানকার চাষিরা আর দেশী জাতের শাকসবজি চাষ করে না তার কারণ হিসাবে তিনি বলেন, হাইব্রিডের চেয়ে উফশী ও দেশী জাতের শাকসবজির উৎপাদন অনেক কম হয় তাই চাষিরা হাইব্রিড বেছে নিয়েছেন।

গতকাল বিকেলে দেশে অর্গানিক পোলট্রি, ডেইরি, ফিশারিজ কৃষি চাষের অন্যতম উদ্যোক্তা ফখরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। পরিবেশকে দূষিত না করে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ হাইব্রিড শাকসবজি উৎপাদন করা সম্ভব। এ জন্য সরকারি বেসরকারি সবার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে জৈব সার জৈব বালাইনাশক ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করতে হবে আর এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত হাইব্রিড শাকসবজি হবে সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিমান সমৃদ্ধ।

অতিরিক্ত সার ব্যবহার করে শাকসবজি উৎপাদনের বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কৃষি অধিদফতর চট্টগ্রামের আকতারুজ্জামান বলেছেন, পুরো বিশ্বই হাইব্রিড শাকসবজি উৎপাদনের ওপরে জোর দিচ্ছেন। তবে হাইব্রিড শাকসবজি উৎপাদনে অবশ্যই পরিমিতভাবে রাসায়নিক সার কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে যদি পরিমিতভাবে কীটনাশক সার প্রয়োগ করে শাকসবজি উৎপাদন করা হয় তাতে পুষ্টিমানের কোনো ক্ষতি হবে না বা খাদ্য হিসেবে তা কোনোভাবেই মানবদেহের ক্ষতি করবে না। তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক উপজেলা পর্যায়ে সব কৃষি অফিসার উপসহকারী কৃষি অফিসারের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে কৃষদেরকে পরিমিত সার কীটনাশক ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. আতিয়ার রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি গতকাল সন্ধ্যায় নয়া দিগন্তকে বলেন, অতিরিক্ত সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরোমন প্রয়োগ করে উৎপাদিত শাকসবজি আমাদের জীবনচক্রের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। বিভিন্ন দেশে খাদ্য উৎপাদনে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর এসব্য রাসায়নিক সার কীটনাশক ও কৃত্রিম হরমোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সহনশীলতাকে প্রাধান্য দেয়া হলেও আমাদের দেশে এই সব ক্ষতিকর রাসায়নিক সার কীটনাশক ও হরমোন ব্যবহারের কোনো নিয়মনীতি নেই বললেই চলে। ফলে এই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত শাকসবজিসহ সবধরনের খাদ্য আমাদের জীবনচক্রকে মারাত্মক ক্ষতি করছে। স্বাভাবিকভাবে সরাসরি এসব খাদ্য খাওয়ার ফলে আমাদের শরীরে ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া দেখা দিচ্ছে, এক কথায় তিনি বলেন, এই সব খাবার গ্রহণের কারণে শরীরের ভিতরে নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল উপাদান তৈরি করছে ফলে মানবদেহের অভ্যন্তরে ক্যান্সার ডায়াবেটিস তৈরি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত করছে। কাজেই আমাদেরকে খাদ্য উৎপাদনে সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি জৈবসার বালাইনাশক ব্যবহার করে আমাদের খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থাকে আরো টেকসই ও অর্গানিক করে গড়ে তুলতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement