১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

হিন্দুত্বের পাবলিক লিঞ্চিং

- ফাইল ছবি

মোদির শাসনের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে গত ৩০ মে ২০১৯। সেই সাথে ভারত এখন হিন্দুত্বের রাজনীতিতে সয়লাব, সরকার আর প্রধান বিরোধী দল দুই দলই এখন হিন্দুত্বের রাজনীতি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে, এভাবে এটাই এখন প্রধান ধারা, এখানে উভয়ে হাজির।

মানুষের প্রত্যেক সমাজেরই কিছু সামাজিকভাবে নির্ধারিত পালনীয় আচার-আচরণ থাকে। জবরদস্তিতে সেটা অমান্য করা যেমন, কেউ চাইল যে সামাজিক নর্মসের বিরুদ্ধে সে রাস্তায় উলঙ্গ হয়ে হাঁটবে- এ ধরনের সামাজিক অসভ্যতা, পাবলিক বিড়ম্বনা বা উপদ্রব ঘটানো, এ বিষয়টিকেই ইংরেজিতে ‘নুইসেন্স’ বলে। মোদির প্রথম পাঁচ বছর কেটেছে হিন্দুত্বের নামে অসংখ্য পাবলিক নুইসেন্স ঘটিয়ে। অথবা বলা যায় এমন নুইসেন্স যেন বাধাহীনভাবে সমাজে ঘটতে পারে। মোদির কাজ ছিল তা প্ররোচিত করা, প্রশ্রয় দিয়ে আগলে রাখা। এসব কাণ্ডের শীর্ষে ছিল গরুপূজা-কেন্দ্রিক বা ঘর-ওয়াপসি (মানে হলো, মুসলমানসহ অন্য অহিন্দু ধর্মাবলম্বীদের হিন্দুধর্মে জবরদস্তিতে ফিরতে হবে বলে দাবিতে নুইসেন্স তৈরি করা)। পরবর্তীকালে গরুপূজা-কেন্দ্রিক গোরক্ষক আন্দোলন হয়ে উঠেছিল আরো ভয়ঙ্কর।

গরু ব্যবসায়ী বা গরু নিয়ে চলাচলকারী কৃষককে আক্রমণ অথবা গরুর গোশত পাওয়া গেছে মাঠে অথবা বাসায় এই অজুহাতে মুসলমান ব্যক্তি বা পরিবারের ওপর আক্রমণ- এই ছিল এর সাধারণ লক্ষণ। তো এই কাজে ‘গোরক্ষক দল’ গঠন করে নজরদারির নামে পাবলিক লাইফে নুইসেন্স তৈরি করতে বিভিন্ন রাস্তা পাহারা দেয়া। আর বিজেপি-আরএসএসের নামে-বেনামের বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন নিয়ে গঠিত হতো এসব গোরক্ষক দল। তাই সরকারি সহায়তায় বাধাহীনভাবে চলত এসব পাবলিক নুইসেন্স। এদের তৎপরতায় নৃশংসতা বর্ণনা করতে আর একটা শব্দ আছে ‘পাবলিক লিঞ্চিং’। ইংরেজি ওই শব্দের মানে হলো, গোরক্ষক ধরনের দলের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে পাবলিক উন্মাদনা তৈরি করে কথিত ইস্যুতে মুসলমান নাগরিককে গণপিটুনিতে আহত রক্তাক্ত বা হত্যা করা। লিঞ্চিং মানে গণ-উন্মাদনার নামে খুঁচিয়ে-পিটিয়ে কাউকে রক্তাক্ত করা বা মৃত্যু ঘটানো।

মোদির শাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ের নতুন যোগ করে শুরু হয়েছে ‘পাবলিক লিঞ্চিং’। অজুহাত বা ঘটনা অনুষঙ্গ মানে কেন কিভাবে ঘটানো হয়, তা হলো কোনো বাসে, ট্রেনে বা রাস্তায় কোনো মুসলমান নাগরিককে ধরে তাকে জোর করে নির্যাতন করেই চলা যাতে সে প্রাণ বাঁচাতে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে বাধ্য হয়, আর না করলে পাবলিক লিঞ্চিংয়ের তীব্রতায় সে মারাও যেতে পারে। প্রত্যেক সপ্তাহেই এমন দু-তিনটি ঘটনা ভারতজুড়ে ঘটতে দেখা যাচ্ছে, গত মে মাসে নির্বাচনে মোদির শাসনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শুরু থেকেই।

আইনি দিক থেকে পাবলিক নুইসেন্স ঘটানো মানে অন্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা এক ক্রিমিনাল অপরাধ; পেনাল কোড ২৬৩, ২৯০, ২৯১ ধারায় পাবলিক লিঞ্চিং করা অপরাধ। তবে পাবলিক লিঞ্চিং করতে গিয়ে আরো বড় অপরাধ- হত্যা করা, হত্যার উদ্দেশ্যে আহত করা ইত্যাদি; যা মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার মতো অপরাধ। এ ছাড়া পাবলিক অর্ডার নষ্ট করা, গণ-উন্মাদনা তৈরি করা সেসব অপরাধের খতিয়ান তো আছেই।

তবে এ ছাড়াও এখানে সবচেয়ে বড় অপরাধ ঘটায় শাসক সরকার, যেটা আসলে রাজনৈতিক ও কনস্টিটিউশন ভঙ্গের অপরাধ। সেটা হলো, ‘নাগরিক বৈষম্য’ ঠেকানোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ না নেয়া, উদাসীন থাকা। নির্লিপ্ত থেকে রাষ্ট্র, আইনশৃঙ্খলা ও পাবলিক অর্ডার ভেঙে পড়া হতে দেয়া ও সাহায্য করা।

একটা মডার্ন রিপাবলিক সেসব মৌলিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে তা রাষ্ট্র বলে নিজেকে দাবি করতে পারে, এর এক নম্বর পয়েন্ট হলো নাগরিক অধিকারে বৈষম্যহীনতা বজায় রাখার কর্তব্য পালন করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের চোখে নাগরিক মাত্রই সবাই সমান, সমান অধিকারের এমন হতে হয়। তাতে সে কোন ধর্মের নাগরিক, কোন গায়ের রঙের, পুরুষ না নারী, পাহাড়ি না সমতলী ইত্যাদি বিভেদ নির্বিশেষে সবাই রাষ্ট্রের সমান অধিকারের এমন হতে হয়। আর তা রক্ষা মানে নাগরিকের সম-অধিকার রক্ষা, কোনো নাগরিক যাতে অধিকার বৈষম্যের শিকার না হয়, সেটা রক্ষা ও বজায় রাখা ইত্যাদি হলো সরকারের মুখ্য কাজ। এখানে ব্যর্থ হওয়ারও সুযোগ নেই। হলে এটাই নাগরিককে দেয়া রাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ও কনস্টিটিউশন ভঙ্গের অপরাধ। এই ব্যর্থতার অর্থ হলো, রাষ্ট্রের অনস্তিত্ব; রাষ্ট্রের আর থাকা না থাকায় কিছু যায় আসে না বা খামাখা হয়ে যাওয়া।

নাগরিককে বৈষম্যহীনভাবে সুরক্ষার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হয়েছিল সরকার তা পালনে অপারগ বলে জানিয়ে দেয়া বা জেনে যাওয়া। ঝাড়খণ্ডের ঘটনায় তাবরিজ আনসারিকে লিঞ্চিং করা ও হত্যাকারীদের দাবি ছিল তাবরিজকে ভারতে থাকতে হলে ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে হবে। এমন শর্ত দেয়ার ক্ষেত্রে তারা কে, এই হত্যাকারীদের কি অধিকার আছে এই দাবি করার- তা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি। এটা যে চরমতম নাগরিক বৈষম্য সৃষ্টির একটা কাজ তা নিয়ে কারো সচেতনতা আছে মনে হয়নি। এমনকি ভারতের পার্লামেন্টে হায়দরাবাদ ও বোম্বাইয়ের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত মুসলমান এমপি ওয়ার্সি তার শপথের অনুষ্ঠানে, সেখানে তাকেও ‘জয় শ্রীরাম’ বলতে চাপ দিতে বিজেপি এমপিরা জয় শ্রীরাম বলে গগনবিদারী চিৎকার করছিল। অর্থাৎ পার্লামেন্টেও বিজেপি এমপিদের ধারণা তারা অন্য এমপির ওপর এমন বাড়তি ক্ষমতাপ্রাপ্ত যে, তারা ওয়ার্সিকে জয় শ্রীরাম বলতে বাধ্য করতে পারে। বিজেপি এমপিরা বাড়তি অধিকারপ্রাপ্ত এটাই বলতে চাচ্ছে, মোদির বিজেপি দলের এমপিরা।

ওই দিকে এসব নিয়ে মোদির প্রতিক্রিয়া আরো মারাত্মক। পার্লামেন্টে তিনি বিরোধী দলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলছেন, ‘ঝাড়খণ্ডকে লিঞ্চিংয়ের কেন্দ্র’ বা হাব বলা নাকি খুবই বেইনসাফি হবে। কারণ তিনি বলতে চাছেন, লিঞ্চিংয়ে যারা মামলা খেয়েছে তাদের বিচার তো আদালতে হচ্ছেই। মোদির ইনসাফবোধ এখানে প্রকাশ হয়ে পড়েছে। আসলে কখনো কখনো ক্রিমিনাল অপরাধের চেয়ে বড় আর মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে রাজনৈতিক বা কনস্টিটিউশনাল প্রতিশ্রুতি ভাঙার অপরাধ। ওই নাগরিক তাবরিজ আনসারিকে অধিকার বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষা করতে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন, এর শপথ নিয়েছেন তিনি। অথচ তিনি নিজের অপরাধ কী তা দেখতেই পাচ্ছেন না। মনে করছেন, এটা কেবলই লিঞ্চিংকারীদের একটা কথিত ক্রিমিনাল অপরাধ।

তামাশার দিকটি হলো ভারতের নাগরিকও সচেতন নয়, তারা জানেই না যে নাগরিকদের মধ্যে কোনো অধিকার বৈষম্য না করাÑ প্রতিশ্রুতির ওপর দাঁড়িয়ে গঠন করা হয়েছিল ভারত রাষ্ট্র। এক কথায় বলতে রাষ্ট্র কেমনে চিনতে হয়? প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা এর রিপাবলিক বৈশিষ্ট্য এ কথার মানেই বা কী? খায় না মাথায় দেয়? কেমনে তা চেনা যায়? এ ব্যাপারটা নেহরু থেকে ইন্দিরা হয়ে একাল, এমনকি অমর্ত্য সেন পর্যন্ত এরা নাগরিক বৈষম্য প্রসঙ্গে জানেন, রাষ্ট্র চিনতে পারেন বা এগুলো আমল করেছেন, এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং যেন সবারই ধারণা হলো, প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ধারণা এক কথার কথা। নেহরুর কাছে যেমন এত বড় ভারত রাষ্ট্রকে একসাথে বেঁধে ধরে রাখা- সেটা পিটাপিটি করে ধরে রাখা আর হিন্দুত্ব এই আঠা দিয়ে যুক্ত করে ধরে রাখা- এটাই প্রজাতন্ত্র। কারণ, নেহরুর আমলের প্রধান ব্যবহারিক চ্যালেঞ্জ ছিল ভারত এক রাখা। তাই হিন্দুত্বের ভিত্তিতে ভারত রাষ্ট্র খাড়া করা হচ্ছে কি না, এর চেয়েও তার কাছে গুরুত্বের ছিল যে যদি হিন্দুত্বের ভিত্তিতেই জোরজবরদস্তি ভারত এক রাখা সহজ হয়, তবে সেটাই তার প্রজাতন্ত্র ভারত।

