১৬ জুলাই কি ঘটেছিল রংপুরে

গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে আবু সাঈদকে বেধড়ক পেটায় পুলিশ

ছিনিয়ে নেয় লাশ : রাতেই দাফন করতে দেয়া হয় প্রবল চাপ

গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে তাকে কিভাবে বেধড়ক পিটিয়েছিল পুলিশ। লাশ ছিনিয়ে নেয়া, বাড়িতে নিয়ে রাতেই দাফনে চাপ দেয়াসহ কি ঘটেছিল। সাঈদের বাড়িতে রাতে কারা গিয়েছেন। কে গোসল করিয়েছিলেন। তার মামলার সর্বশেষ কি খবর। এসবয় বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে নয়া দিগন্ত।

সরকার মাজহারুল মান্নান, রংপুর ব্যুরো

Location :

Rangpur
শহীদ আবু সাঈদ
শহীদ আবু সাঈদ |সংগৃহীত

২০২৪ এর ১৬ জুলাই। রংপুরে কি ঘটেছিল। প্রথমে শিক্ষার্থীদের কোথায় বাঁধা দিয়েছিল পুলিশ। কিভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। গুলিবিদ্ধ হওয়ার আগে তাকে কিভাবে বেধড়ক পিটিয়েছিল পুলিশ। লাশ ছিনিয়ে নেয়া, বাড়িতে নিয়ে রাতেই দাফনে চাপ দেয়াসহ কি ঘটেছিল। সাঈদের বাড়িতে রাতে কারা গিয়েছেন। কে গোসল করিয়েছিলেন। তার মামলার সর্বশেষ কি খবর। এসবয় বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে নয়া দিগন্ত।

১৬ জুলাই। ২০২৪ এর পুরো রংপুর মহানগরী ছিল থমথমে। বেলা পৌনে একটার দিকে জিলা স্কুল মোড় থেকে নগরীর প্রায় সবকটি স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ নিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের উদ্দেশে রওনা দেয়। পথিমধ্যে প্রথমে ক্যাপ্টেন ব্যাকোলোজি মোড়ে ওই মিছেলে বাঁধা দিয়ে লাঠিপেটা করে পুলিশ। এতে বেশ কিছু শিক্ষার্থী আহত হয়। এসময় পুলিশ তিনজন শিক্ষার্থীকে বেধড়ক পিটায় এবং ঘাড় মটকিয়ে দেয়। এরমধ্যে ছিলেন ক্যান্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজ থেকে সেই সময় এসএসসি পাশকরা বর্তমানে একই কলেজের একাদশ শিক্ষার্থী মাহদি হাসান অনিক এবং রুশান।

Abu-Sayed9

মাহদি হাসান অনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমরা সেদিন ক্যাফে ৬৬ এলাকায় ক্যান্টের শতাধিক শিক্ষার্থী একত্রিত হই। এরপর মিছিল নিয়ে জিলাস্কুল মোড়ে আসি। সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছিলেন। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পথে বেশ কয়েকবার এসি আরিফের নেতৃত্বে আমাদের মিছিল আটকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। ক্যাপ্টেন ব্যাকোলোজি মোড়ে পুলিশ কৌশলে কিছু শিক্ষার্থীদের এগিয়ে দিয়ে পেছনের শিক্ষার্থীদের বাঁধা দেয়। পুলিশের দুইজন আমাকে ধরে ফেলে। আমার ঘাড়ে হাত পেচিয়ে দেয়। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। তবুও আমি ছোট মানুষ হওয়ায় কায়দা করে পুলিশের হাত থেকে বের হয়। পুলিশ আবারও আমাকে ধরার চেষ্টা করে। আমি তখন দৌঁড়ে মিছিলের সামনে যাই। এসময় তারা রুশানসহ আরও একজনকেও এভাবে ঘাড় মটকায়। শুরু থেকেই পুলিশ আমাদের ওপর মারমুখি ছিল।'

Abu-Sayed-Beaten

Abu-Sayed-Beaten2

ক্যাপ্টেন মোড়ে বাঁধা ডিঙ্গিয়ে মিছিল চলে গন্তব্যের পথে। পথিমধ্যে আবারও প্রেস ক্লাবের সামনে আসলে পুলিশ বাঁধা দেয়। এ সময় সেখানে বসে মিছিল দিতে থাকেন তারা। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা ছাত্রীরা পুলিশের সামনে এসে বাঁধা দেয়ার কারণ জানতে চায়। শুরু হয় তর্কাতর্কি। পুলিশের বাঁধা পেরিয়ে মিছিল এগিয়ে যায় সামনে শাপলা, খামারমোড় হয়ে লালবাগের দিকে। লালবাগে গিয়ে ওই মিছিলে যোগ হয় আবু সাঈদসহ রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কারমাইকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গাছের ডাল ভেঙ্গে হাতে নেয়।

বিক্ষোভ নিয়ে পার্কের মোড়ের দিকে এগুতে থাকা তারা। মিছিলটি পার্কের মোড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১নং গেটের সামনে গিয়ে অবস্থান নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করে। শিক্ষার্থীরা উপস্থিত শিক্ষক ও পুলিশের উদ্দেশ্যে বলেন, পুলিশ ক্যাম্পাসে কেন। আমরা ক্যাম্পাসে ঢুকবো। এ নিয়ে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে শুরু হয় তর্ক-বিতর্ক। মুহূর্তেই সেখানে উপস্থিত কয়েকশ পুলিশ লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড মেরে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে পুলিশ।

Abu-Sayed3

এ সময় ১নং গেটের সামনের সড়কের পুর্বপার্শ্বে দোকানের সামনে অবস্থান নেয় আবু সাঈদ। এসময় সাঈদের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে ৪/৫ জন পুলিশ সদস্য বেধড়ক পেটায়। সেসময় সাঈদের মাথা ও মুখ দিয়ে রক্ত পড়তে দেখা যায়। তার পাশে ছিলেন এক শিক্ষার্থী। পুলিশের পিটুনিতে তিনিও আহত হন। তিনি রংপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের চতুর্থবর্ষের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন পৃথিবী।

Abu-Sayed4

পৃথিবী নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমার মিছিল নিয়ে এসে ১নং গেটের সামনে ছাত্রীদের বসিয়ে দেই। এরপর আবু সাঈদসহ অন্যান্য সমন্বয়করা পুলিশেদের সাথে কথা বলেন। তাদের দাবি ছিল ক্যাম্পাসের ভিতরে যাওয়া। যে ছাত্ররা বাইরে থাকবে না। ভিতরে যাবে। পুলিশকে বাইরে আসতে হবে। এনিয়ে শুরু হয় তর্ক। এক পর্যায়ে পুলিশ আমাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। এ সময় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও প্রশাসনের লোকজনও আমাদের ওপর হামলা করে। তখন আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই।’

এ সময় পুলিশ আবু সাঈদকে গেট থেকে মারতে মারতে সড়কের পূর্বপাশে সর্দারপাড়া ঢোকার প্রবেশের পাশের দোকানের সামনে আনে। ৪/৫ জন পুলিশ ওকে বেধড়ক মারতে থাকে। তখন ওর মাথা, হাত মুখ ফেটে যায়। রক্ত ঝড়তে থাকে। এ সময় পুলিশের পিটুনিতে আমিও আহত হই। কিছুক্ষণ পর আমরা আবার পুলিশের বিরুদ্ধে ঢিল ছুড়তে ছুড়তে ক্যাম্পাসের গেটের দিকে এগুতে থাকি। তখন সাঈদও আমাদের সাথে গেটের সামনে যায়। তখন পুলিশ একটু পিছু হটে। পরে আবারও পুলিশের গুলি, টিয়ারশেল ছুড়তে শুরু করে। তখন আমি আবু সাঈদকে বলি তোর মাথা ফেটে গেছে তুই আয় আমরা চলে যাই। কিন্তু সাঈদ আসে না। সে গেটের সামনে একাই দাঁড়িয়ে যায়। দুই হাত প্রসারিত করে রাখে।
Abu-Sayed7

Abu-Sayed15

দুপুর ২টা ১৭ মিনিটে খুব কাছে থেকে পরপর গুলি ছুড়তে থাকে পুলিশ। একটা গুলি লাগার পর আবারও দুই হাত প্রসারিত করে। তখন পুলিশ আবারও গুলি ছুড়ে। এরপর বুকে হাত দিয়ে বসে রোড ডিভাইডারের ফাঁক দিয়ে পূর্বপাশে গিয়ে বসে পড়েন সাঈদ। ওই সময় একজন পুলিশ অফিসারকে বলতেও শোনা যায় এতো কাছাকাছি থেকে শুট না করতে। কিন্তু তার আগেই নিরস্ত্র সাঈদকে গুলি করা হয়। এ সময় তাকে পাঞ্জাবী পড়া এক শিক্ষার্থী প্রথমে রেসকিউ করে সামনে নিয়ে যান। ওই শিক্ষার্থী রংপুর আরসিসিআই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী। নাম সিয়াম আহসান আয়ান। গুলির ভাইরাল হওয়াদৃশ্য ধারণ করেন যমুনা টেলিভিশনের রংপুর ব্যুরো অফিসের ভিডিও জার্নালিস্ট আলমগীর হোসেন।

আয়ান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘যখন সাঈদ ভাই বসে যায়। তখন আমি ১৫ হাত দূরে ছিলাম। সাথে সাথেই তার কাছে যাই। তাকে তুলে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। যখনই আনার চেষ্টা করছি। তখনই দেখি একজন পুলিশ আবারও আমাদের দিকে গুলি তাক করে আছে। তখন আমি ভাইকে অন্যপাশে নেই। এর মধ্যে গুলি এসে আমার গায়ে লাগে। আমি তখন দুর্বল হয়ে পড়ি। তখন ভাই আমার হাত থেকে পড়ে যায়। এরপর আরও কয়েকজন আসলে আমরা ভাইকে নিয়ে পার্কের মোড়ের দিকে যেতে থাকি। সেখানে অন্যভাইরা আসলে তাদের হাতে ভাইকে দিয়ে আমরা আবার প্রতিরোধ গড়ে তুলতে গেটের দিকে আসি। ’

যমুনা টেলিভিশনের ভিডিও ধারণকারী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘আমরা সেদিন সকাল ১০ টা থেকে আন্দোলন ফলো করতে থাকি। জিলা স্কুল মোড় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট পর্যন্ত। যখন আবু সাঈদকে গুলি করা হয়। তখন তার ৮ হাত দূর থেকে আমি ক্যামেরা অপারেট করছিলাম। যখন দেখলাম সবাই চলে গেলে শুধু আবু সাঈদ সেখানে আছে। এবং হাত তুলে আছে। তখন প্রথমে তাকে আমি ফোকাস করি। আমি দেখলাম। আমার ডান পাশে গেটের সামন থেকে পুলিশ তাক করেছে । শ্যুট করা মাত্রই সাঈদ এবং পুলিশকে বার বার ফোকাস করি। পরপর গুলি হয় কয়েকটি। একটা গুলি লাগার সাথে সাথে আমি বলি গুলি খাইছে গুলি খাইছে একটা। যেটা আমার ক্যামেরাও রেকর্ড হয়। পরে সে ডিভাইডারের পাশে চলে যায়। সেখানে একজন তাকে প্রথমে ধরে। পরে আরও বেশ কয়েকজন আসে। আমি যতদূর জুম করতে পারি ক্যামেরা। সেটা ধারণ করি।’

Abu-Sayed11

সাঈদকে কেউ হাত কেউ পা, কেউ শরীর ধরে পার্কের মোড়ে নিয়ে যায়। তখন সেখানে কোনো রিকশা ছিল না। একটি রিকশাকে জোড় করে এনে সাঈদকে তিনজন শিক্ষার্থী রিকশায় উঠিয়ে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। তারা হলেন- মাহিগঞ্জ কলেজের শিক্ষার্থী নিপুর রায়, ইমেজ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী সাজু বাসেফোর এবং রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী সাঈদের সিনিয়র সহপাঠি কবিরুল হাসান মিজু।

Abu-Sayed12

Abu-Sayed2

কবিরুল হাসান মিঠু বলেন, ‘সাঈদ গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় আমি পার্কের মোড়ে ছিলাম। আয়ানরা আমাদের হাতে সাঈদকে দেয়। আমি নিপুন ও সাজু বাশফোরসগ তাকে পার্কের মোড়ের রিকশা স্ট্যান্ডে নিয়ে আসি। সেখানে তখন একটি মাত্র রিকশা ছিল। রিকশা চালক সালামের মোড়ের দিকে পালাচ্ছিলেন। আমি দৌঁড়ে গিয়ে রিকশা চালকের কাছ থেকে রিকশাটি নিজে নিয়ে এসে সাঈদকে রিকশায় উঠাচ্ছিলাম। তখন রিকশা চালক আবার আসে। আমরা সামনে যেতে থাকি। আমি সাঈদ বলে বেশ কয়েকবার ডাক দিলাম। তার কোন সারাশব্দ ছিল না। তার পুরো শরীর ছররাগুলিতে ভরা। টি শার্টটা উপরে উঠে ছিল। মুখ ও পুরো শরীর দিয়ে রক্ত পড়ছিল। আমার ধারণা সে পার্কের মোড়েই মারা যায়।

আমরা তখন রিকশায় সাঈদ ও চালকসহ ৫ জন। রিকশাটি সামনে এগুচ্ছিল না। আমি কৃষি অফিসের সামনে গিয়ে নেমে তাদেরকে হাসপাতালের দিকে পাঠিয়ে আবার আন্দোলনে যোগ দেই।

আবু সাঈদকে বহনকারী ইমেজ পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী সাজু বাসফোর বলেন, মিজু নেমে যাওয়ার পর আর কিছুদুর গিয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেই দ্রুত হাসপাতালে নিতে হলে রিকশায় হবে না অটো রিকশা নিতে হবে। তাই ওই রিকশা ছেড়ে দিয়ে একটি অটোরিকশা নেই। তখন পুরো শহরে আন্দোলন। তাই অটোটি জীবনবীমা মোড় হয়ে থানার সামন দিয়ে আমরা হাসপাতালে নিয়ে যাই। পুরো পথে যাওয়া সময় আমি এবং নিপুন রায় সাঈদকে একাধিকবার ডাকাডাকি করেছি। কিন্তু সে কোন সারা দেয়নি। পার্লস মাপারও কোনো সুযোগ ছিল না। তার পুরো শরীর নিথর অবস্থায় ছিল। তার মাথা আমার কোলে ছিল। সে রাস্তায় কোনো কথা বলেনি। তার চোখে মুখে কানে এবং পুরো বুক জুড়ে রক্তাত্ব অবস্থা। গুলিগুলো ভেতরে ঢুকেছে। রক্তগুলো শিশিরের বিন্দুর মতো জমাট হয়ে গেছে। আমরা যখন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে গেলাম। তখন ডাক্তার বললেন ভর্তি করাতে হবে। আমরা তখন তাকে উপরে ইসিজি রুমে নিয়ে গেলাম। তখন সেখান থেকে বলা হলো আবু সাঈদ মারা গেছে। তখন সময় বেলা ৩টা ৫ মিনিট।

সাজু বাসফোর বলেন, ‘আবু সাঈদের হত্যাকাণ্ড নিয়ে অনেকেই বলেন, সে চার ঘণ্টা ছিল না বলে প্রচারণা চালানো হয়। যা পুরোটাই মিথ্যা। কারণ ২টা ১৭ মিনিটে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ইসিজি রুমে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করেন। তখন বাজে ৩টা ৫ মিনিট। পার্কের মোড় থেকে ওই অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে ৪০ মিনিট লাগাটা খুবই স্বাভাবিক। অনেকেই তাকে শিবিরের ট্যাগ দিয়েছে। নানা কথা বলেছে। এসব মিথ্যা।’

লাশ যখন জরুরি বিভাগের মেডিক্যাল অফিসারের রুমের সামনে আনা হয় । তখন সেখানে উপস্থিত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদ, একাউন্টিং বিভাগের শিক্ষক শাহিনুর রহমান ও ওমর ফারুক, সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নুরুল্লাহ। এ সময় ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া নিয়ে দেরি হওয়ার শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হন। পরে হাসপাতালের স্ট্রেচারে করেই তারা লাশ ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা।

Abu-Sayed13

হাসপাতালে যাওয়া রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একাউন্টিং বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক শাহিনুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘১৬ জুলাই যখন ক্যাম্পাসের সামনে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হচ্ছিল। তখন আমরা চারজন শিক্ষক পার্কের মোড়ে ছিলাম। তখনই খবর পেলাম আমাদের একজন শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তার অবস্থা খুবই খারাপ। এটা শোনার পর আমরা চারজনই হাসপাতালের দিকে রওনা হই। গ্র্যান্ড হোটেল মোড়ে যখন, তখন খবর পেলাম ওই শিক্ষার্থী মারা গেছেন। তখন সবাই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। দ্রুত হাসপাতালে যাই। জরুরি বিভাগে যাওয়া মাত্রই দেখি স্ট্রেচারে করে তার লাশ নামিয়ে আনা হয়েছে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের কাজে ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য চেষ্টা করছিলেন। দিতে বিলম্ব হওয়ায় তারা হাসপাতালের স্ট্রেচারে করেই লাশ নিয়ে ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। আমি এম্বুলেন্সের কথা বললে তারা আমাকে জানায়, আমরা চাই সারা পৃথিবী দেখুক। আমরা হেটেই তার লাশ নিয়ে যাবো। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল, আর কিছুই বলার উপায় ছিল না।’

