১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

এটা ভারসাম্যের যুগ

- ফাইল ছবি

একালে আপনি কার দিকে? চীন, আমেরিকা নাকি ভারত? সাথে রাশিয়ার নামটা নিলাম না, সেটা একটু পেছনে পড়েছে বলে। তো চীন, আমেরিকা নাকি ভারত- এই প্রশ্নের জবাব হলো একটাও না। আরো সরাসরি এর বিকল্প শব্দটা হলো ভারসাম্য। চীন, আমেরিকা নাকি ভারতের সাথে এক ভারসাম্য অবস্থান বা ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট- এমন পজিশন নেয়া।

এককালে আপনি কোন দিকে? অথবা আপনার রাষ্ট্র কোন দিকে- আমেরিকা না সোভিয়েত ইউনিয়ন (রাশিয়া) কোন দিকে অবস্থান নিয়েছে? এটা খুবই ভ্যালিড প্রশ্ন ছিল। এভাবে ‘আপনি কোন দিকে’ বলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে বা কলোনি-উত্তরকালে ১৯৪৫ সালের পর থেকে দুনিয়ায় চলতে শুরু করেছিলেন। বলা বাহুল্য, সেটা আমেরিকার নেতৃত্বে সেকালের নতুন দুনিয়া। তখনো পরাশক্তি বা দুই মেরুতে বিভাজন শুরু হয়নি। সেটা হয়েছিল ১৯৫২ সালের পর। শুরু হয়েছিল ব্লক রাজনীতি : সোভিয়েত ব্লক না আমেরিকান ব্লক। এভাবে সেই থেকে ৭০ বছর আমরা পার করে দিয়েছি। ফলে আমাদের মতো দেশের ভাগ্য সেকালে লুকিয়ে ছিল ‘কোন দিকে’ বলে যার যার মতে, এক ভালো ব্লক খুঁজে নেয়ার মধ্যে, এই ছিল আমাদের ‘কোন দিকের’ ধারণা। এভাবেই চলছিল ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। লোকে বলতে শুরু করে দুনিয়া এবার এক মেরু, আমেরিকান মেরুর দুনিয়া হয়ে গেল। কথা হয়তো আপতিকভাবে সত্য, অন্তত সাদা চোখে সবার তো তাই মনে হচ্ছিল। তাই কী?

ওইদিকে শুরু হিসাবে ধরলে চীনের উত্থানে আজকের চীন হয়ে ওঠার শুরুটা বলা যায় সেই ১৯৬৮ সাল থেকে, যদি ১৯৫৮ সালের তথাকথিত ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লবকে’ কেউ না-ই ধরতে চান। এমনকি ১৯৬৮ কেন ১৯৭১ বা ১৯৭৮ সালেও খুবই কম হাতেগোনা কিছু লোক ছাড়া কেউ বোঝেনি যে, সেটাই আজকের চীন হওয়ার শুরু। ১৯৭১ মানে যখন চীন যখন প্রথম আমেরিকার সাথে গোপন চুক্তি অনুসারে মাও সে তুংয়ের চীন সেই প্রথম জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করেছিল। আর এটা ছিল ভেটো দেয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন একটা সদস্যপদ। কারণ, এই সদস্যপদ এত দিন (চীন বলতে) তাইওয়ানকে দিয়ে রাখা ছিল। সেটাই তখন তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে মাওয়ের চীনকে দেয়া হয়েছিল।

