১৯ মার্চ ২০২৪, ০৫ চৈত্র ১৪২৯, ০৮ রমজান ১৪৪৫
`

চীন-পাকিস্তান সম্পর্কের হদিস জানা

ইমরান খান ও শি জিনপিং - ছবি : সংগ্রহ

পাকিস্তানে ইমরান খানের ক্ষমতায় আসা এ এক নতুন ধরনের ক্ষমতা। আমাদের আগের দেখা বা পুরনো অভিজ্ঞতায় যেসব ধারণা আছে তা থেকে একেবারেই ভিন্ন। আমাদের মতো রাষ্ট্র মানেই আমরা সাধারণত দেখি এক বিশেষ কোটারি অথবা ব্যক্তিস্বার্থে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট ও দুর্নীতি ঘটবেই। এটা গেল এক দিক আর অন্য দিকে থাকবে ওই গোষ্ঠী নিজেদের কোটারি কোনো লাভালাভের লোভে বিদেশী কোনো স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে। এগুলোই প্রায় সবখানেই আমরা দেখতে অভ্যস্ত। পাকিস্তানের ইমরানের আগমন অন্তত এই অর্থে নতুন যে, এই ক্ষমতা আমাদের দেখা বা জানা থেকে একেবারেই ভিন্ন। এখানে অনেক কিছুই আমরা ভিন্ন দেখব।

কিন্তু কতটুকু নতুন বা ভিন্ন? সে প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পাকিস্তানের বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা দরকার। সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো, পাকিস্তান পাকিস্তানের জন্য কাজ বা পদক্ষেপ নিতে পারে না। অন্তত পারেনি। পাকিস্তান আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করে এসেছে সেই ১৯৭৯ সাল থেকে, যে ধরনের যুদ্ধকে আমরা ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ বলি। প্রক্সি মানে হলো, স্কুলের ক্লাসরুমে নাম ডাকার সময় বন্ধুর হয়ে ‘উপস্থিত’ বলার মতো। শুরুর ঘটনা হলো, ১৯৭৯ সালে ইরানে বিপ্লব হওয়া, আর তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন মধ্য এশিয়ায় এই বিপ্লবের প্রভাব পড়তে পারে এই ভয় পেয়ে (বাফার গড়তে) আফগানিস্তান দখল করা, আর এবার তা ঠেকাতে বা উল্টে দিতে আমেরিকা, পাকিস্তানকে দিয়ে নিজের প্রক্সি যুদ্ধ শুরু করা, এটা ছিল প্রথম পর্ব। আর এরই লেজ ধরে দ্বিতীয় পর্বে, আলকায়েদা-তালেবান বনাম আমেরিকার ওয়ার-অন টেরর যুদ্ধে এরই ময়দান হিসেবে পাকিস্তানের ব্যবহৃত হওয়া।

ফলে এই দুই ইস্যুতে গত ৩৮ বছর ধরে পাকিস্তান অন্যের হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে আছে। আর এর মধ্যে তা যতটা না নিজ স্বার্থে এর চেয়ে অনেক গুণ বেশি আমেরিকান চাপ, স্বার্থে আর ওর বাধ্যবাধকতায়। এই অবস্থা বিচারে পাকিস্তান আর অন্য রাষ্ট্রের মতো থাকেনি। এ এক বিরাট ব্যতিক্রম। এই বিচারে পাকিস্তান আমাদের মতো একই পাল্লায় তুলনাযোগ্য রাষ্ট্র কি না সেই প্রশ্ন অনেকে তুলতে পারেন। এই আলোকেই সার কথাটা হলো, গত ৩৮ বছরে পাকিস্তান পাকিস্তানের জন্য, নিজের জন্য রাষ্ট্র থাকেনি, কাজ করেনি।

কিন্তু সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, পাকিস্তান নিয়ে যেকোনো আলোচনার সময় বেশির ভাগ মানুষ পাকিস্তান রাষ্ট্রের যেকোনো সিদ্ধান্ত যে পাকিস্তানের নয়- এই প্রক্সি-খেটে বেড়ানো, বিশেষ করে আমেরিকান স্বার্থের দায়ের বাধ্যবাধকতায় চলে বেড়ানো, সে কথা মনে রাখে না। পাকিস্তান স্বাধীন- এই অনুমান ধরে নিয়ে এরপর পাকিস্তানের সমালোচনা ও মূল্যায়ন শুরু করেন। সবচেয়ে তামাশার কথা হলো, বুশের আমল থেকে পরের সব আমেরিকান প্রশাসন পাকিস্তানের যেকোনো সিদ্ধান্ত পদক্ষেপ যে আমেরিকারই স্বার্থে প্রক্সি পদক্ষেপ সে কথা স্বীকার না করে, দায় না নিয়ে উল্টো পাকিস্তানের সমালোচনা করে গেছে।

তবু এগুলোও মূল বিষয় নয়, আরো দিক আছে। তা হলো, পাকিস্তানের অপর দু’টি দল নওয়াজের পিএমএল আর ভুট্টো পরিবারের পিপিপির ভূমিকা। তারা এই প্রক্সি যুদ্ধের পাকিস্তান পরিস্থিতিতে নিজেরা যে ন্যক্কারজনক ভূমিকা নিয়েছে তা হলো, যেহেতু আমেরিকান ইচ্ছা, চাহিদা বা সিদ্ধান্ত তাদের পক্ষে এড়ানো বা ভিন্ন কিছু করা সম্ভব নয়, তাই ক্ষমতায় থেকে চুরি আর লুটপাটের বন্যা বইয়ে দেয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ- কারণ আমেরিকানদের খেদমত করার কারণে ক্ষমতা তো নিশ্চিত! আর তাতে দায় দোষারোপ সব আমেরিকার ওপর দেয়া যাবে। এই দুই দল এখান থেকে পাকিস্তানকে দেখেছে- আর এটাই পাকিস্তানের দুরবস্থার সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের দিক। এ কারণে আজ পাকিস্তানের ক্ষমতার করিডোরের আলাপে এক চালু হিসাব হলো, নওয়াজ অর্থ লোপাট করে বিদেশে রেখেছে দুই বিলিয়ন ডলার, আর ভুট্টো পরিবার রেখেছে এক বিলিয়ন।

এভাবে পাকিস্তানের অর্থনীতি ফোকলা অবস্থায়। পাকিস্তানের নির্বাচনে ইমরান এবার ক্ষমতায় এসেছেন। বলা হচ্ছে, পাকিস্তানের দেউলিয়া এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পেতে ১৩ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। পাকিস্তান রুপির ডলার বিনিময় মূল্য গত এক বছরে ৯১ থেকে নেমে এখন ১৩৪ রুপিতে ঠেকেছে। কথাগুলো বলছি এ জন্য যে, ইমরানের ক্ষমতার প্রথম মাস তার কেটেছে সৌদি, চীন নাকি আইএমএফ কার কাছ থেকে ‘বেল আউট’-এর অর্থ পেতে পারে সেই খোঁজাখুঁজিতে। সর্বশেষ খবর হলো, পাকিস্তান আনুষ্ঠানিকভাবে আইএমএফের কাছে সাত বিলিয়ন ডলারের বেল আউট ঋণ চেয়ে আবেদন পেশ করেছে। আনুষ্ঠানিক ভাষায়, এটা পাকিস্তানের ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্টের ঘাটতি’ মেটানোর ঋণ।

গ্লোবাল অর্থনীতির দিক বিচারে এশিয়ায় এটা মূলত চীন-আমেরিকার লড়াই; অর্থনৈতিক পরাশক্তি হিসেবে পালাবদলে এটা আমেরিকার জায়গায় চীনের আগমনের কাল। এই লড়াইয়ে আমেরিকার দিক থেকে এটা তার প্রভাব ও ক্ষমতার পতন ঠেকানোর লড়াই। আর চীনের দিক থেকে নিজের প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়িয়ে নিজে উত্থান নিশ্চিত করার লড়াই। এ দিকে এই মূল লড়াইয়ে হারু পার্টি আমেরিকা, এ কাজে বাড়তি সুবিধা নিতে ভারতকে নিজের পক্ষে রাখার চেষ্টা করে চলছে।

চীন-পাকিস্তান করিডোর প্রকল্প- মোট ৬২ বিলিয়ন ডলারের এক প্রকল্প যা উত্তর দক্ষিণ বরাবর পাকিস্তানের বুক চিড়ে করাচির গোয়াদরের গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে একেবারে চীনের উইঘুর (জিনজিয়াং) প্রদেশের কাশগড় পর্যন্ত হাইওয়ে তৈরি হচ্ছে। এই প্রকল্পটা আসলে চীনকেই পাকিস্তানের করিডোর দেয়া। অর্থাৎ পুরোটাই কেবল পাকিস্তানের স্বার্থে নেয়া কোনো অবকাঠামো প্রকল্প নয়। চীনের উইঘুর প্রদেশ ল্যান্ডলকড অঞ্চল; ফলে এর বধ্যদশা ঘুচাতে, রাজনৈতিকভাবে উইঘুর মুসলমানদের উইন করতে, তাদের পিছিয়ে থাকা দশা থেকে মুক্ত করতে চীন এটা নিজের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প মনে করে।

কিন্তু আমেরিকা (সাথে ভারতও) নিজেদের সন্দেহ ও স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে চীন-পাকিস্তানের এই বাস্তব বৈষয়িক ঘনিষ্ঠতার চরমতম বিরোধিতা করে। পাকিস্তান আমেরিকার প্রভাবের হাত থেকে ছুটকারা পেয়ে যাচ্ছে এই প্রকল্পের মতো তৎপরতার কারণে। ফলে এই প্রকল্প পুরোটাই আমেরিকান স্বার্থের বিরোধী। আমেরিকা ও ভারতের জন্য আর এক চরম অস্বস্তিকর একটা ফ্যাক্টস হলো, করিডোর প্রকল্প পাকিস্তানের মূল চার প্রদেশকে এক সাথে এক জায়গায় এনেছে। এই প্রকল্প পাকিস্তানের সব প্রদেশের ওপর দিয়ে গেছে, তাই এটা কেবল কেন্দ্রের নয় পাকিস্তানের সব প্রাদেশিক সরকারও স্বাধীনভাবে নিজের স্বার্থের দিক থেকে এই প্রকল্প অনুমোদন করেছে। এমনকি বেলুচিস্তান যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন আছে তারাও কোনো পক্ষ এই প্রকল্পের ঠিক বিরোধী নয়।

এসব কিছুর মূল কারণ সব প্রদেশে ও জনগণও এই প্রকল্পকে দেখে থাকে এক হাইওয়ে ধরে গভীর সমুদ্রবন্দরে পৌঁছানোর সুযোগ, নিজ নিজ স্বার্থে বিকশিত হওয়ার জন্য এক বিরাট নিয়ামতের মতো মনে করে। ফলে চার প্রদেশ অন্তত একটা ইস্যুতে পুরো পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। আবার চীনেরও স্বার্থে এই অবকাঠামো প্রকল্প ব্যবহৃত হবে বলে এর অর্থনৈতিক ভায়াবিলিটির দায়ভার এবং এর ঋণ পরিশোধের দায় পাকিস্তানের সাথে চীনেরও। কিন্তু সেটা কিভাবে পারস্পরিক চুক্তিতে লেখা আছে- সেটা বিলিয়ন ডলারের এক কৌতূহল আমেরিকার (সাথে ভারতও) কাছে। তাদের অনুমান চীন-পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক সামরিক বোঝাবুঝি এই চুক্তির মধ্যে প্রতিফলিত থাকবে।
আইএমএফের কাছে আনুষ্ঠানিক আবেদনের পরে এখন আইএমএফ টিমের পাকিস্তান সফর এবং মূল্যায়নে বসা নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে খবর হলো, আইএমএফের প্রেসিডেন্ট লাগার্দে বলেছেন, তাদের করিডোর প্রকল্পও ক্ষতিয়ে দেখতে হবে যাতে তারা বুঝতে পারে, পরিষ্কার ধারণা পেতে পারে যে পাকিস্তানকে ঋণ দেয়া আইএমএফের জন্য কতটা রিস্ক বা দায়ের।

এটাই হলো আসল ইস্যু। আগেই বলেছি, আমেরিকার (সাথে ভারতও) কাছে তাদের অনুমান হলো চীন-পাকিস্তানের ওই প্রকল্পের চুক্তিতে চীন-পাকিস্তানের স্ট্র্যাটেজিক সামরিক বোঝাবুঝি এই চুক্তির মধ্যে প্রতিফলিত থাকবে। তাই তাদের প্রবল কৌতূহল ওই চুক্তিতে কী আছে তা জানার।

এখন আইএমএফকে দিয়ে আমেরিকা কি তার সেই প্রবল আগ্রহ আর কৌতূহল মেটাতে পারবে?
আমরা স্মরণ করতে পারি, ইমরান খান সরকারের শপথ নেয়ার মুহূর্তে পাকিস্তানের লোন প্রসঙ্গ উঠতেই আমেরিকান পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেই হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘আইএমএফ থেকে ঋণ নিয়ে চীনের ঋণের দায় শোধ করা যাবে না।’ মনে করার কারণ আছে যে, লাগার্দের এখনকার মন্তব্য আগের পম্পেই হুঙ্কারেরই নরম ও কারেক্ট ভার্সন। এখন দেখার বিষয় চীন-পাকিস্তান করিডোর চুক্তি পুরোটাই ওপেন না করেও পাকিস্তান আইএমএফের ঋণ হাসিল করতে পারে কি না।

দুনিয়ার জন্য বর্তমানে এক ইউনিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যখন চীনের উত্থান ঘটেইনি সেই পরিস্থিতি মানে যখন দুনিয়াতে আমাদের মতো রাষ্ট্রের কোনো ঋণ পাওয়ার একমাত্র উৎস ছিল আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক। এখন চীন উত্থিত ও বিকল্প হিসেবে আবির্ভাবের কালে আইএমএফ-বিশ্বব্যাংককেও নতুন দুনিয়াকে আমল করতে হচ্ছে। কারণ এখন আর সে একক ঋণদাতা নয়। শুধু তাই নয়, আইএমএফ যদি প্রফেশনাল প্রতিষ্ঠানের মতো না হয়ে আমেরিকান বিদেশনীতি বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে থাকতে চায় তবে এই প্রতিষ্ঠানও একদিন আমেরিকার সাথে শুকিয়ে ছোট হয়ে যাবে- সেটাও আশা করি আমরা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের আমল থাকবে!
goutamdas1958@hotmail.com


আরো সংবাদ



premium cement