এ দিকে স্ট্রেচারে করেই লাশ নিয়ে বিক্ষোভ করতে করতে ক্যাম্পাসের সাথে এগুতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। তারা আমার ভাই মরলো কেন পুলিশ জবাব দে। আমার ভাই মরলো কেন ছাত্রলীগ জবাব দে। এ ধরণের বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকেন তারা।

লাশ হাসপাতাল থেকে বের করে নিয়ে যাওয়ার পর ডেথ সার্টিফিকেট দেয় কর্তৃপক্ষ। তাতে মৃত্যুর সময় উল্লেখ করা হয় ৩টা ৫ মিনিট। লাশ নিয়ে মিছিল করতে করতে তারা ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা রওনা দেয়। পুরো লাশ নিয়ে যাওয়ার ফেসবুক লাইভ করতে দেখা যায় এক শিক্ষার্থীকে। তিনি বারবার ফেসবুকে বলছিলেন। আমরা ক্যাম্পাসে লাশ নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা আসেন। পুলিশ আমাদের বাঁধা দিচ্ছে।

পরে দেখা যায় ডিসির মোড়ে এসে সহকারি পুলিশ কমিশনার আরিফুজ্জামান আরিফের নেতৃত্বে লাশ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বাঁধার মুখে তারা পারেননি। পরে ক্যাপ্টেন ব্যকোলোজি মোড়ে আসার আগেই রাস্তার একপাশ পুলিশ গাড়ি দিয়ে বেরিকেড দেয় এবং লাশ ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় শিক্ষার্থীদের সাথে তুমুল বাকবিতন্ডা ও ধস্তাধস্তি শুরু হয়। শিক্ষার্থীরা পুলিশের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শ্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে লাশ ছিনিয়ে নিয়ে পুলিশের গাড়িতে তোলেন। তখন কিছু শিক্ষার্থী গাড়িতে ওঠার চেষ্টা করেন। কিন্তু পুলিশ তাদের নামিয়ে দেন। পরে গাড়ি সামনে এগুতে থাকলে শিক্ষার্থীরা পুলিশের গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। তখন পুলিশ কৌশল করে গাড়ি ঘুরিয়ে আবারও কাচারীবাজারের দিকে টানতে থাকে। তখন শিক্ষার্থীদের গাড়ির পেছনে দৌঁড়াতে দেখা যায়।

লাশ হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ক্যাপ্টেন ব্যকোলোজি মোড়ে পুলিশ কর্তক ছিনতাই হওয়া পর্যন্ত ফেসবুক লাইভ করেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষাথী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আহসান হাবিব।

তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমরা লাশ ক্যাম্পাসে নিয়ে যাবো। যাতে লাশ নিয়ে কোনো রাজনীতি না হয় সেজন্য তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি লাইভ করা শুরু করি। আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল লাইভ দেখে যাতে শিক্ষার্থীরা আমাদের সাথে আসেন এবং ক্যাম্পাসে প্রস্তুতি নেন। কিন্তু আমরা যতই এগুতে থাকি। ততই আমাদের ঘিরে পুলিশ ফোর্স বাড়তে থাকে।’

‘এসি আরিফের নেতৃত্বে ডিসির মোড়ে আমাদের ওপর মারমুখি হয়ে উঠে এবং লাশ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের শক্ত অবস্থানের কারণে সেখানে কেড়ে নিতে পারেনি। আমরা পুলিশকে ফাঁকি দিয়ে এগুতে থাকি। কিন্তু ক্যাপ্টেন মোড়ে আসার আগেই পুলিশ রাস্তায় গাড়ি দিয়ে ব্লক দেয়। আমাদের সাথে অত্যন্ত মারমুখি হয়ে লাঠিচার্জ শুরু করে এবং জোড় করে আমাদের শহীদ সাঈদের লাশ পুলিশের গাড়িতে তোলে। কিছু শিক্ষার্থী লাঠিচার্জের পরেও পুলিশের গাড়িতে উঠার চেষ্টা করে। আরেক দল গাড়ির সামনে শুয়ে পড়ে। কিন্তু তখন পুলিশ চালাকি করে গাড়ি ব্যাক দিয়ে ডিভাইডারের ফাঁক দেয় মেডিক্যালের দিকে দ্রুত গতিতে চলে যায়। সেখানে বেরিকেড দেয়ার চেষ্টা করি কিন্তু পাই না। এইপুরো ঘটনাটি আমি লাইভ করি। আমি লাইভের এসি আরিফের কাছে জানতে চেই কেন লাশ কেড়ে নিচ্ছে। এ সময় আমি তার হেলমেট খুলে দেয়ার চেষ্টা করি। তিনি আমাকে শারীরিকভাবে টর্চার করেন।’

এদিকে সাঈদের মৃত্যুর খবর শোনার পর ক্যাম্পাসের সামনে বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করেন। আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, তাতী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং বিশ্ববিদ্য্যালয়ের প্রশাসনিক দায়িত্ব প্রাপ্ত শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীরা হেলমেট ও মুখে গামছা বেঁধে রামদা, বেকি, আগ্নেয়াস্ত্রসহ বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। তাদের সাথে পুলিশও হামলে পড়ে। শিক্ষার্থীরা গাছের ডাল ও লাঠি দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কিন্তু তারা পুলিশের টিয়ারশেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও গুলির সামনে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারছিল না। দফায় দফায় চলে এই সংঘর্ষ। পরে বিকেল ৫টার পর পুলিশ ও সরকারদলীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসেনের লোকজন পিছু হটে। শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে বিভিন্ন হলে ভাঙচুর চালায়। ছাত্রলীগ নেতার কারে আগুন দেয়। এবং ভিসির বাংলোয় আগুন দেয়। পুলিশ ও র‌্যাবের লোকজন বাংলোয় আটকে পড়া তৎকালীন ভিসি, তার সহধর্মীনি ও অন্যান্যদের সেখান থেকে উদ্ধার করে নিরাপদে নিয়ে যায়। এরপর এ ঘটনার জেরে মডার্ন মোড়, লালবাগ, দর্শনাসহ নগরীর সব প্রান্তে হাজার হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে।

এ দিকে হাসপাতালে ময়না তদন্ত নিয়ে পুলিশ বিভিন্ন ধরণের নাটক মঞ্চস্থ করে। ময়না তদন্তের পর লাশ নিয়ে ১২টায় পীরগঞ্জের বাবনপুরের উদ্দেশ্যে রওয়া দেয় ২০-২৫টি আইনশৃঙখলা বাহিনীর গাড়িবহর। ক্যাম্পাসে নিতে দেয়া হয় না। বাবনপুরে গিয়ে রাতেই দাফন করার জন্য ব্যাপক চাপ তৈরি করে প্রশাসন। কিন্তু পরিবারের বাঁধার মুখে সেটা করতে পারেনি।

পুলিশের সেই লাশবাহী বহরের সাথে কয়েকজন শিক্ষার্থীর পাশাপাশি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষক ড. তুহিন ওয়াদুদও ছিলেন।