আর ওইদিকে ১৯৭৮ সাল, এটা উল্লেখযোগ্য এ জন্য যে, মোটাদাগের সব দেনা-পাওনা ডিল সম্পন্ন করে চীন-আমেরিকা উভয় রাষ্ট্র পরস্পর পরস্পরকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়ে উভয়ে অফিস খুলে কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করেছিল ১ জানুয়ারি ১৯৭৮। এভাবে ১৯৯০ পর্যন্ত চীন ছিল আসলে আমেরিকান পুঁজি ও টেকনোলজি কিভাবে নেবে, এর আর গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমের অর্থনীতিতে চীনের নিজেকে অভ্যস্ত, সাজানো ও খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রস্তুতিকাল। আর পরের প্রায় ২০ বছর ধরে চলে চীনের অর্থনৈতিক ডাবল ডিজিট (বা সময়ে এর চেয়েও বেশি) উত্থানের পর্ব। তত দিনে আমেরিকা বুঝে গেছে যে, চীন গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতা হিসেবে তাকেও ছাড়িয়ে যাবে।

যদিও ব্যাপারটা এমন নয় যে, আমেরিকা আগে তা জানত না বা অনুমান করেনি। আসলে বিষয়টা ছিল জেনেও কিছুই করার নেই পরিস্থিতি। চীনের জনসংখ্যার শত কোটির ওপরে (২০১৮ সালের হিসাবে ১৪২ কোটি) এমন দেশ লোভনীয় বিনিয়োগ বাজার চাহিদার ফলে আমেরিকার ওয়ালস্ট্রিট একে উপেক্ষা করা চিন্তাও করতে পারে না। তাই আমেরিকান পুঁজিতে চীন ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকে ১৯৯০ সালের পর থেকেই। এটা দেখেই বুশের আমলে ২০০৪ সাল থেকে শুরু হয়েছিল এবার চীন ঠেকানোর কৌশলের তোড়জোড়। ভারত আমেরিকার হয়ে চীন ঠেকানোর কাজ হাতে নিয়েছিল। আর তখন থেকেই আপনি কোন দিকে অথবা আপনার রাষ্ট্র কোন দিকে, সেটা বুঝতে পারা আর আগের মতো সহজ থাকেনি। কেন?

আপনি কোন দিকে, এর জবাব দেয়া সেকালে সহজ ছিল। কারণ, একটা মেরু বা পরাশক্তি আপনি বেছে নিলেই হতো। কিন্তু একালে ব্যাপারটা আর মেরু বা পরাশক্তি-কেন্দ্রিক বিষয় নয়। যেমন- আপনি কোন দিকে চীন, আমেরিকা নাকি ভারত? এই প্রশ্নের মধ্যে চীন, আমেরিকা বা ভারত এদের কাউকে পরাশক্তি গণ্য করা নেই। একালে কেউ পরাশক্তি কি না তা তত মুখ্য বিষয় নয়। মুখ্য বিষয় গ্লোবাল অর্থনীতিতে নেতা বা নেতৃত্ব। ফলে তা আসলে মূলত পুরনো নেতা আমেরিকার জায়গায় নতুন হবু নেতা চীনের দখল নেয়ার ইস্যু।

এই হিসাবে এখানে নেতা বা কেন্দ্র দু’টি- চীন ও আমেরিকা। তাহলে সাথে ভারতের নামও আসছে কেন? কারণ, ভারত আমেরিকার হয়ে সে ‘চীন ঠেকানোর’ কাজে ভাড়া খাটত। প্রতিদান হিসেবে পেয়েছিল বাংলাদেশের ওপর আমেরিকান ছড়ি ঘুরিয়ে মাতবরি। আর চীনের প্রায় কাছাকাছি জনসংখ্যার দেশ হলো ভারত। ফলে এখনই না হলেও ভারত পটেনশিয়াল আগামীর সম্ভাবনা আছে, এমন অর্থনৈতিক হবু শক্তি; এতটুকুই। তাতে সব মিলিয়ে ভারত ভেবেছিল এভাবেই দিন যাবে ‘চীন ঠেকানোর’ বোলচালের মধ্যে থাকবে আবার চীনের নেতৃত্বে নতুন বিশ্বব্যাংক ‘এআইআইবি’ খুললে তাতে চীনের পরই বড় মালিকানা শেয়ারটা চীন ভারতকে দেবে। ব্যাপারটা সেই কবিতার মতো যেন- ‘এভাবে কি দিন যাবে তোমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে অথচ তোমার কথা না ভেবে!’

কিন্তু না একালে দিন তেমনভাবে যায়নি। এখন ফলাফল হলো বাংলাদেশ আমেরিকার হাতছাড়া, ভারতের কোলে, সেটা সত্য। কিন্তু ওইদিকে আবার ট্রাম্পের আমলে এসে ভারতকে ‘চীন ঠেকানোর’ কাজে ভাড়া খাটাতে ট্রাম্প আর আগ্রহী নয়। উল্টো চীনের মতো ভারতের বিরুদ্ধেও ট্রাম্প বাড়তি শুল্ক আরোপের বাণিজ্য যুদ্ধ করতে চায়। যেখান থেকে ভারত আবার মোচড় দিয়ে নিজের আত্মগরিমা আর ট্রমা পেছনে ফেলে চীনের কোলে য়ুহান সামিটে। বলা হচ্ছে, ওই য়ুহান সম্মেলন সেখানে এমন কিছু মৌলিক বোঝাবুঝির ভিত্তি নাকি তৈরি হয়ে গেছে, যা আরো বিকশিত বা বাড়তে না পারলেও নাকি পেছাবে না।

কিন্তু ট্রমা- ভারতের ট্রমা হলো ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধে ভারতের হার, এটাই তাকে বারবার বেচাইন অস্থির করে, আর আমেরিকার দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাই ভারত আমেরিকার সাথে তার সম্পর্ককে ভারসাম্যের জায়গা থেকে দেখে না, দেখতে পারে না। অর্থাৎ আমেরিকাকে পুরনো পরাশক্তির আলোকে দেখতে চায়। কিন্তু চীন-আমেরিকার দ্বন্দ্ব তো পরাশক্তিগত নয়। তবু ভারত আমেরিকার দিকেই কেবল ছুটে যায়। যেমন ২০১৮ সালের মাঝামাঝি ট্রাম্প নিজের আফগান পলিসি প্রকাশ করেছিলেন। এতে পাকিস্তানকে সন্ত্রাস প্রশ্রয়ের অভিযোগ দিয়ে সাজানোতে ভারত আবার ছুটে গিয়েছিল মোহে। কিন্তু না! ছয় মাস যেতেই জানা গেল ট্রাম্প আফগানিস্তান থেকে শেষ হাজার দশেক আমেরিকান সৈন্য, তাও এবার ফেরত আনতে চান। অথচ আফগান নীতিতে এর কোনো ইঙ্গিতও ছিল না। যা হোক, সৈন্য ফেরতের চিন্তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন দেখল, পাকিস্তানের সহায়তা ছাড়া তা অসম্ভব। ফলে যে পাকিস্তানকে আমেরিকা চীনের কোলে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল, তাকেই আবার কুড়িয়ে নেয়া শুরু করেছিল।

আমেরিকার আফগানিস্তান-বিষয়ক বিশেষ দূত জালমে খলিলজাদ যে ট্রাম্পের আফগান নীতি প্রকাশের সময় পাকিস্তানের কঠোর সমালোচক, উঠতে বসতে সন্ত্রাস লালনকারী বলেছিল, সেই তিনি এবার সৈন্য ফেরানোর উপায় হিসেবে তালেবানদের সাথে কথা বলা আর রফাচুক্তি করার চেষ্টার সময়ে ওই পাকিস্তানকেই প্রায় বাপ ডাকছে। সাম্প্রতিককালে আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ‘ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স’ প্রবল সক্রিয় হতে দেখা গেছে। এতে আমেরিকার উদ্যোগে পাকিস্তানকে চেপে ধরাতে ভারত খুবই খুশি ছিল। নিজ মনকে আশ্বস্ত করেছিল ভারত যে, হ্যাঁ অন্তত এই টেররিজম ইস্যুতে ভারত-আমেরিকার এই অ্যালায়েন্স, এটাই তো ভারত চায়। কিন্তু ঘটনা হলো, টেররিজম ইস্যু বলে আসলে সত্যিকারের কিছু নেই। বরং টেররিজম বলতে ভারত-আমেরিকা নিজেরা কী বুঝবে ও বুঝাবে, এ নিয়ে তাদের মধ্যে গভীর বোঝাবুঝি আছে। যেমন- ২০০৭ সালে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশকে টেররিজম মোকাবেলার যোগ্য করে সাজাতে আমেরিকা বাংলাদেশকে ভারতের হাতে তুলে দিচ্ছে। অথচ টেররিজম কথাটি ছিল এক সাইনবোর্ড মাত্র। ভারতের মূল স্বার্থ ছিল আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদ ঠেকাতে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা আর নর্থ-ইস্ট থেকে বেরনোর জন্য বাংলাদেশের ওপর দিয়ে করিডোর হাসিল করা। সাথে পুরো বাংলাদেশের বাজার দখল পাওয়াও। এসবের বিনিময়ে ভারত আমেরিকার স্বার্থে ‘চীন ঠেকানোর’ কাজে অবস্থান নিয়ে ভাড়া খাটবে।

ভারত-আমেরিকার এই টেররিজম-বুঝের সাইনবোর্ড তাদেরকে অনেক কিছু এনে দিয়েছিল, বিশেষ করে ভারতের এতে আস্থা ছিল দৃঢ় ও গভীর। কিন্তু টেররিজম-বুঝের সাইনবোর্ড এখন তা করলার চেয়েও তিতা। কেন? বালুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন অনেক পুরনো।

এটা পাকিস্তান সরকারের সাথে কোনো নেগোসিয়েশন বা রফা পরিণতিতে না যেতে পারার পেছনে একটা বড় কারণ হলো- ভারতের গোয়েন্দা বিভাগের এই আন্দোলনের দলকে (বিএলএ) প্রায় খোলাখুলি সহায়তা ও সমর্থন। গত ২ জুলাই আমেরিকা পররাষ্ট্র দফতর বালুচিস্তান লিবারেশন আর্মিকে (বিএলএ) স্পেশালি ডেজিগনেটেড গ্লোবাল টেররিস্ট বলে ঘোষণা দিয়েছে। পাকিস্তানে সাধারণ নাগরিক ও নিরাপত্তারক্ষীদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলা চালানোর পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান সরকার ২০০৬ সালে এই সশস্ত্র গ্রুপটিকে নিষিদ্ধ করেছিল। বলাই বাহুল্য, ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে চীন ও পাকিস্তান উভয়ে স্বাগত জানিয়েছে। অথচ চিপায় আটকা পড়ে ‘কোথাও নেই’ হয়ে গেছে ভারত। বিএলএ-কে টেররিস্ট বলায় এতে চীনেরও স্বার্থ ছিল সরাসরি। কারণ, পাকিস্তানের পেট চিরে পাকিস্তানের সব প্রদেশের উপর দিয়ে টানা চীন-পাকিস্তান করিডোর স্থাপনার কাজে চীনা ঠিকাদারের কর্মীরা বারবার বিএলএ’র হাতে অপহরণের বা চাঁদা দানের শিকার হয়েছে।

ওইদিকে বিএলএ-কে শুধু টেরর ঘোষণা করা নয়, আগামী ২২ জুলাই ওয়াশিংটনে ট্রাম্প-ইমরানের শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে হোয়াইট হাউজ গত ১১ জুলাই। মানে ব্যাপারটা এক কথায় বললে আমেরিকার নিজের কৌশলগত অন্য কোনো স্বার্থে এককালে আচারের আঁটির মতো চুষে রস খেয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়া পাকিস্তানকে আবার সমাদরে কোলে তুলতে চাইছে আমেরিকা। এখানেও টেররিজম ইস্যু নয়, সাইনবোর্ড মাত্র; আগে বাংলাদেশের মতোই। তাহলে ভারতের এখন বাকশূন্য বোকা হয়ে যাওয়া কেন? কারণ হলো, ভারতের কাশ্মিরে সরকারি টেররিজমে নিপীড়ন ও হত্যার পক্ষে এটা ন্যায্যতা বা সাফাই জোগাড় করে দেয়া হয়ে যেত এই বলে যে, টেররিজমের একক হোতা হলো পাকিস্তান বা মুসলমানরা। কিন্তু আমেরিকার বিএলএ-কে টেররিস্ট ঘোষণা করাতে আর সেই দলকে সমর্থন করাতে ভারতও টেররিস্ট-সমর্থক আমেরিকা পরোক্ষে এবার তাই বলে বসল।

তাহলে এখান থেকে কী শিক্ষা? শিক্ষাটা হলো, চলতি এ যুগ গ্লোবাল নেতৃত্বের বিশেষত অর্থনৈতিক নেতৃত্বের নেতা বদলের যুগ এটা। আবার খেয়াল রাখতে হবে, এটা সোভিয়েত-আমেরিকার দুই ব্লকে ভাগ হয়ে থাকার যুগ নয়। ব্লকে ভাগ হয়ে থাকা কথাটা বুঝতে হবে। সেকালে এর মানে ছিল এক ব্লকের কোনো রাষ্ট্রেরই অপর ব্লকের কারো সাথে পণ্য, পুঁজি বিনিয়োগ বাজার ইত্যাদিতে কোনো লেনদেন-বাণিজ্য সম্পর্ক হারাম ছিল, তাই সম্পর্ক বলতে কিছুই ছিল না।

অথচ এ কালে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যতই ঝগড়া বা রাষ্ট্রস্বার্থবিরোধই থাক না কেন- সেখানে একই সাথে পণ্য, পুঁজি বিনিয়োগ বাজার ইত্যাদিতে সব লেনদেন-বাণিজ্যও সমানে চলে থাকে। অতএব, এ কালের ফর্মুলা হলো সবার সাথেই নিজস্বার্থ মুখ্য করে এক ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে লেপটে থাকা। তাই চীন না আমেরিকা নাকি ভারত এভাবে কারো দিকেই এককভাবে কান্নি মেরে থাকা যাবে না। এটা আবার শর্টকাট কোনো ন্যাশনালিজমের মতো তা ভেবে বসাও ভুল হবে। কাজেই আপনি ভারতের দালাল- নিজভূমিতে অন্যকে করিডোর দিয়েছেন, বাজারসহ সব খুলে দিয়েছেন এমন ভারতের দালাল, নাকি আপনি চীনের বিনিয়োগ এনে সয়লাব করেছেন সেই চীনা দালাল- এ দুটোই ভুল পথ। এমনকি এ দুইয়ের ভয়ে আমেরিকার কোলে গিয়ে উঠেছেন, এটাও ভুল। বরং তিনের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখতে হবে ভারসাম্যপূর্ণভাবে। এককভাবে কারো সাথে সম্পর্ক এ কালে হারাম, বরং কার সাথে কতটুকু যাবেন তা আগেই নিজ বোঝাবুঝি ঠিক করে রাখতে হবে। প্রয়োজনে তা বলা যেতে পারে, কখনো বলা যাবে না, কাজে দেখাতে হবে। কিন্তু নিজ হোমওয়ার্ক অবশ্যই আগে করে রাখতে হবে।

সোনাদিয়ায় বন্দরসহ বিসিআইএম করিডোর নির্মাণ আমাদের কৌশলগত মৌলিক স্বার্থ। অথচ ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্যে রাখতে এটা কমপক্ষে ১০ বছর ধরে উপেক্ষায় ফেলে রাখা হয়েছিল। আমাদের ‘নিশীথ ভোটের’ পরবর্তীকালে এ থেকে পরে পাওয়া দিকটা হলো, এটা উন্মোচিত হয়ে গেছে যে, ক্ষমতায় আসার জন্য কারো ভারতের সমর্থন জরুরি নয়। আবার আমেরিকাও এখন বিষহীন ঢোঁড়া সাপ। আর বিরোধী দলসহ সারা দেশের মানুষ আজ ভারতকে ঘাড়ে চেপে বসা দানব ভাবছে। ফলে তারা ভারতবিরোধী। তাই এটাই তো সব উপেক্ষা করে নিজস্বার্থে চীন সফরের সবচেয়ে ভালো সময়। শেখ হাসিনা যা বুঝেই নিয়ে থাকেন না কেন, এক সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছেন। ওইদিকে এতে চীনা প্রতিক্রিয়া বা সাড়া ব্যাপক। তারা আশাতীত খুশি যে, বাংলাদেশ নিজের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে।

তারা আরো খুশি এ জন্য যে, বিসিআইএম প্রকল্প জেগে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এখন এতে বা বেল্ট রোডে ভারত যোগ দেবে হয়তো কোনো এক কালে, আমেরিকার হাতে কোনো পরিস্থিতিতে চরম নাকানি-চুবানি খাওয়ায় বিধ্বস্ত হওয়ার পরে। তাতে চীন ভারতকে যতই সুযোগ-সুবিধা দেয়ার ডালি সাজিয়ে রাখুক না কেন অথবা বিসিআইএম প্রকল্পে ভারতের যোগদানের দরজা খুলে রাখুক না কেন। আবার এটা হতেও পারে যে, দেখা গেল ট্রাম্পের বাকি আমলে (জানুয়ারি ২০২১) মধ্যেও মোদি সিদ্ধান্ত নিতেই পারলেন না। যদিও অনেকে অবশ্য বলছেন, গত জুন মাসে কাজাখস্তানে সাংহাই করপোরেশনের শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। সেখানে এক যৌথ ঘোষণা থেকে বেল্ট রোড প্রকল্পের ব্যাপক প্রশংসা করা হয়। আগে এমন হলে, তাতে ভারতের আপত্তি আছে বা অংশগ্রহণে ভিন্নমত আছে বলে তা সাথে উল্লেখ থাকত। এবার তেমন কিছুই দেখা যায়নি। অনেকে এর অর্থ করছে যে, ভারত এখন গ্রহণও করেনি আবার বিরোধিতাও করেনি, এমন অবস্থায় এসেছে।

তবুও এতে তেমন আশাবাদী না হওয়ার অন্য কারণ হলো, যে হিন্দুত্বের ঝাণ্ডা তুলে মোদি আবার ক্ষমতায় এসেছেন তা হলো চরম মুসলমান বিরোধিতা, যার মানে পাকিস্তান বিরোধিতাও। কিন্তু এই ডিভিডেন্ড মোদি সহসাই লঘু করতে চাইছেন না। আগামী পাঁচ বছরজুড়েই ভারতে প্রতি বছর প্রায় পাঁচ রাজ্য নির্বাচন হবে, তাই এই একই মুসলমানবিদ্বেষী হিন্দুত্ব মোদিকে ব্যবহার করে যেতে হবে। এ ছাড়া বাবরি মসজিদ মন্দির বানানো, আসামসহ সারা দেশে নাগরিকত্ব পরীক্ষার নামে মুসলমান খেদানো, পশ্চিমবঙ্গসহ যেসব রাজ্যে বিরোধীরা ক্ষমতায় আছে সেসব রাজ্যসরকার দখল, কাশ্মিরে চরম বলপ্রয়োগে একে ভারতের অঙ্গ করে নেয়া; এমন অনেক কিছু মোদির কর্মতালিকায় আছে। এ দিকে সাংহাই করপোরেশন মানে হলো যেখানে চীন, রাশিয়া, সেন্ট্রাল এশিয়া আর, ভারত-পাকিস্তান আছে। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ‘টোন-ডাউন’ করা মোদির পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ পাকিস্তানে বোমা মেরে আসা বীর হলেন মোদিÑ নিজের এই নির্বাচনী ইমেজ তিনি আবছা হতে দেবেন না। যদিও ওইদিকে আবার মোদির হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে আমেরিকা ভারতের বিরুদ্ধে ধর্মপালনের স্বাধীনতা বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপক অভিযোগ নিয়ে মুখোমুখি।

অতএব, ভারতকে বাদ রেখে বন্দরসহ বিসিআইএম প্রকল্পকে এগিয়ে নেয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে। ভারতের জন্য অপশন খোলা থাকবে, যার ফাইন্যান্সিয়াল দায়ভারসহ যুক্ত হতে চাইলে ভারত সে সুযোগ নিতে পারবে। যদিও ভারত সহসাই প্রকল্পে যোগ দিচ্ছে, এমন আশাবাদী হওয়া কঠিন।

এ দিকে শ্রীলঙ্কা এক নতুন ড্রামার মঞ্চস্থল হয়ে উঠেছে। এম ভদ্রকুমার ভারতের একজন সাবেক কূটনীতিক ও রাষ্ট্রদূত। তিনি লিখেছেন, অ্যাঙলো-আমেরিকান ‘রেজিম বদল’ প্রকল্পে যোগ দিয়ে ভারতের কূটনীতি ইতোমধ্যেই হাতে রক্ত লাগিয়ে ফেলেছে। আর এখন যা হচ্ছে তাতে ভারতকে পাপোষের মতো ব্যবহার করে আমেরিকা শ্রীলঙ্কায় ঢুকে পড়েছে। শ্রীলঙ্কাকে সামরিক চুক্তিতে জড়িয়ে নিচ্ছে। ওখানে রাষ্ট্রপতি সিরিসেনা আমেরিকাকে ডেকে আনার নায়ক। তিনি এক উগ্র বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতাকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমা প্রয়োগ করে তাকে জেল থেকে ছুটিয়ে এনেছেন, যিনি স্থানীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ উগড়ানো এক পাবলিক মিটিং করেছেন। শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধদের এ ধারাই মিয়ানমারে ক্ষমতাসীন রোহিঙ্গাবিদ্বেষী এক বৌদ্ধ ধারা। অর্থাৎ ফলাফল হলো, ভারত শ্রীলঙ্কায় চীনের প্রভাব দমাতে গিয়ে ব্যাপক রক্তপাতের পর এখন এর মাখন উঠিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে আমেরিকা।

তা হলে এশিয়ায় মূল বিষয়টি হচ্ছে, না চীনের কোলে না ভারতের। ভারসাম্যের নীতিতে, কারো দিকে কান্নি না মারা। নিজের স্বার্থের দিকে ফোকাসের নীতি- এভাবে হোমওয়ার্ক করে আগানো, এই নীতিই একমাত্র বাঁচোয়া। ভারত ভারসাম্যের নীতি না মেনে চলা দেশ। তাই তার, আমেরিকার দিকে কান্নি মেরে থাকার নীতি। যে আমেরিকা আবার চলে নিজের একক স্বার্থে। বালুচদের টেররিস্ট ঘোষণা করে দেয়া অথবা শ্রীলঙ্কায় সামরিক চুক্তি করে ঢুকে পড়া, এগুলো এর উদাহরণ হলেও এসব বিষয় ভারতকে হুঁশে আনবে ভরসা করা কঠিন।

তবে যারাই চীনের বদলে ভারত অথবা চীনের বিরুদ্ধে ভারতের প্রভাব বলয় বাড়ানোর জন্য খুনখারাবি পর্যন্ত যাবে, এরাই শেষে নিজের সব অর্জন আমেরিকার হাতে তুলে দিয়ে থাকে। হাসিনার জন্য এটাও এক বিরাট শিক্ষা হতে পারে যে, সেও আবার শেষে আমেরিকাকে ডেকে নিয়ে না আসে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement