২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

লিবিয়ার যুদ্ধ সমীকরণ ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের খেলা

লিবিয়ার যুদ্ধ সমীকরণ ও আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তারের খেলা - ছবি : সংগ্রহ

লিবিয়ার যুদ্ধবাজ জেনারেল খলিফা হাফতারের রাজধানী ত্রিপোলি দখল অভিযান কার্যত ব্যর্থ হয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারি বাহিনীর প্রতিরোধে হাফতার বাহিনীর অগ্রযাত্রা থেমে যাওয়ার পাশাপাশি মিলিশিয়া বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে অনেক। এই অচলাবস্থায় হাফতার পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে যে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তাও হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে জাতিসঙ্ঘের নেয়া শান্তি প্রক্রিয়াকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজধানী দখলের অভিযান চালানো খলিফা হাফতার ও তার পৃষ্ঠপোষক দেশগুলো এখন যুদ্ধবিরতি ও শান্তি প্রক্রিয়া শুরুর ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।
আরব বসন্তে সিরিয়ার পর সবচেয়ে বিপর্যস্ত আরব দেশটির নাম হলো লিবিয়া। দেশটির বড় একটি অংশ মরুভূমি হলেও বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ তেল মজুদের কারণে লিবিয়া গাদ্দাফির আমলে অর্থনৈতিকভাবে প্রভাব বিস্তারকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি ছিল।

গাদ্দাফির পতনের পর সেখানে গণতান্ত্রিক রূপান্তর প্রক্রিয়া শুরু হলেও প্রভাবশালী আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপে এক ধরনের অরাজক অবস্থা সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন গোত্র ও মিলিশিয়া বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ সঙ্ঘাতে একেকটি অঞ্চলে একেক বাহিনীর আধিপত্য সৃষ্টি হয়। সর্বশেষ প্রধানত দুটি পক্ষের অধীনে লিবিয়া বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি পক্ষ জেনারেল ন্যাশনাল কংগ্রেস (জিএনসি) সরকার রাজধানী ত্রিপোলি, মিসরাতাসহ আশপাশের অঞ্চলে কর্তৃত্ব স্থাপন করে আছে। আন্তর্জাতিকভাবে এটিকে বৈধ সরকার মনে করা হয়। অন্য দিকে ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে নির্বাচিত হাউজ অব রিপ্রেজেন্টেটিভ মিসর সীমান্তের তবরুক অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটি সরকার গঠন করে। এ সরকারের কর্তৃত্ব মূলত স্বঘোষিত এলএনএ প্রধান খলিফা হাফতারের কাছে চলে যায়।

গাদ্দাফি আমলের এই জেনারেল প্রতিবেশী দেশ শাদে অভিযান চালাতে গিয়ে বন্দী হন। পরে আমেরিকান মধ্যস্থতায় সেখান থেকে মুক্তি লাভ করে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি ছেলেমেয়ে পরিবারসহ প্রায় দুই দশকব্যাপী বসবাস করেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বও লাভ করেন। গাদ্দাফির পতনের সময় তিনি আবার লিবিয়ায় ফিরে আসেন।
ত্রিপোলি সরকারের বিরুদ্ধে একটি সেনা অভিযান ঘটাতে ব্যর্থ হওয়ার পর তিনি তবরুক সরকারের সেনাবাহিনী পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেন। ৭৫ বছর বয়সী এ জেনারেলকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দেয় প্রতিবেশী মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ব্লুমবার্গ পত্রিকার এক বিশ্লেষণ অনুসারে, নেপথ্যে আমেরিকান সমর্থনও রয়েছে হাফতার বাহিনীর প্রতি, যদিও প্রকাশ্য মার্কিন সমর্থন ব্যক্ত হয় ত্রিপোলির জাতিসঙ্ঘ স্বীকৃত সরকারের প্রতি। জেনারেল খলিফা হাফতার নিজের কর্তৃত্ব বিস্তারে লিবিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তারকারী শক্তিগুলোর মধ্যে পরস্পরবিরোধী দেশগুলোর সাথে সমঝোতার চেষ্টা করেন। তিনি আগাগোড়া আমেরিকান পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেও একাধিকবার রাশিয়া সফর করে পুতিনকে রুশ ঘাঁটি ও তেলক্ষেত্রের সুবিধা দেয়ার অঙ্গীকার করে সমর্থন লাভের চেষ্টা করে বেশ খানিকটা সাড়াও পেয়েছেন।

হাফতারের ব্যর্থতা ও বাইরের সংযোগ
গত মাসে লিবিয়ার আন্তর্জাতিক-স্বীকৃত সরকার প্রতিদ্বন্দ্বী কমান্ডার খলিফা হাফতারের সমর্থনে মোতায়েন করা একটি হ্যাঙ্গার হাউজিংয়ের ড্রোনগুলোতে বিমান হামলা চালানোর কথা ঘোষণা করে। এর এক দিন পরে হাফতার বাহিনী জানিয়েছে, তারা ত্রিপোলি সরকারের সামরিক ঘাঁটিতে রাতে গোলাবর্ষণ করে হামলার প্রতিশোধ নিয়েছে।
উভয়পক্ষই আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তর আফ্রিকার এই রাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সবচেয়ে খারাপ গোপনীয় বিষয়টি স্বীকার করেনি। আর সেটি হলো উভয়পক্ষ যুদ্ধের গ্রাউন্ডে অচলাবস্থার মুখোমুখি হওয়ায় তুরস্ক এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের সমর্থকদের পক্ষে বিমান অভিযানে জড়িয়ে পড়েছে। আর তারা তাদের পক্ষে লিবিয়ার ভবিষ্যৎ খলিফা হাফতার লিবিয়ার ওপর তার শাসন প্রসারের লক্ষ্যে লড়াইয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লিবিয়া সরকারের প্রতি তার আগ্রাসী তৎপরতা বাড়িয়েছে। এর মধ্যে হাফতারের নেতৃত্বাধীন মিলিশিয়ারা লিবিয়ায় বসবাসকারী তুর্কি নাগরিককে টার্গেট করায় তুরস্ক ও লিবিয়ার মধ্যে সম্প্রতি উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে।

হাফতার তার বাহিনীকে তুরস্কের স্বার্থে আক্রমণ করার নির্দেশ দেয়ার মাত্র দু’দিন পরে, তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে, হাফতারের অবৈধ মিলিশিয়া বাহিনী ছয় তুর্কি নাগরিককে আটক করেছে। মন্ত্রণালয় আটক তুর্কি নাগরিকদের তাৎক্ষণিক মুক্তির দাবি করে বলেছে, তা যদি না করা হয় তবে হাফতারের উপাদানগুলো তুরস্কের বৈধ লক্ষ্যমাত্রায় পরিণত হবে। তুরস্কের প্রতিরক্ষামন্ত্রী হুলুসি আকারও হুঁশিয়ারি দেন যে, হাফতারের বৈরী মনোভাব বা আক্রমণের জন্য গুরুতর মূল্য দিতে হবে। সবচেয়ে কার্যকর এবং শক্তিশালী উপায়ে এর প্রতিশোধ নেয়া হবে।

ছয় তুর্কির আটকের বিষয়ে স্পষ্ট বক্তব্য দেয়ার পরিবর্তে, হাফতারের লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এলএনএ) ঘোষণা করে যে, তারা ত্রিপোলিতে এক হামলায় তুর্কি ড্রোন ধ্বংস করে দিয়েছে। এর পর অবশ্য তুর্কি নাগরিকদের মুক্তি দেয়া হয় এবং হাফতার বাহিনী বলে যে, তারা লিবিয়ায় তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারবে। ছয়জন পুরুষ নাবিক ও ক্রু তাদের জাহাজে ফিরে যায়।

প্রশ্ন হলো, তুরস্কের স্বার্থে আঘাত করার পেছনে হাফতারের কী উদ্দেশ্য রয়েছে? টিআরটি ওয়ার্ল্ড রিসার্চ সেন্টারের গবেষক ফেরাহাট পোলাট বলেছেন যে, অতীতেও তুর্কি জাহাজগুলোকে লক্ষ্য অর্জনের জন্য টার্গেট করা হয়েছিল। ২০১৫ সালে লিবিয়ার তবরুক উপকূলে একটি তুর্কি মালবাহী জাহাজে যুদ্ধবিমান এবং কামান দিয়ে আক্রমণ করা হয়েছিল, এতে একজন তুর্কি কর্মকর্তা নিহত হয় এবং ক্রুদের মধ্যে অনেকে আহত হয়েছিল। তুরস্কের প্রতি হাফতারের এই আগ্রাসী অবস্থান উভয়পক্ষের সম্পর্কে অবনতি ঘটায়।