ড. তুহিন নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘১৬ তারিখ দুপুর বেলা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত আবু সাঈদের লাশ যে আমাদের দেয়া হয়নি। এটা খুবই অসৎ উদ্দেশ্যেই দেয়া হয়নি। আমরা মনে করি ওই সময় সরকারের কোনো খারাপ অভিপ্রায় ছিল। ফলে লাশ নানা নাটকিয়তার মাধ্যমে আটকে রাখা হয়েছিল। রাত ১২টার সময় যখন মর্গ থেকে রওনা করি। তখন পুলিশের অনেকগুলো গাড়ি, র‌্যাবের গাড়ি ছিল। আমি ছিলাম আমার সাথে কয়েকজন ছাত্র ছিলেন। আমরা চেয়েছিলাম, ইংরেজি বিভাগের ভাড়া করা এম্বুলেন্সে করে যেতে। সেটাতে তারা যেতে দেয়নি। আমরা চেয়েছিলাম আবু সাঈদের লাশ ক্যাম্পাসে শেষবারের মতো নেয়া হোক। সেটাও নিতে দেয়া হয়নি। পথিমধ্যে একটি পেট্রোল পাম্পে লাশ আটকে রাখা হয়েছিল অনেকক্ষণ। আমরা উচ্চবাচ্য করলে তারপর ওখান থেকে রওনা করে। পরে আবু সাঈদের বাড়ির পাশের বাজার পর্যন্ত প্রায় ২০-২৫টি গাড়ির বহর গেছে। তারা রাতেই দাফন করার জন্য বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে। পরে পরিবার ও এলাকাবাসী বিশেষ করে আবু সাঈদের বড় ভাই রহমান আলীর প্রবল বাঁধার মুখে তারা রাতে দাফন থেকে পিছু হটে। কিন্তু ওখান থেকে প্রশাসনের একজন লোকও আবু সাঈদের বাড়ি যায়নি। শুধু আমি গিয়েছি। আমার সাথে কয়েকজন স্টুডেন্ট গিয়েছে। আমরা সাঈদের লাশ তার বাড়িতে নিয়ে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি মায়ের নিদারুণ আহাজারি, দেখার মতো নয়। বাবা চোখ পাথরের মতো হয়ে আছে। মনে হয় যেন তিনি মৃত মানুষ বসে আছেন। আবু সাঈদের বোন সুমি আমার হাত ধরে করুণ করে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘স্যার পুলিশোক কইলেন হয়, হামার চাকরি না নাগিল হয় স্যার। হামার ভাইটার গুলি করিল না হয়ম হামার ভাইটা থাকিল হয়।’ এরকম সেখানে করুণ একটা আবহ ছিল। তারপর সাঈদের লাশ চৌকিতে তুলে মশারি দিয়ে ঘিরে আমি রংপুরের বাসায় ফিরি। যখন ফিরি তখন মানুষ ফজরের নামাজ পড়ে বাড়িতে ফিরছে।’

Abu-Sayed14

আবু সাঈদের লাশের গোসল করিয়েছিলেন তার ছোট চাচা মনজুর হোসেন। সাথে ছিলেন সোহরাব নামের এক এলাকার ভাই।

মনজুর হোসেন নয়া দিগন্তকে বলেন, ‘আমার এক চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে সার্কেল অফিসার, ওসি, চেয়ারম্যানসহ বহু আলোচনার পর তারা লাশ দেয়। রাতেই মাটি দেয়ার জন্য চাপ দেয়। কবর খোড়া, গোসল দেয়া, কাপড় তারা নিজেরাই আনেতে চায়। কিন্তু আমরা অনড় থাকার কারণে তারা পারে নি। পরে রাত ২ টার দিকে তারা লাশ নামায় দেয়। আমি সাঈদের গোসল করাই। সোহরাব পানি ঢালে আর আমি গোসল করাই। যখন গোসল করাই তখন দেখি মুখের ডানপাশে থেতলানো। মাথার পেছনে গর্তের মতো। নাভির নীচ থেকে গলা পর্যন্ত ছোট ছোট অসংখ্য গুলি। কোমড়ের ওপরে ডানপাশে গোশত উঠে যাওয়া। পরের দিন ১৭ জুলাই স্থানীয় জাফরপাড়া কামিল মাদরাসা মাঠে দুই দফায় নামাজে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। অনেক মানুষ জানাজায় আসতে পারেনি। ফিরে গেছে।’

মনজুর হোসেন আরো বলেন, ‘দাফন শেষে দোয়া করেছিলেন এখানকার এক ভাই। তার রজ্জব আলী। তিনি দোয়ার সময় সরকারের সমালোচনা করায় তাকে মামলায় ফাসানো হয়। দাফনের পর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পুলিশ কবর পাহাড়া দেয়। এবং বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস দিয়ে সব সময় পরীক্ষা নিরীক্ষা করতো। আমরা খুব ভয়ের মধ্যে ছিলাম।’

আবু সাঈদের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক রংপুর মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. রাজিবুল ইসলাম বলেন, সাঈদের শরীরজুড়ে ছররা গুলির চিহ্ন ছিল। গুলি ঢুকে তাঁর শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অংশে গর্ত তৈরি করেছিল। এতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফলে মৃত্যু হয় তার। তাছাড়া, তার খাদ্যনালি ও ঊরুর রক্তনালিতেও জখমের কারণে রক্তজমাট বেঁধে গিয়েছিল।

