২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বলী নিজেই এবার ‘বলি’

বলী নিজেই এবার ‘বলি’ - ছবি : সংগ্রহ

‘বলি প্রথা’ ছিল ধর্মের নামে চরম অধর্ম। বালা-মুসিবত থেকে রক্ষায় দেবতার সুনজর কাড়তে এবং তার সন্তুষ্টির জন্য একসময় মানব সমাজে নরবলির প্রচলন ছিল। বেদিতে নরবলি দেখে অনেকে পেত পৈশাচিক আনন্দ, যা অমানবিক আর নিষ্ঠুর হওয়ায় পরিত্যক্ত হয়। তবে এখনো কদাচিৎ ‘পাঁঠা বলি’ দেয়ার কথা শোনা যায়। নির্দোষ কেউ কোনো ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে বলা হয় ‘বলির পাঁঠা’।

চট্টগ্রাম অঞ্চলে তুমুল জনপ্রিয় ‘জব্বারের বলী খেলা’। তবে নর বা পাঁঠা বলি দেয়ার সাথে এর বিন্দুমাত্র যোগসূত্র নেই। বল অর্থ শক্তি। সাথে ‘ঈ’ প্রত্যয় যোগ করে হয় ‘বলী’। এর সরল মানে দাঁড়ায়, যিনি শক্তিশালী তিনিই বলী। এটি নিখাদ একটি কুস্তি খেলা, যা দর্শকদের দেয় অনাবিল আনন্দ। জাপানিরা যাকে আদর করে ডাকে ‘সুমো’। খেলাটির বৃত্তান্ত জানলে এ শতবর্ষী ঐতিহ্যের সাথে একাত্ম হয়ে আমরা হতে পারি পুলকিত আর গর্বিত।

বন্দরনগরী চট্টগ্রামের লালদীঘির পাড়ে প্রতি বছর বৈশাখের ১২ তারিখে জব্বারের বলী খেলা নামে কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়ে থাকে। প্রতি বছরই বাংলা নববর্ষের সূচনায় ইতিহাস প্রসিদ্ধ লালদীঘি মাঠ ও আশপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বসে বৈশাখী মেলা। বৈশাখের এ বিশেষ দিনে মাঠের অভ্যন্তরে চট্টগ্রাম এবং আরো কয়েকটি অঞ্চলের সেরা কুস্তিগিরদের লড়াই হয়ে থাকে। কুস্তিগিররা চট্টগ্রামবাসীর কাছে ‘বলী’ হিসেবে পরিচিত। তাই লালদীঘির কুস্তি প্রতিযোগিতা ‘বলী খেলা’ নামে খ্যাত।

‘জব্বারের বলী খেলা’র আগে থেকেই চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে এর প্রচলন ছিল। এ খেলার ছিল একটা দুর্বার আকর্ষণ, বিশেষ করে উঠতি বয়সের তরুণদের কাছে। বলী খেলাকে পৌরুষের প্রতীক মনে করা হতো। কোনো গ্রামে বলী খেলা হওয়ার আগে থেকেই আশপাশের হাটবাজারে ঢোল পিটিয়ে প্রচার করা হতো। সর্বশ্রেষ্ঠ বলীকে সোনার এবং অন্যদের রুপার মেডেল দিয়ে পুরস্কৃত করা হতো। খেলার দিন নির্দিষ্ট স্থানে, যেখানে খেলা হবে, সকাল থেকে ঢোল বাজিয়ে আবহ তৈরি করা হতো। বিকেলে দর্শক ও বলীর দল ঢোলবাদ্যসহ পৌঁছে যেত বলী খেলার মাঠে।

ঐতিহাসিক সূত্র মতে, কর্ণফুলী ও শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী ১৯টি গ্রামে মল্ল উপাধিধারী মানুষের বসবাস ছিল। মল্ল পুরুষেরা ছিল দৈহিক শক্তির অধিকারী, সুঠাম দেহী, সাহসী আর ছিল হৃষ্টপুষ্ট। তাদের বংশানুক্রমিক পেশা ছিল শারীরিক শক্তি প্রদর্শন। মল্ল বীরেরা ছিল বলী খেলার প্রধান আকর্ষণ। ২২টি মল্ল পরিবারকে ইতিহাসসিদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। সেকালের বলীরা ছিলেন নিজ নিজ এলাকায় শক্তি, সাহস ও পৌরুষের প্রতীক। তখন এক এলাকার মানুষের সাথে আরেক এলাকার মানুষের নানা কারণে লেগে থাকত মারামারি। অনেক সময় তা দাঙ্গা-হাঙ্গামা পর্যন্ত গড়াত।

চট্টগ্রাম মহানগরীর একটি প্রাচীন মহল্লা বকশীর হাট। এখানকার একটি ছোট গলির নাম বদরপাতি। এ বদরপাতিরই এক বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর ১৯০৯ সালে লালদীঘির মাঠে বলী খেলার প্রবর্তন করেন। গোলাম রসুল সওদাগরের বেটা আবদুল জব্বার চিন্তাচেতনায় ছিলেন ঔপনিবেশিক শাসক ব্রিটিশবিরোধী। স্বাধীনতার লক্ষ্যে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিতে তরুণদের শরীর গঠনের ওপর জোর দেয়া হয়।

এ রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে আবদুল জব্বার ‘সওদাগর’ তরুণ-যুবাদের শরীর গঠনে বলী খেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেন। তার ইচ্ছা ছিল যুবকেরা সাহসী হয়ে উঠুক, শক্তি সঞ্চয় করুক এবং যে দিন দেশের জন্য ডাক আসবে সে দিন যেন তারা সাহসী ভূমিকা রাখতে পারে। দেশের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে যেন পিছপা না হয়। এ হলো জব্বারের বলী খেলা প্রচলনের গল্প।

এ খেলা শতবর্ষ পেরিয়ে আজ ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে। তাই জব্বারের বলী খেলা আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, আমাদের অহঙ্কার। বলী খেলাকে বিশ্ব-ঐতিহ্যের অংশ করতে উদ্যোগ গ্রহণে গত বছর সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে মেলা কর্তৃপক্ষ। তবে এখনো তা বেশি দূর এগোয়নি।

বছর ঘুরে এবারো অনুষ্ঠিত হয়েছে জব্বারের বলী খেলা আর বৈশাখী মেলা। এবার ছিল বলী খেলার ১১০তম আসর। শতবর্ষী এ বলী খেলা এবং মেলার দিকে শুধু এ অঞ্চলই নয়, সারা দেশের অনেক মানুষের দৃষ্টি থাকে। বংশপরম্পরায় এ মেলা ঘিরে চলে বাণিজ্যের ঘরবসতি। তিন দিনের মেলা হলেও সপ্তাহব্যাপী নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে চলে বিকিকিনি। এই আয়োজনের তারিখটির কথা কাউকে মনে করিয়ে দিতে হয় না। আমন্ত্রণও জানাতে হয় না। বিনা দাওয়াতেই বিপুল দর্শক এসে হাজির হয়ে যান।

সেই জব্বারের বলী খেলার হালসময়ের ‘শ্রেষ্ঠ বলী’ বলা হয় দুর্দান্ত বলী খেলোয়াড় দিদারুল ইসলামকে। দেশে যিনি ‘দিদার বলী’ নামেই খ্যাত। একবার-দু’বার নয়, ১২ বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। যুগ্মভাবে চ্যাম্পিয়ন আরো তিনবার। কক্সবাজারের বিখ্যাত ‘ডিসি সাহেবের বলী খেলা’তেও ১৫ বার চ্যাম্পিয়ন আর তিনবার যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন। দীর্ঘ খেলোয়াড়ি জীবনে ‘হার’ বলতে কিছু নেই তার। সেই তিনি এবার অংশ নিতে পারছেন না ডিসি সাহেবের বলী খেলায়।

তাকে বাদ দিয়েছেন আয়োজকেরা। মানে ‘বলি’ আর কী! মাদক কেলেঙ্কারিতে বাদ পড়ছেন খেলা থেকে। অনেকে বলছেন, এর মধ্য দিয়ে দিদার বলীর খেলোয়াড়ি জীবন হুমকিতে পড়ল। দুই বছর আগে জব্বারের বলী খেলা থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন দিদার বলী। তবে অন্য বলী খেলাগুলোয় দিদারকে পেতেন দর্শকেরা। এবার ডিসি সাহেবের আসর থেকে বাদ পড়ায় দিদারের দিদার থেকে বঞ্চিত হবেন অসংখ্য দর্শক। এতে করে হয়তো তার খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি টানতে হচ্ছে।

সব দেশে, সব কালে একটি বিষয় লক্ষণীয়- বড় বড় তারকা কিংবা বিখ্যাত ব্যক্তি কখনো-সখনো সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা প্রথা ভাঙেন। তাদের সেই লঙ্ঘনাচরণ সজ্ঞানেও হয়, ‘অজ্ঞানে’ও হয়। যেভাবেই হোক, যেহেতু তারা ‘হাই প্রোফাইল’, সেহেতু অনেকসময় সেই বিধি লঙ্ঘনকে ‘স্নেহের চোখে’ দেখা হয়। নৈতিকভাবে তাদের দায়মুক্তি দিতে তখন যে কথাটি উচ্চারণ হয় তা হলো, ‘লজ আর মেন্ট টু বি ব্রোকেন’। মানে, আইন বানানোই হয় তা ভাঙার জন্য।

দিদার বলীর কপালে তা জুটল না। কপাল ভারি মন্দ। অথচ তিনি রীতিমতো সেলিব্রেটি। অতএব, আইন একটু-আধটু ভাঙতেই পারেন! দেশে দেশে সেলিব্রেটিদের তো ছাড় দেয়া হয়। এ কথাও ঠিক, অলিম্পিক আসরে শরীরে উত্তেজক ড্রাগ নেয়ার পরে প্রস্রাব পরীক্ষায় ধরা পড়লে অনেকের পদক কেড়ে নেয়ার নজির রয়েছে।

‘ডিসি সাহেবের বলী খেলা’ থেকে বাদ পড়ায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন দিদার বলী। তার দাবি, ঠাণ্ডামাথায় তাকে ইয়াবা-জালে ফাঁসানো হয়েছে। এখন খেলা থেকেও বাদ দেয়া হচ্ছে। এই বলীর বাড়ি কক্সবাজারের রামুর দক্ষিণ মিঠাছড়ি উমখালী গ্রামে। ১৯৯৮ সাল থেকে বলী খেলা শুরু করেন তিনি। ২০০১ সালে কক্সবাজারের ডিসি সাহেবের বলী খেলায় প্রথম অংশ নেন। সেই থেকেই লাগাতার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। জব্বারের বলী খেলাতেও টানা চ্যাম্পিয়ন ট্রফি অর্জনের ইতিহাস গড়েন; কিন্তু ইয়াবা সম্পৃক্ততায় সব অর্জনই এখন ম্লান হওয়ার পথে। ধুলোয় লুটিয়ে যাওয়ার উপক্রম।

গত বছরের ২৮ জুন ময়মনসিংহে দুই বন্ধুসহ ইয়াবা নিয়ে আটক হন দিদার বলী। ১১ দিন ছিলেন শ্রীঘরে। ইয়াবাসহ আটকের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছিল। তবে দিদার বলীর ভাষ্য, ওই দিন ময়মনসিংহে গিয়ে গাড়ি ছিনতাইকারী চক্রের কবলে পড়েন তিনিসহ তিন বন্ধু। ছিনতাইকারীরা তার গাড়ি ছিনতাইয়ে ফেঁসে গিয়ে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে ৮০টি ইয়াবা দিয়ে তাকে আর বন্ধুদের পুলিশে দেয়। তার মতো একজন দর্শকপ্রিয় বলীর এমন কাণ্ডে চার দিকে ছি-ছি পড়ে যায়।

সাধারণের পাশাপাশি ভক্তরাও ক্ষুব্ধ হন। মাদকসম্পৃক্ত ব্যক্তি হিসেবে তাকে ক্রীড়াঙ্গন থেকে বাদ দেয়ার দাবি ওঠে। কর্তৃপক্ষ বলেছে, জনদাবির মুখে বলী খেলা থেকে বাদ যাচ্ছে দিদার বলীর নাম। ১৭ এপ্রিল জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে হয়েছে বলী খেলার প্রস্তুতি সভা। ওই সভায় দিদার বলীকে খেলা থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তুমুল জনপ্রিয় দিদার বলীর অনুপস্থিতিতে তার খুবসুরত দর্শন থেকে বঞ্চিত হবেন দর্শক। তাদের জন্য এটি বড়ই পরিতাপের বিষয়!

কক্সবাজারের বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন স্টেডিয়ামে ৩-৪ মে হওয়ার কথা ছিল ডিসি সাহেবের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা। তবে ‘ফণী’র ফণায় তেমন কিছু না হলেও ডিসি সাহেবের বলী খেলা ও বৈশাখী মেলা স্থগিত করা হয়েছে। রোজার পরে এটা অনুষ্ঠিত হবে বলে জানানো হয়েছে।
camirhamza@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement
আওয়ামী লীগকে ‘ভারতীয় পণ্য’ বললেন গয়েশ্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় সন্ত্রাসীদের ছুরিকাঘাতে দাগনভুঞার যুবক নিহত কাশ্মিরে ট্যাক্সি খাদে পড়ে নিহত ১০ অবশেষে অধিনায়কের ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছল পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থাকে আবার অর্থায়ন শুরু করবে জাপান শেখ হাসিনার অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি বিএনপিকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে : ওবায়দুল কাদের রাশিয়া সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্টে ১৬.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে সিরিয়ায় ইসরাইলি হামলায় নিহত ৩৬ সেনা সদস্য দৌলতদিয়া ঘাটে পন্টুন থেকে নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ বাতিল করে কেন নতুনের জন্য বিজ্ঞপ্তি! বাইডেনের মেয়াদে রুশ-মার্কিন সম্পর্কের উন্নতির কোনো আশা নেই : রুশ রাষ্ট্রদূত

সকল