তুরস্ক-আমিরাত প্রক্সি যুদ্ধ!
সর্বশেষ ঘটনা আসলে একটি জটিল প্রক্সি যুদ্ধের উপাদান বলেই মনে হয়। এই দ্বন্দ্বের মধ্যে অনেক আঞ্চলিক শক্তি জড়িত। ‘দ্বিতীয় লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত বর্তমান সঙ্ঘাত ২০১৪ সালে শুরু হয়। প্রথম গৃহযুদ্ধটি হয় যখন গাদ্দাফি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল। তখন উত্তর আফ্রিকার দেশটি বিভিন্ন মিলিশিয়ার খেলার মাঠে পরিণত হয়েছিল।
তুরস্ক লিবিয়ার নতুন সঙ্ঘাতে সমর্থন করেছে ইউএন স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ত্রিপোলির জাতীয় সরকারকে (জিএনএ)। তুরস্ক বারবার উল্লেখ করেছে, একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াই সঙ্কটের একমাত্র সমাধান এবং লিবিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বকে দেশটি অধিক গুরুত্ব দেয়।
অন্য দিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ফ্রান্স, রাশিয়া এবং মিসর হাফতার ও তার অবৈধ মিলিশিয়াদের সমর্থন করে। খলিফা হাফতার সম্পর্কে মার্কিন নীতিমালা বেশ সংশয়পূর্ণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক ফোনে তার পক্ষ সমর্থন করেছিলেন, তবে হাফতার চেষ্টা করার পরেও ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সাথে দেখা করতে পারেননি।

জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে, হাফতারের মিলিশিয়ারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিমান, সামরিক যানবাহন এবং অন্যান্য সরবরাহ পেয়েছিল, যা মিলিশিয়াদের নিয়ন্ত্রিত একটি অঞ্চলে বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করতে সহায়তা করেছিল। সৌদি-সংযুক্ত আরব আমিরাতের ব্লক হাফতারকে দেয়া কূটনৈতিক ও সামরিক সহায়তা তথাকথিত ‘চরমপন্থীদের’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে দিয়েছিল, যা এখন বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পাল্টা প্রয়াসের মতোই মনে হয়।
কার্যত হাফতার এবং তার স্বঘোষিত লিবিয়ান ন্যাশনাল আর্মি ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কায়রো এবং আবুধাবির উদীয়মান মিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ৭৫ বছর বয়সের গাদ্দাফি আমলের জেনারেল হাফতারকে একজন নির্মম কমান্ডার হিসেবে দেখা হয়, যে লোক তার অপছন্দের পরামর্শ কমই শোনেন। বলা হয়, হাফতারের জন্য ত্রিপোলি অভিযান তার টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য ছিল। হাফতার যখন লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নেন, তখনই অনেক সমর্থক জানতেন যে, তিনি ত্রিপোলি দখলে নিতে লড়াই করবেন।

লিবিয়ার বেশির ভাগ তেলক্ষেত্রের ওপর দখল কায়েমকারী হাফতারের একজন পরামর্শদাতা বলেছেন, জেনারেল হাফতার আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এ কারণে নিয়েছেন যে, তিনি বিশ্বাস করেন সররাজের ত্রিপোলি সরকার তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে একটি ক্ষমতা ভাগাভাগির চুক্তিতে যেতে চায় না। বরং ত্রিপোলি দখল করলে লিবিয়ার অর্থনৈতিক লাইফলাইন অপরিশোধিত রফতানির একক এখতিয়ার হাফতারের হাতে চলে আসবে। বিশেষত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ন্যাশনাল অয়েল করপোরেশনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এটি তার জন্য ভালো অবস্থান তৈরি করবে।
দেখা গেছে, আঞ্চলিক এবং ইউরোপীয় শক্তিগুলো বছরের পর বছর ধরে তেলসমৃদ্ধ দেশটিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করেছে। তবে গত এপ্রিল মাসে রাজধানী দখল করার জন্য হাফতারের আক্রমণাত্মক অভিযান বৈদেশিক হস্তক্ষেপে উদ্দীপনা জাগিয়ে তোলে। এটি সঙ্ঘাতকে দীর্ঘায়িত ও গভীরতর করেছে এবং আলোচনার ভিত্তিতে শান্তির সন্ধানের জন্য জাতিসঙ্ঘের প্রচেষ্টাকে কার্যত ব্যর্থ করে দিয়েছে।
ইসরাইলি নিরাপত্তা বিশ্লেষক ওদেদ বারকোভিটস এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি ওপেন সোর্স চিত্রের মাধ্যমে রাশিয়ার তৈরি ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপণযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র সিস্টেমের মোতায়েন দেখেছেন এবং তুরস্ক আর আমিরাতের বিভিন্ন ধরনের সাঁজোয়া যানবাহনও প্রত্যক্ষ করেছেন।

আঙ্কারার লিবীয় যুদ্ধে জড়িত হওয়া আংশিকভাবে বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণে। এক তুর্কি কর্মকর্তা গত মাসে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, লিবিয়ায় তাদের প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের নির্মাণ চুক্তি বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। দেশটি ভূমধ্যসাগরে এর কৌশলগত অবস্থানকে আরো জোরদার করতে চায়। তবে তুর্কি রাষ্ট্রপতি এরদোগানের ইসলামপন্থী একে পার্টির শাসিত তুরস্কের রাজনৈতিক এজেন্ডাও রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মিসর এবং আমিরাত উভয়ই যে রাজনৈতিক ইসলামকে ধ্বংস ও কোণঠাসা করার চেষ্টা করছে সে শক্তিকে সমর্থন করে তুরস্ক।

প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে আলজেরিয়ার সাথে হাফতার সমর্থক দেশগুলোর সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়। এর পরও আলজেরিয়ার নিজস্ব কিছু স্বার্থের গ্যারান্টি দিয়ে এক ধরনের সহাবস্থানের সম্পর্ক তৈরি করেছেন দেশটির দক্ষিণাঞ্চল দখল করার ক্ষেত্রে। প্রতিবেশী তিউনিশিয়া অবশ্য হাফতারের দখলাভিযানকে সমর্থন করেনি। ত্রিপোলি সরকারের পক্ষে এ প্রতিবেশী দেশের বাইরে শক্ত অবস্থান রয়েছে তুরস্ক ও কাতারের। এ দেশ দুটি এবং ইতালির সমর্থন না থাকলে ত্রিপোলি সরকারের পক্ষে হাফতার বাহিনীকে প্রতিহত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াত।

মধ্যপ্রাচ্যের মেরুকরণের প্রভাব
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতির সাম্প্রতিক যে মেরুকরণ তাতে সৌদি আরব, মিসর, আমিরাত মুসলিম ব্রাদারহুড ও ইরানের প্রভাবের বিরুদ্ধে বেপরোয়াভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে। এদের পক্ষে রয়েছে আঞ্চলিকভাবে শক্তিধর রাষ্ট্র ইসরাইল। সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলো তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব বহাল রাখতে ইসরাইলের সাথে নতুন মেরুকরণে যুক্ত হয়েছে। অন্য দিকে ইসরাইলের এজেন্ডা হলো আরব ও মুসলিম শক্তিগুলোকে বিবদমান রেখে সব আরব দেশকে নিরাপত্তার জন্য তার ওপর নির্ভরশীল করে তোলা। এই দুই স্বার্থ যেখানে একবিন্দুতে মিলেছে, সেখানে প্রতিপক্ষ প্রতিকূল অবস্থায় বেশি পড়েছে।
অবশ্য ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে বিবদমান শক্তিগুলোর কোনোটাকেই পুরোপুরি পরাজিত দেখতে চায় না। মিসরে আরব বসন্তের সময় মুসলিম ব্রাদারহুড ও অন্যান্য গণতান্ত্রিক ইসলামী শক্তিকে ক্ষমতায় যাওয়ার পথে বড়ভাবে বাধা তৈরি করেনি এই দুটি দেশ; কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার এক বছরের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানে মদদ দিয়ে ব্রাদারহুডের পুরো শক্তিকে নির্মূল করার কাজে জেনারেল সিসিকে মদদ দেয়া হয়েছে।
সিসির শক্তি যাতে কোনো বাধার মধ্যে না পড়ে তার জন্য মিসরের প্রতিবেশী সুদানে ব্রাদারহুডের প্রতি সহানুভূতিশীল ওমর আল বশিরের সরকারের পতন ঘটানো হয়েছে। ওমর আল বশিরের বিদায়ের সাথে একাধিক সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনা দেখিয়ে সেনা প্রতিষ্ঠান থেকে বহুসংখ্যক পদস্থ কর্মকর্তাকে বিদায় করা হয়; কিন্তু রাজপথে আন্দোলনকারী গণতান্ত্রিক শক্তি বেসামরিক শাসন প্রতিষ্ঠায় আন্দোলন অব্যাহত রাখায় সুদানের শেষ পর্যন্ত রাবা স্কোয়ারের পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে সিসি মার্কা সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। এক ধরনের ভারসাম্য সেখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দু’পক্ষের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে।

লিবিয়ায় জেনারেল খলিফা হাফতারের প্রকল্প সৌদি আমিরাত মিসর ইসরাইল বলয়ের পরিকল্পনার একটি অংশ। সুদানের মতো সেখানে প্রকল্পের আংশিক বাস্তবায়ন সম্ভব হয়েছে। পাল্টা শক্তির হস্তক্ষেপে রাজধানী দখলের সামরিক অভিযান মাঝামাঝি পৌঁছে আটকে গেছে। ইয়েমেন, সুদান ও লিবিয়ার সঙ্ঘাতে সংযুক্ত আরব আমিরাত মুখ্য ভূমিকা পালন করছে। দেশ হিসেবে কিছু দিন আগ পর্যন্ত ক্ষুদ্র প্রভাবের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত ইসরাইলের এজেন্ডা বাস্তবায়নে নিজেকে টুলস হিসেবে ব্যবহার করার মাধ্যমে নিজ শক্তি ও প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে।

দেশটির শাসকরা বেশ ক’বছর আগে থেকেই মুসলিম উম্মাহর এজেন্ডা পরিত্যাগ করে ইসরাইল এবং তার ঘনিষ্ঠ দেশ ও বলয়ের সাথে বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি করছে। মধ্যপ্রাচ্যে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ থেকে বেরিয়ে এসে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা এবং পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনের বৈধতাদানের ক্ষেত্রে অন্তরালে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে আমিরাত। আমিরাতের নিরাপত্তা বিধানের গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ইসরাইলি প্রতিষ্ঠানকে। যদিও দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক এখনো নেই মর্মে দেখানো হচ্ছে।

ফিলিস্তিন ইস্যুতে নজিরবিহীনভাবে ইসরাইলের কাছে আরব ও ইসরাইলি স্বার্থ সমর্পণের পর সংযুক্ত আরব আমিরাত কাশ্মির ইস্যুতেও মুসলিম উম্মাহর স্বার্থপরিপন্থী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ইসরাইলের সাথে দিল্লির বিশেষ কৌশলগত সম্পর্ক সৃষ্টির পর ভারতের সাথে আমিরাতও গড়ে তোলে বিশেষ কৌশলগত সম্পর্ক। কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন ও বিশেষ মর্যাদা সংবলিত ৩৭০ অনুচ্ছেদ সংবিধান থেকে বিদায় করার পর সেখানে দমননিপীড়নের ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার। মোদির এই পদক্ষেপ যখন বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়েছে, তখন আমিরাত নরেন্দ্র মোদিকে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত করেছে আরেক প্রতিবেশী বাহরাইনকে সাথে নিয়ে। ইসরাইলের সাথে বিশেষ সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে আমিরাত ও দেশটির ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন জায়েদ সৌদি আরবের নীতিকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।

ইসরাইলের সর্বাত্মক সমর্থনের পরও এ নীতি সাফল্য পাচ্ছে না ইয়েমেনে। সুদানে ও লিবিয়ায়ও প্রবল বাধার মধ্যে রয়েছে। আরব জনগণের মতের উল্টোপথে হেঁটে কেবল ইসরাইলের শক্তির ওপর ভিত্তি করে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টায় কতটা এগোতে পারবে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও তার মিত্র রাজতান্ত্রিক দেশগুলো- তাতে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। খলিফা হাফতারের আক্রমণাত্মক অভিযানের এখনকার ব্যর্থতা সেই সন্দেহকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

হাফতারের জন্য বিপর্যয়
হাফতারের বাহিনীর রাজধানীর প্রবেশদ্বারগুলোতে এসে স্থবির হয়ে থাকা এবং ক্রমবর্ধমান হতাহতের ঘটনা ঘটতে থাকার পাশাপাশি আক্রমণাত্মক কিছু দেখাতে না পারায় পূর্বাঞ্চলে তার দখল দুর্বল হতে পারে। এটি তার মিত্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি উদ্বেগজনক সম্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে।

গত জুনের শেষ দিকে হাফতারের জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি আসে। তিনি ত্রিপোলি থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণে ঘড়িয়ানে একটি অগ্রগামী অপারেশন বেস তৈরি করেছিলেন, যা অজেয় বলে মনে করা হয়েছিল। তুরস্কের ড্রোন সমর্থিত সররাজের প্রতি অনুগত বাহিনী একদিনে সেটিকে ধ্বংস করে দেয়। এলএনএ তুর্কি বিমানগুলোকে টার্গেট করার হুমকি দেয়ার পর এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় যুদ্ধটি যে একটি আঞ্চলিক সঙ্ঘাতে রূপ নিয়েছে তাই তুলে ধরেছিল। এরপর ত্রিপোলি সরকারের প্রকাশিত ছবিগুলোতে হাফতারের পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ইয়াভন নজরদারি ড্রোন, চীনা গাইডেড-মিসাইল এবং আমেরিকান জ্যাভেলিন অ্যান্টি-ট্যাংক সিস্টেম, ফরাসি অপারেশন সরঞ্জাম দেখা যায়। এই চিত্র দিয়ে সররাজের সরকার হাফতারের জন্য ফ্রান্সের সামরিক সমর্থনের প্রমাণ দেখিয়েছিল। যদিও প্যারিস দাবি করেছে যে, জ্যাভেলিন ক্ষেপণাস্ত্রগুলো অকার্যকর ছিল আর এগুলো ফরাসি সন্ত্রাসবাদবিরোধী দলের হাতে ছিল।

যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা
হাফতারের ত্রিপোলি অভিযানের এসব সংঘর্ষে এক হাজারেরও বেশি লোক মারা গেছে। ক্রমবর্ধমান মৃতের সংখ্যা ও অচলাবস্থার কারণে হাফতারের ওপর চাপ বেড়েছে। জাতিসঙ্ঘ এ মাসের ঈদুল আজহার ছুটির সময় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির জন্য আলোচনা করেছে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর একটি গ্রুপ আরো দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও আলোচনার আহ্বান জানিয়েছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাতও তাতে স্বাক্ষর করে। মিসরও যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব সমর্থন করেছে। আলোচনায় সরাসরি জড়িত আরব ও পশ্চিমা কূটনীতিকেরা বলছেন যে, উভয়পক্ষের আন্তর্জাতিক সমর্থকেরা দ্বন্দ্বের অবসান ঘটাতে চায়। কারণ এটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কোনো পক্ষই সহজে জিততে পারবে না।
লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘের বিশেষ দূত ঘাসন সালামে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, অনেক সামরিক পর্যবেক্ষক এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, লিবিয়ার দ্বন্দ্ব এমন এক সঙ্ঘাতে পরিণত হয়েছে, যার কোনোভাবেই চূড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। আমরা লিবিয়ানদের (হাফতারের বাহিনী) ওপর তারা খুব দ্রুত জিততে পারবে বলে বিশ্বাস করে চার মাস সময় নষ্ট করেছি। তবে এখন আমরা আরো বাস্তববাদী।

নতুন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, লিবিয়ার সঙ্কটের আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের এই প্রচেষ্টা এগোতে শুরু করবে। আসলে মধ্যপ্রাচ্যে এখন যেভাবে হানাহানি সঙ্ঘাত ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে গণতন্ত্র ও নিয়মতান্ত্রিক পরিবর্তন ছাড়া সঙ্কট সমাধানের কোনো পথ নেই। এই পথে এগিয়েছে তিউনিশিয়া। লিবিয়ার স্থিতিশীল ভবিষ্যতের জন্যও এর কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য আঞ্চলিক শক্তিগুলোর মধ্যেও সমঝোতা প্রয়োজন বিশেষভাবে। যেটি ইসরাইল ও তার মিত্র শক্তি হতে দিতে চায় না।
mrkmmb@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
আদমদীঘিতে ২৩০ চালকল বন্ধ : বেকার ৭ হাজার শ্রমিক সাকিবে উজ্জীবিত বাংলাদেশের লক্ষ্য সিরিজে সমতা কুলাউড়ায় জঙ্গল থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার ঈদগাঁওতে মাদককারবারি গ্রেফতার শিক্ষায় ব্যাঘাত : ফেসবুক-টিকটক-ইনস্টাগ্রাম-স্ন্যাপচ্যাটের বিরুদ্ধে ২৯০ কোটি ডলারের মামলা আমতলীতে কিশোরীকে অপহরণ শেষে গণধর্ষণ, গ্রেফতার ৩ মহানবীকে কটূক্তির প্রতিবাদে লালমোহনে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ক্রিমিয়া সাগরে বিধ্বস্ত হলো রুশ সামরিক বিমান জর্ডান আন্তর্জাতিক কোরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী বিচারক এবারের আইপিএলে কমলা ও বেগুনি টুপির লড়াইয়ে কারা সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে সন্ত্রাসনির্ভর হয়ে গেছে : রিজভী

সকল