ডা. রাজিবুল ইসলাম আরো বলেন, ফরেনসিক টার্মে ছররা গুলি ১০ থেকে ৩০ মিটার দূর থেকে করা হলে সেটাকে আমরা লেথাল বলি। ১০ মিটারের দূর থেকে গুলি করায় তার শরীরের ভেতরের কিছু অঙ্গ ফুটো হয়ে গিয়েছিল। ফলে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই মৃত্যু হয় তার। এটি নি:সন্দেহে একটি হত্যাকাণ্ড। প্রত্যেকটি বিষয়ের ছবি রয়েছে। আদালতে এ বিষয়ে সবকিছু আরো জোড়ালোভাবে স্পষ্ট করব।

Abu-Sayed-Postmortem-Report

তিনি বলেন, তবে আবু সাঈদের মাথার বাঁ দিকেও আঘাতের কারণে রক্তজমাট হয়ে ছিল। সেটি পড়ে গিয়ে বা অন্য কোনো কারণে হতে পারে। তবে এটি মৃত্যুর কারণ নয়। গুলি করা না হলে আবু সাঈদ মারা যেতেন না।

তিনি বলেন, গত বছর ৩০ জুলাই মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে এই প্রতিবেদন দেয়া হয়েছিল । এরপর থেকে বিভিন্নভাবে আমাকে চাপ দেয়া হচ্ছিল। দেশের অবস্থা টালমাটাল ছিল। সরকারও খুব এগ্রেসিভ ছিল। বার বার চাপ দেয়া হচ্ছিল যাতে আমি তাদের মতো করে প্রতিবেদন দেই।

Abu-Sayed10

ডা. মো. রাজিবুল ইসলাম বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনটি না বুঝে অপব্যাখ্যা দিচ্ছেন। সেখানে বলা হচ্ছে হেড ইনজুড়িতে সাঈদ মারা গেছে। আসলে বিষয়টি সঠিক নয়। হেড ইনজুড়িতে কেউ মারা গেলে আমরা ইন্টার ক্রিডিয়াল হোমোরেজ অথবা ব্রনফ্যাচার লিখে থাকি। সাঈদের ক্ষেত্রে এই দু’টির কোনোটিই নেই। আমি উল্লেখও করিনি।

তবে আবু সাঈদের মৃত্যুর পর তার সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যজিস্ট্রেট আহামদ সাদাত ও কোতয়ালি থানার এসআই তরিকুল ইসলাম। তাতে সাঈদের সম্ভাব্য মৃত্যুর কারণ হিসেবে লেখা ছিল, মাথায় আঘাতের ফলে তার মৃত্যু হয়েছে মর্মে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মান হয়।

সাঈদ ছিলেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। তার বিরোচিত মৃত্যুর পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন মাত্রা পায়। ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী।
Abu-Sayed-Status

এ ঘটনায় প্রথমে পুলিশ শিক্ষার্থীদের দায়ি করে একটি মামলা করেন। গত বছর ১৮ আগস্ট রংপুর অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৭ জনের নাম উল্লেখ ও ১৩০ থেকে ১৩৫ জন অজ্ঞাতনামার নামে মামলা করেন বড়ভাই রমজান আলী। পরবর্তীতে গত ৯ অক্টোবর ওই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি, প্রক্টর, ময়না তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ৭ জনের নাম এজাহারে নথিভূক্ত করার আবেদন করেন বাদি। চলতি বছর ১৩ জানুয়ারি শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী ২৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেন। ২৪ জুন প্রসিকিউশনে প্রতিবেদন জমা দেয় তদন্ত সংস্থা। গত ৩০ জুন ভিসি, প্রক্টরসহ ৩০ জনের নামের অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইবুনাল। এর মধ্যে প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, এসআই আমির আলী, কনেস্টবল সুজন চন্দ্র রায়, ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরী, প্রক্টর অফিসের সাবেক রেজিষ্টার রাফিউল হাসান রাসেল ও মাস্টাররোল কর্মচারী আনোয়ার পারভেজ আপেলকে ট্রাইবুনালে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। বাকী ২৪ জনকে পলাতক দেখিয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের জন্য গত ১৩ জুন আদেশ দেয় ট্রাইবুনাল।