২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘সরল বিশ্বাস’ নিয়ে অস্বচ্ছতা, কিছু কথা

- ফাইল ছবি

গত ১৮ জুলাই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান একটি বক্তব্য রেখেছিলেন সাংবাদিকদের সামনে। বলেছিলেন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘সরল বিশ্বাসে’ কৃতকর্ম কোনো অপরাধ নয়। তবে প্রমাণ করতে হবে যে সরল বিশ্বাসেই আপনি কাজটি করেছেন। তার এই বক্তব্য অনেক পত্রিকায় একটু ঘুরিয়ে উপস্থাপন করা হয়। কিছু রিপোর্টে তার উচ্চারিত ‘কৃতকর্ম’ শব্দটি পাল্টে দিয়ে সেখানে ‘দুর্নীতি’ শব্দটি বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এর ফলে শুরু হয় তোলপাড়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে রীতিমতো ঝড় ওঠে। দুদক চেয়ারম্যানকে তুলোধুনা করেছেন অনেকে। নানারকম ব্যঙ্গবিদ্রƒপ, হাসি-মশকরা, কটাক্ষ-কটুবাক্যে ভরে ওঠে ফেসবুকের দেয়াল। এমনকি সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীও পরের দিন এ বিষয়ে বক্তব্য রাখেন।

ফেসবুক হলো নানা ধরনের মানুষের এক মহামিলনস্থল। এখানে স্বল্পশিক্ষিত মানুষ যেমন আছেন, তেমনি উচ্চশিক্ষিতরাও আছেন। রুচিবান-রুচিহীন, আদর্শবান-আদর্শহীন, রাজনীতি সচেতন-অসচেতন, সরল-জটিল সব ধরনের মানুষই আছেন এখানে। তারা নিজেদের শিক্ষা, মেধা, জ্ঞান-প্রজ্ঞা, রুচি, যোগ্যতা, রসবোধের ভিত্তিতেই নানা রকম পোস্ট দিয়ে থাকেন। দুদক চেয়ারম্যানের বক্তব্য নিয়ে বেপরোয়া বিরূপ সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে একজন ফেসবুকার হিসেবে আমি নিজেও সামান্য কিছু কথা লিখেছিলাম নিজের ওয়ালে। সেখানে তার বক্তব্য যে বিকৃত করা হয়েছে এবং তিনি আসলে যেটা বলেছেন সেটা যে আইনের দৃষ্টিতে যথার্থ, এই কথাটা বলতে চেয়েছি। টুইস্ট বা বিকৃত যারা করেছেন, তাদের কাজটি ঠিক হয়নি এবং এতে সাংবাদিকতার মান ক্ষুণœ হয়েছে, এটাও বলতে চেয়েছি। কিন্তু আমার বক্তব্য অনেকেরই পছন্দ হয়নি। একজন ফেসবুক বন্ধু তো আমাকে ‘আনফ্রেন্ড’ পর্যন্ত করে দিয়েছেন।

আমার একজন ফেসবুক বন্ধু যিনি সাহিত্যে ডক্টরেট করা অধ্যাপক, তিনিও মেসেঞ্জারে মেসেজ দিয়ে বলেছেন, ‘সরল বিশ্বাসে অপরাধ নেই- ব্যাখ্যাটা মোটেও বুঝে আসছে না।’ একজন ডক্টরের কাছেও যদি বিষয়টি এতটা অস্পষ্ট হয়ে থাকে তাহলে সাধারণ মানুষের অন্ধকারে থাকা কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নয়।

তখনই ভেবেছি, সাধারণ পাঠকের জন্য এ বিষয়টি নিয়ে কিছু লেখা দরকার। এরই মধ্যে চ্যানেল আই অনলাইনে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে এ বিষয়ে। তাতে বলা হয়েছে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, ‘পেনাল কোড (সিআরপিসি) অনুযায়ী, সরকারি চাকরিজীবীদের সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম কোনো অপরাধ নয়। এটাকে বলে জেনারেল একসেপশন। কিন্তু এখানে শর্ত আছে, সরল বিশ্বাসটা যেন উইথ কেয়ার অ্যান্ড কসাস হয়। আপনাকে প্রমাণ করতে হবে যে, সরল বিশ্বাসে আপনি এ কাজটি করেছেন।’
তার বক্তব্যের সূত্র ধরে বিভিন্নমুখী আলোচনায় সাধারণের মনে প্রশ্ন : সরল বিশ্বাস মানে কী?

বিষয়টি নিয়ে চ্যানেল আই অনলাইন বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীদের সাথে কথা বলেছে। তারা বলছেন, পেনাল কোড অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের কৃতকর্ম কোনো অপরাধ নয়। তবে সরল বিশ্বাসে দুর্নীতিতে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম আর সরল বিশ্বাসে দুষ্কর্ম দু’টি ভিন্ন বিষয়। জেনারেল ক্লজেস অ্যাক্ট ৩ (২০) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সততার সাথে সরল বিশ্বাসে কোনো কার্য সম্পাদন করা হয়েছে, যা কিনা অবহেলাজনিত কারণে হতে পারে অথবা নাও হতে পারে।’

হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন : দুদক চেয়ারম্যান যদি পেনাল কোডের কথা উল্লেখ করে বলে থাকেন যে, ‘সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম কোনো অপরাধ নয়’ তাহলে ঠিক আছে, এটা আইনের মধ্যে আছে। আর ‘সরল বিশ্বাসে দুর্নীতিতে জড়ালে’ যদি এভাবে তিনি বলে থাকেন তাহলে বলব, সরল বিশ্বাসে দুর্নীতিতে জড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। তিনি যদি হুবহু এ কথা বলে থাকেন, এটাই একটা ক্রিমিনাল অফেন্স। এটা দুর্নীতিতে উৎসাহ দেয়ার মতো, এটা খুবই অনাকাক্সিক্ষত এবং ভুল আইনি ব্যাখ্যা।

তামাদি আইনের ২ (৭) ধারায় সরল বিশ্বাসের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘যদি যথাবিহিত যতœ ও মনোযোগসহকারে কোনো কাজ না করা হয়, তাহা হইলে সরল বিশ্বাসে করা হইয়াছে বলিয়া বুঝাইবে না।’ দণ্ডবিধির ৫২ ধারায় সরল বিশ্বাসের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “যথাবিহিত সতর্কতা ও মনোযোগ ব্যতিরেকে কিছু করা হইলে বা কোনো কিছু বিশ্বাস করা হইলে তাহা ‘সরল বিশ্বাসে’ করা হইয়াছে বা তাহাতে সরল ‘বিশ্বাসে’ বিশ্বাস করা হইয়াছে বলিয়া বিবেচনা করা হয় না।” দণ্ডবিধির ৭৬ ধারা অনুসারে কোনো ব্যক্তি আইনবলে কোনো কার্য করতে বাধ্য বলে সরল বিশ্বাসে ওই কার্য করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে না।

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন : দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তাদের জন্য একটা ধারায় (সেকশন ৩১) বলা আছে, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন কর্মকর্তা ও কর্মচারী যদি সরল বিশ্বাসে কোনো কাজ করেন, সে ক্ষেত্রে তাকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।’

আইন বিষয়ে আমার নিজের তেমন কোনো পড়াশোনা নেই। তবে ওপরের আলোচনা থেকে এটুকু বুঝেছি, যথাযথ সতর্কতা ও মনোযোগ দিয়ে কোনো ব্যক্তি যদি নিজ দায়িত্বের অংশ হিসেবে কোনো কাজ করেন, তাহলে সেটিকে ‘সরল বিশ্বাসে’ করা হয়েছে বলেই ধরে নেয়া হয়। অন্তত আইন সেভাবেই দেখে বিষয়টিকে।

সমাজে বা মানুষের জীবনে এমন ঘটনা ঘটতেই পারে- যখন আপনি কারো উপকার করার নিয়তে কোনো কাজ করলেন, কিন্তু পরে দেখা গেল ওই কাজ করার কারণে লোকটির উপকার না হয়ে ক্ষতি হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে আপনি দোষী হবেন না। কারণ, আপনার নিয়ত বা উদ্দেশ্য ঠিক ছিল। এমনই আরো বহু প্রেক্ষাপট রয়েছে যখন আইনে শাস্তি না দেয়ার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মানুষের জীবনে কত বিচিত্র পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, সেগুলো খুবই বিচক্ষণতার সাথে বিবেচনা করেই আইনে ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং সেটা এযাবৎকাল অনুসৃত হয়ে আসছে।

এ বিষয়টির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দণ্ডবিধিতে একটি উদাহরণ দেয়া হয়েছে। একটি জাহাজের ক্যাপ্টেন নিজে কোনো ত্রুটি বা অবহেলা না করেও হঠাৎ নিজেকে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে দেখতে পেলেন যে, জাহাজ থামাতে পারার আগেই সেটি অনিবার্যভাবে ২০-৩০ জন আরোহীসহ একটি নৌকাকে চাপা দেবে। কিন্তু যদি তিনি জাহাজটিকে ঘুরিয়ে দেন, তাহলে সেটি মাত্র দু’জন আরোহীসহ একটি নৌকার ওপর দিয়ে পেরিয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন যদি তার জাহাজটির গতিপথ পাল্টে ফেলেন এবং নৌকার ২০-৩০ জন আরোহীকে বাঁচানোর জন্য দু’জনের জীবনের ঝুঁকি কবুল করে নেন, তাহলে তিনি দোষী হিসেবে বিবেচিত হবেন না। এখানে দেখতে হবে, আসলে তার কোনো ত্রুটি বা অবহেলার কারণে ওই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল কি না। যদি প্রমাণ করা যায়, ক্যাপ্টেনের জাহাজ চালনায় ভুল ছিল, অমনোযোগ বা অবহেলা ছিল, তাহলে তাকে দু’জন মানুষ খুনের দায়ে শাস্তি পেতেই হবে।

একইভাবে, বন বিভাগের একজন কর্মী একটি গাছ কাটার সময় কুড়ালের মাথাটা ছুটে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তির গায়ে লেগে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হলে বন বিভাগের কর্মীর শাস্তি হবে না। কারণ, তিনি খুন করার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজটা করেননি। এ রকম দুর্ঘটনাক্রমে ঘটে যাওয়া কোনো কাজই অপরাধ বলে গণ্য হবে না। দণ্ডবিধির ‘জেনারেল এক্সেপশন’ বলতে এমনই বিভিন্ন ব্যতিক্রমী ঘটনার ক্ষেত্রে দেয়া আইনের ব্যতিক্রমী সুরক্ষাকেই বোঝানো হয়েছে। এতক্ষণ যারা এই নিবন্ধ পড়েছেন, আশা করি তাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে, আইনে এ ধরনের ব্যতিক্রম থাকা উচিত।

দুদক চেয়ারম্যান সরকারি কর্মকর্তাদের ‘সরল বিশ্বাসে কৃতকর্ম’ বলতে এটাই বুঝিয়েছেন। এতে আইনের কোনো ব্যত্যয় তো ঘটেইনি, বরং খুবই জরুরি বিষয়ে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন বলতে হবে।
তবে এখানেও একটা কথা আছে। আমাদের সমাজে যখন দুর্নীতির সয়লাব চলছে, সে সময় দুর্নীতি করার বিকল্প পথ দেখিয়ে দেয়ার শামিল কোনো বক্তব্য অন্তত দুদক প্রধানের কাছে কেউ আশা করেন না।

সবশেষে ফেসবুকে একজন সাংবাদিকের পোস্টের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করব। সাংবাদিক লিখেছেন, “ইদানীং আমাদের সাংবাদিকতায় (শেয়ালের) হুক্কাহুয়া প্রবণতা শুরু হয়েছে। একজন একটা খবর ছাপালো, ব্যস! আগা-পাশ না ভেবে সবাই অনুরণন করতে শুরু করে দেন। খ্যাত-অখ্যাত কেউ বাদ যান না। অল্প দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই ট্রেন্ডে ঢুকে পড়েন। অথচ একটু কষ্ট করে যে খবর বা বক্তব্য নিয়ে সংবাদ করছেন, সেটা মিলিয়ে নিতে পারেন। আর মেলানোর পরও যারা দুদক চেয়ারম্যানের ‘কৃতকর্ম’ শব্দকে ‘দুর্নীতি’ দ্বারা প্রতিস্থাপিত করেন কোনো ব্যাখ্যা ছাড়া, তারা অপসাংবাদিকতা বৈ কিছুই করেন না।”

আরেকটি বিষয় হলো, অনলাইনের যুগে যে বিশেষ প্রচলন শুরু হয়েছে তা হলো কপি পেস্ট!... ফলে এ রকম চাঞ্চল্যকর খবর খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ে। আর সামাজিক মাধ্যমে এই খবর বাতাসেরও আগে ছড়ায়। স্ট্যাটাসের বন্যায় ভেসে যায় ফেসবুক। আমরাও খুব ‘সরল বিশ্বাসে’ সে খবর নিয়ে কথাবার্তা, হাসিঠাট্টা, ট্রল করা শুরু করি। ... ‘সো নো হুক্কাহুয়া’। আগে খবরের বা তথ্যের সঠিকতা নিশ্চিত করুন নিজ জ্ঞানে। সন্দেহ হলে ক্রসচেক করুন। আর যাদের সন্দেহ করার রোগটা নেই, তারা ভিন্নপথ খুঁজুন।


আরো সংবাদ



premium cement