২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অদ্ভুত এক পাখি

-

ভদ্রলোকের সাথে আমার মাঝে মধ্যে দেখা হয়। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে যখন বাইরে বেরোই, কিংবা বাইরে থেকে এসে ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়াই, তখনই কেবল চোখে পড়ে তাকে। বয়স আশির কাছাকাছি হবে। শরীর শুকনো ও বেঁকে গেছে, মাথার পেছন দিকে হালকা কিছু চুল আছে, মোটা কালো ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে সব সময় বিষণœ দৃষ্টি থাকে চোখে। হাফ হাতা সাদা গেঞ্জির সাথে খাটো ট্রাউজার পরে খালি পায়ে যৌথ বারান্দায় হাঁটেন। সালাম দিলে এতটা মৃদুস্বরে জবাব দেন যে প্রায়ই তা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছে না।
সেদিন দরজা খুলে কিছুটা বিস্মিত হই। কী বলতে আজই বাসার কলিং বেল টিপেছেন তিনি। আমার সালামের জবাব দিয়েই ফ্যাকাশে চোখে চাইলেন। মুখ ভার। বললাম, জি, ভেতরে আসুন।
না, একটু সমস্যায় আছি। কাঁদো কাঁদো লাগল তার কণ্ঠ।
কী রকম ?
পাখিটা খুব জ্বালাতন করছে।
কী পাখি ?
দয়া করে একটু আমার সাথে আসুন ; দেখবেন।
দাঁড়ান, একটু শার্টটা পরে আসি।
জি, আসুন।
শার্ট পরে ভদ্রলোকের সাথে তার বাসার ভেতরে যাই। ঢুকেই ড্রইং রুম। দেখলাম একটি টি-টেবিলের ওপর লোহার খাঁচা। ভেতরে এক পাখি দাঁড়ান। বিষণœ দেখাচ্ছে তাকে। চোখে ঝিমঝিম ভাব। বললাম, কী পাখি
এটা?
ময়না- ময়না চেনেন না?
এ পাখি আমি সরাসরি দেখিনি কখনো। শালিকের মতো দেখাচ্ছে। তা কী সমস্যা হয়েছে তাকে নিয়ে ?
আমার কথা শেষ না হতেই পাখিটা উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, একা, একা, একা। বড় একা। বললাম, একা বলে কী বোঝাচ্ছে এ পাখি ?
তা ও-ই জানে। এ পাখি তো একাই হয়, বেশির ভাগ। কিন্তু এমন কথা তো কখনো কোনো পাখি বলে না। আমার জীবনে শুনিনি।
ভদ্রলোকের কথা শেষ হতেই পাখিটা খাঁচার মধ্যে প্রচণ্ড রকমের ছটফট করতে লাগল। খাঁচার দেয়ালে ডানা ঝাপটায় আর অতি জোরে ঘন ঘন ডিগবাজি খায়। বললাম, অদ্ভুত আচরণ। আপনি থামতে বললে থামবে না ?
প্রশ্নই আসে না। ও কথা বললে আরো বেশি করে ডিগবাজি খাবে। একা একা বলে আরো জোরে চেঁচাবে। কী যে যন্ত্রণা দিচ্ছে !
সত্যিই অদ্ভুত !
এজন্যই আপনাকে ডেকে আনা।
ঠিক আছে, আমি একটু দেখি তবে।
জি!
খাঁচার দিকে মাথা ঝুঁকে বলতে লাগলামÑ এই যে পাখি সোনা, শোনো আমার কথা। আমার কথা শুনে সে কান পেতে রইল। আমি আবারো বলতে লাগলাম, তুমি এত করে বলছ তুমি একা। কিন্তু কথাটা কি ঠিক? কই তুমি একা ? এই যে ভদ্রলোক, উনি তোমার সাথে আছেন। আরো মানুষজন থাকবেন। তাহলে আর এসব বলার কী মানে হয় ? এবার তুমি এসব থামাও, কেমন? বড়দের সাথে এসব আচরণ করা ভালো নয়, বুঝলে ? তুমি কথা বলা পাখি, তোমার আচরণ কেন এমন হবে? অন্য পাখি হলে না হয় মানাত।
আমার এসব কথা শুরুর কয়েক সেকেন্ডের মাথায়ই সে নীরবতা ভেঙে আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে। সে কি লাফালাফি ! গলা ভেঙে একা একা শব্দ তো আছেই। আমি এবার ভদ্রলোকের মুখের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে বললাম, ব্যাপার কী বলুন তো। কোনো বিশেষ ব্যাপার কি আছে? আর একে কিভাবে পেয়েছেন ?