পরে ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে এসে আবিষ্কার করেন সেকুলারিজম হলো প্রজাতন্ত্রের আসল বৈশিষ্ট্য, কিন্তু খেয়াল করলেন ভারতের কনস্টিটিউশন ১৯৪৯ সালে পাস হলেও তাতে ভারত সেকুলার কি না, তা লেখা নেই। তাই ১৯৭৬ সালে অধিক ক্ষমতার বলে সে সময়ে সংশোধনী এনে লেখিয়েছিলেন যে ভারত সেকুলার। তার চোখে এটাই হলো প্রজাতন্ত্র ভারতের আসল বৈশিষ্ট্য। আর সেই থেকে ভারতের সেকুলারিস্ট বলে প্রজন্ম প্রজাতন্ত্র কী তা বোঝার দায়দায়িত্ব ফেলে রেখে আরামে ঘুমাতে গিয়েছিল। কিন্তু একালে মোদি ক্ষমতায় আসার পর এক অমর্ত্য সেনকেই দেখা যাচ্ছিল আপত্তি করছেন, মোদির নাকি গন্ধ ঠিক নেই, কারণ তিনি সেকুলার নন। তবে এর মানে কী? তিনি কী বলতে চান? যে মোদির ভারত আর প্রজাতান্ত্রিক নয়? তাই কী? কিন্তু সেটাই বা তিনি বুঝেছেন কী দিয়ে? সেটা কারো জানা নেই। যা জানা, সেই সেকুলারিজম তো মোদি কনস্টিটিউশন থেকে ফেলে দেননি। তাহলে অমর্ত্য সেনের আপত্তিটা ঠিক কী? অথচ মোদি ফান্ডামেন্টাল প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী প্রধানমন্ত্রী।

এ জন্য এবারের পাবলিক নুইসেন্স তৈরিতে লক্ষণীয় হলো, মোদি বা তার দলের সব নেতা এবার পুরোপুরি নিশ্চুপ। প্রধানমন্ত্রী নিজেও যেন লিঞ্চিংয়ের ঘটনা দেখেননি, জানেনই না, মিডিয়ায় শোনেননি এমন ঘটনা। আইন তো আছেই যা করার পারবে, করবে। প্রধানমন্ত্রীর কী? মনোভাবটা এ রকম। আর দলকে বলা এই ফাঁকে যা পারিস অত্যাচার নুইসেন্স করে নে!

আবার ভারতের সুপ্রিম কোর্ট, এই আদালতে ‘পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন’, অর্থাৎ আদালতে স্বতঃপ্রণোদিত মামলা হতে পারে, নেয়াও হয়। আদালত নিজেই বা সংক্ষুব্ধ বলে যে কেঊ আদালতে মামলার বাদি হতে পারে। বাংলাদেশে এটা দলবাজিতে চলে থাকে আর ভারতে এটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই চর্চায় প্রতিষ্ঠিত। তাই সরকারি দলের লিঙ্ক না থাকলেও সে মামলা নেয়া হয়। পাবলিক লিঞ্চিংয়ের বিরুদ্ধে দিল্লির জামে মসজিদের ইমাম প্রতিবাদ মিছিল করেছেন, অথচ আদালত তাও নির্বিকার। যেন দেখেনি, জানে না। তাদের কিছু করার নেই। অথচ সোজাসাপ্টা অধিকারে বৈষম্য চলছে। মুসলমান নাগরিক বলে কাউকে দেখলেই এক হিন্দু নাগরিক মনে করছেন, তার পছন্দের সেøাগান জয় শ্রীরাম বলতে তিনি ওই মুসলমান নাগরিককে বাধ্য করতে পারেন। কারণ, অধিকার বৈষম্য আছে আর তিনি তো ওপরে!

যারা লিটিগেশন মামলার গুরু, সেই প্রশান্ত ভূষণরাও কি তাই ভাবছেন? বাধ্য করতে পারে মনে করছেন? এতে নাগরিক বৈষম্য হচ্ছে, এই বৈষম্য করার কারণে ভারত ভেঙে যেতে পারে! নাকি পাবলিক এই বাধ্য করার কাজ, এ কাজটা এতই সঠিক মনে করছে যে প্রশান্ত ভূষণ বা যে কেউ এমন অধিকার বৈষম্য হতে দিতে সহায়তা করার অভিযোগে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনলে অভিযোগকারী নিজেরাও লিঞ্চিংয়ের শিকার হতে পারেন? ব্যাপারটা কি এমন ভয়ের?