সে ছোটখাটো এক ঘটনা।
কী সেটা ?
কানাডা থেকে কয়েক মাসের জন্য দেশে বেড়াতে এসেছিল আমার ছেলে, তার বউ ও একমাত্র ছোট নাতি রুশাদ।
জি, তারপর ?
এক বিকালে একটা লাভ বার্ড কাকের ধাওয়া খেয়ে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বারান্দায় এসে পড়ে। খেলা ফেলে নাতি সেটাকে ধরে ফেলে। জানেন তো লাভবার্ড খোলা লোকালয়ে নিরাপদ নয়। ওকে বাইরে ছেড়ে দিতে তাই মন সায় দেয় না। তা ছাড়া নাতিও চাইছিল ওটাকে আমরা পালি। ফলে কাঁটাবন থেকে আরেকটা লাভবার্ড কিনে এনে দুটোকে একত্রে খাঁচায় ভরি। নাতি তো মহাখুশি। রাত-দিন ওদের নিয়েই কাটায়। কিন্তু গেল শীতে ঠাণ্ডা লেগে পাখি দুটো মারা যায়। খুব কষ্ট পাই আমরা। রুশাদ তো নাওয়া-খাওয়াই ছেড়ে দেয়। কিন্তু লাভবার্ড কিনতে আর মন সায় দেয় না। ফলে কাঁটাবন থেকে এই একে কিনে এনে খাঁচায় ভরে কথা শেখাই। খুব ভালো ভাব গড়ে ওঠে রুশাদের সাথে এর। কিন্তু গত পরশু রুশাদরা কানাডা ফিরে গেছে। সেই থেকে এর এ অবস্থা। রুশাদের নানী এক মাসের জন্য গাঁয়ে গেছে। বড়োসড়ো কাজের ছেলেটাকে এ-তো আরো বেশি অপছন্দ করে। তাকে দেখলেই খাঁচায় মুখথুবড়ে অদ্ভুত শব্দ করে। আমি পড়েছি মহাযন্ত্রণায়।
আচ্ছা আমি যদি একে আমার বাসায় নিয়ে যাই? চেষ্টা করে দেখতে পারি চুপ থাকানো যায় কি না।
তাহলে তো ভালোই হয়। একেবারে প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।
নিই তবে। পাখি আপনারই; শুধু পালব আমি। এই আর কি।
আপনি একেবারেই না হয় নিয়ে নিন। দামটাম কিছু দিতে হবে না।
ঠিক আছে, সে পরে দেখা যাবে। আগে এর একটা ভালো ব্যবস্থার চেষ্টা করা যাক। রুশাদ যদি ফিরে আসে তখন তো এ এমনিতেই ভালো হয়ে যাবে। নিয়ে যাই তবে। আপনার একটু উপকার যদি করা যায় !
জি, অবশ্যই।
আমি খাঁচা হাতে বাসায় ফিরি। পাখি তখনো চেঁচাচ্ছে। হঠাৎ করে পাখি পেয়ে আমার ছোট ছোট মেয়েরা তো খুশিতে আটখানা। বলা নেই, কওয়া নেই, এভাবে কথা বলিয়ে পাখি পাওয়া, খুশি হওয়ারই কথা। তাদের আদর-যতœ পেয়ে পাখিটাও যেন তৎক্ষণাৎ বোবা হয়ে গেল। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে; টুঁ শব্দটি পর্যন্ত নেই। বেশ ভালোই কাটতে থাকে পাখির দিন। মেয়েরা যখন স্কুলে থাকে, সে তখন খায়, ঘুমায়, ঝিমায়Ñ এই।
সপ্তাহ খানেক ধরে বাসায় আমি একা। গরমের ছুটিতে মেয়েরা ওদের মাকে নিয়ে তাদের নানার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। পাখিটা এই ফাঁকে তার আগের কর্মকাণ্ডে ফিরে এসেছে। যতক্ষণ বাসায় থাকি, সারাক্ষণ সেই একই চেঁচামেচি : একা, একা, একা, বড় একা! খাঁচার মধ্যে সেই একই ডানা ঝাঁপটানি, ধড়ফড়ানি, ডিগবাজি খাওয়া।
দৈনন্দিন কাজে দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার সময় ভদ্রলোককে মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে। সালাম দিয়ে আগের মতোই চুপচাপ চলে যাই। তার মতো করে বলা হয় না, পাখিটা খুব জ্বালাতন করছে। শুধু মনে মনে বলি, অদ্ভুত এক পাখি।


আরো সংবাদ



premium cement