এমনকি বিচারকেরা? তারাও কি ভয়ে সিটিয়ে গেছেন? নাকি সবাই হিন্দুত্বের মহিমা দেখে আপ্লুত ও বুঁদ হয়ে গেছেন?

মনার্কি বা রাজতন্ত্রের বিপরীতে প্রজাতন্ত্র ধারণায় এর এক মূলকথা হলো ক্ষমতা প্রসঙ্গে। প্রজাতন্ত্রে এখানে শাসককে শাসন ক্ষমতা কে দিয়েছে, কোথা থেকে আনা হয়েছে এর হদিস লুকানো নয়। নাগরিক নিজেই গণসম্মতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন করে শাসককে শাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা দিয়েছে। শাসকের ক্ষমতার উৎস তাই নাগরিকদের ডেলিগেটেড ক্ষমতা।

এ ছাড়া, প্রজাতন্ত্রের আরেক বৈশিষ্ট্য হলো তালিকা করে রাখা নাগরিক অধিকার রক্ষা আর, সেগুলো নাগরিককে ভোগ করতে দেয়া আর নাগরিকের মধ্যে কোনো বৈষম্য না করে অথবা আর কাউকে করতে না দিয়ে এসব কাজ বাস্তবায়ন করবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়েই শাসক শাসনক্ষমতা পায়।

শাসক এর ব্যত্যয় ঘটালে বুঝতে হবে রাষ্ট্র গঠনকালীন দেয়া শর্ত প্রতিশ্রুতি আর নেই। রাষ্ট্র ক্রমেই এখন দুর্বল হয়ে ভেঙে পড়বে।
তাই সেকুলারিজম বলে কোনো আলগা, অবুঝ না-বুঝ কথা নয়, বরং নাগরিক বৈষম্যহীনতা রক্ষা করা, কাউকে করতে না দেয়া এটাই ফান্ডামেন্টাল। তবে ভারতের সংবিধানে নাগরিক বৈষম্যহীনতা রক্ষার কথা নেই, তা নয়। কিন্তু এর গুরুত্ব রাজনৈতিকভাবে সমাজের রাজনীতিতে তা হাজির নেই, দেখাই যাচ্ছে। তাই খামাখা শব্দ হয়ে আছে এটা। আর হিন্দু কোনো নাগরিক মনে করছে, তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলে অন্যের ওপর নাগরিক বৈষম্য করতেই পারে। মুসলমানদের জয় শ্রীরাম বলাতেই পারে, বাধ্য করতে পারে।

অথচ রাজনীতিবিদদের দরকার ছিল- কেন নাগরিক বৈষম্যহীনতার নীতি অনুসরণ করা নাগরিককে দেয়া রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি হয়- এটা বুঝে নেয়া। আর কেন এটা মৌলিক তা-ও নিজে বোঝা ও সব ধরনের নাগরিককেই সেটা বোঝানো। ওই দিকে আদালতের উচিত হতো নাগরিক বৈষম্যকারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া। এমনকি নির্বাচন কমিশনের উচিত হতো বিজেপির বিরুদ্ধে শর্ত আরোপ করা, যে নাগরিক বৈষম্যমূলক রাজনীতির চর্চা করলে দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিলসহ দলের নেতাদের আইনি শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

অথচ এখানে হচ্ছে পুরো উল্টো। হিন্দুত্বের প্রধানমন্ত্রী নিজেই নাগরিক বৈষম্য ঘটাচ্ছেন। যার রক্ষা করা ছিল দায়িত্ব, তিনিই প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী। আর ওই দিকে আদালত বা নির্বাচন কমিশন- এরা নিষ্ক্রিয়। এমনকি এক ধরনের হিন্দুত্ববাদী পাবলিক তারাও বেপরোয়া। বিজেপির হিন্দু নারী নেত্রী প্রকাশ্যে লিখে মুসলমান নারীদের গণধর্ষণ করার জন্য হিন্দু পুরুষদের আহ্বান রাখছেন। আর বিজেপি বড়জোর তাকে দল থেকে বহিষ্কার করে দায় শেষ করছে। কোনো ক্রিমিনাল চার্জ আনেনি।

এ কারণেই আমরা অনেকবার বলছি, ভারত রাষ্ট্রটা জন্ম থেকেই গড়ে উঠেছে হিন্দুত্ববাদের ভিত্তিতে। কংগ্রেস দল মূলত এই কাণ্ডের হোতা। বিজেপির সাথে তার ফারাক এতটুকুই যে, বিজেপি হিন্দুত্বের ভিত্তির কথা না লুকিয়েই বলতে চায়, এটাই তার রাজনীতির ভিত্তি, চর্চা করতে চায় সে। আর কংগ্রেস মনে করে হিন্দুত্ব পরিচয়কে সেকুলার নামের জামার নিচে রেখে দিয়ে চলতে।

এই বিষয়টাই এখন একেবারেই উদাম হয়ে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী মোদি এবার ভোট পেতে পাহাড়ের তীর্থস্থানে গিয়ে ধ্যানে বসেছিলেন। আর তাতে কংগ্রেস মিডিয়াতে এসে বলেছিল, এখানে তাদের নেতা রাহুলই শ্রেষ্ঠ। কারণ মোদি ওই পাহাড়ে গেছেন হেলিকপ্টারে চড়ে আর আমাদের নেতা গেছেন শেষ মাইলখানেক হেঁটে। মানে মোদির সাথে কে কত বড় হিন্দুত্বের জিগির তুলে রাজনীতি করতে পারে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছে এখন ‘সেকুলার’ কংগ্রেস। গত নির্বাচনী প্রচারণা রাহুল তা শুরুই করেছিলেন মোদির সাথে প্রতিযোগিতা করে অসংখ্য মন্দির দর্শন করেছেন দেখিয়ে। আর কংগ্রেস এখন তো সরাসরি বলছে, তারাও হিন্দুত্বই করছে। তবে মোদিরটা হার্ড হিন্দুত্ব আর তাদেরটা সফট হিন্দুত্ব।

সর্বশেষ ঘটনা আরো মারাত্মক। রাহুলের মা কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া আবার দলের হাল ধরেছেন। তার দলের সংসদীয় (মূলত তার অধস্তন) নেতা এবার বানিয়েছেন পশ্চিম বাংলার বহরমপুরের এমপি অধীর চৌধুরীকে। সোনিয়ার নতুন নীতি হলো, তিনিও এখন থেকে হিন্দুত্বের রাজনীতিই করবেন, বিজেপির থেকে ভাগ চেয়ে বা কেড়ে নেবেন। কিভাবে?

এ কথা এখন সব পক্ষের কাছেই সুপ্রতিষ্ঠিত যে, মুসলমানবিদ্বেষ গত নির্বাচনে এককভাবেই এক মূল উপাদান, প্রধান প্রভাবশালী ইস্যু ছিল। মোদি এটা ব্যবহার করেই সফলভাবে জিতেছেন। মুসলমানবিদ্বেষ মানে পাকিস্তানবিদ্বেষ, আর তাই পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিতে পারার বোলচাল- ভারতের এই রাজনীতি, আর এর সাথে সীমান্ত সঙ্ঘাত দেখানে আর সেখানে বিজেপিই একমাত্র হিন্দুস্বার্থের দলÑ সেভাবে নিজেদের তুলে ধরা। বিজেপির সাফল্য এখানেই। তাতে পাকিস্তানের সাথে এখনই কোনো সঙ্ঘাতের ইস্যু থাক আর না-ই থাক। জলজ্যান্ত এই হিন্দুত্বকে ভারতের মিডিয়াগুলো এ বিষয়টিকে খুবই ভদ্রভাবে প্রলেপ দিয়ে বলছে, ভারতের জনগণের কাছে এটা নাকি নিরাপত্তা ইস্যু। তাই তারা মোদির আমলে চাকরি না পেলেও নিরাপত্তার ভয়ে কাবু হয়ে মুসলমানদের মাথায় বোমা মেরে আসা মোদিকেই ভোট দিয়েছে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement