২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মধ্যযুগ ও ইসলাম

মধ্যযুগ ও ইসলাম - ছবি : সংগৃহীত

বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই মধ্যযুগ বাক্যটি বিভিন্ন কথা-বার্তায়, পত্র-পত্রিকায় ও ম্যাগাজিনে ব্যাপক উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবে এই উচ্চারণটি আদৌ পর্যন্ত ঘৃণ্য আকারেই উচ্চারিত হয়ে আসছে। একদল কূপমন্ডুকতার আশ্রয় গ্রহণকারী শিক্ষিতজনেরা মধ্যযুগ বলতে ইসলামি সভ্যতার সোনালী যুগকেই নির্দেশ প্রদান করে (গরফফষব ধমব) মধ্যযুগের সকল বর্বরতা আর অজ্ঞতার গ্লানিগুলো ইসলামের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ইসলামি সভ্যতাকে কলুষিত করার হীন ও ব্যর্থ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। তারা মধ্যযুগের তুলনায় আধুনিক যুগকে উন্নত ও শ্রেষ্ঠতম যুগ বলে আখ্যায়িত করে প্রকারান্তরে পাশ্চাত্য সভ্যতারই গুণকীর্তন গেয়ে তাকে অন্য সভ্যতাসমূহের উপর প্রাধান্য দিয়ে সুউচ্চ আসনে আসীন করার অবিরাম প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।

এখানে একটি প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, আমরা যদি মধ্যযুগের আলোকে তাবৎ বিশ্বের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করতে চাই তাহলে আমরা আলোচনার সুবিধার্থে বিশ্বকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্য এই দুটি ভাগে বিভক্ত করে আলোচনাটি সংক্ষিপ্তভাবেই সাঙ্গ করতে পারি। আলোচনাটি যেহেতু একটি পরিচ্ছেদে সংক্ষিপ্ত আকারেই বিধৃত হচ্ছে সেখানে বিস্তারিত আকারে না গিয়ে সংক্ষিপ্তভাবেই মধ্যযুগের ইসলাম আর আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার মাঝে নিবন্ধন আকারে একটি আলোচনার অবতারণা করবো। যাতে যারা মধ্যযুগের বর্বরতা বলতে শুধু ইসলামি সভ্যতাকে চিহ্নিত করে তাকে কলুষিত করার এহেন ঘৃণ্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে তাদের জন্য মোটামুটি একটি জওয়াব হয়ে যায়। সাধারণত মধ্যযুগ বলতে কোন যুগটাকে বুঝায় এর উপর প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের ঐতিহাসিকদের ব্যাপক মতামত পাওয়া যায়। তাদের মধ্য হতে কেহ চতুর্থ শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এই সময়টাকে মধ্যযুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। আবার কেহ পঞ্চম শতাব্দী থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত যুগকে মধ্যযুগ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। কেহ একাদশ শতাব্দী থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত কালকেই মধ্যযুগ বলেছেন।

এখানে একটি প্রশ্ন হলো, মধ্যযুগকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিকদের মতামতগুলোর মধ্যে এই বিস্তর ফারাক কেন। আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, কথিত জ্ঞানী ও পন্ডিতগণ মধ্যযুগের বর্বরতা বলতে ইসলামি সভ্যতার সোনালী যুগকেই কলুষিত করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং প্রতীচ্য তথা ইউরোপের ঐতিহাসিকগণ ইউরোপে ইসলামের উত্থান ও পতনের যুগকে আর প্রাচ্য তথা ভারতীয় ঐতিহাসিকগণ ভারতে ইসলামের উত্থান ও পতনের যুগকে মধ্যযুগের বর্বরতার যুগ হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা চালিয়েছেন।

উল্লেখ্য যে, ইউরোপে ইসলামের উত্থান ঘটেছিল ৮ম শতাব্দীতে আর পতন হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে। ভারতে ইসলামের উত্থান ঘটেছিল একাদশ শতাব্দীতে আর পতন হযেছিল অষ্টাদশ শতাব্দীতে।
আবার কোনো কোনো ঐতিহাসিক চরম বিদ্বেষপ্রসূত একপেশে নীতি অবলম্বন করে ইসলামি সভ্যতার মূল (মড়ষফবহ ধমব) সোনালী যুগ ৮ম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সময়কে মধ্যযুগ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অথচ ওই সময়টি ছিল ইসলামি সভ্যতার চরম উৎকর্ষতার যুগ। এটাকে তাদের নিছক কূপমন্ডুকতা প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। মধ্যযুগটাকে যেভাবেই বিশ্লেষণ করা হউক না কেনো ইসলামি সভ্যতা তারই অর্ন্তভুক্ত। সুতরাং ওই সময়ে প্রাচ্যের ইসলামি সভ্যতা আর প্রতীচ্যের খ্রিস্টান জগৎ নিয়ে আলোচনা করলেই বোধ করি বিষয়টি প্রতিভাত হয়ে যাবে।

মধ্যযুগে ইসলামি সভ্যতার অবস্থান কেমন ছিল তা দৃঢ়ভাবে অনুমিত হওয়া যায় ইসলামি সভ্যতার প্রাণপুরুষ হযরত মুহাম্মদ (সা:) এর উক্তি থেকে। তিনি চ্যালেঞ্জ আকারে তাঁর যুগের অবস্থান বর্ণনা করে বলেন,
خير القرون قرنى ثم الذين يلونهم ثم الذين يلونهم .
“যুগগুলোর মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ আমার যুগ (সাহাবাগণসহ) অতঃপর তৎনিকটবর্তী যুগ (তাবেয়ীনের), অতঃপর তৎনিকটবর্তী যুগ তাবে তাবেয়ীনের।” বিশেষত্ব হিসেবে এ তিন যুগকে একত্রে “কারনুস সালাসাহ্্” তথা যুগত্রয় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। মুসলিম চিন্তাবিদগণ ওই সময়সীমাকে ২২০ হিজরী পর্যন্ত চিহ্নিত করেছেন। অর্থাৎ ওই সময়টা হলো ৭ম শতাব্দী থেকে ৯ম শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত।
মধ্যযুগে ইসলামি সভ্যতার মূল্যায়নকে বুঝার জন্য হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর উক্তিই যথেষ্ঠ, তবে আমি মনে করি বিষয়টি যদি আমরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অমুসলিম ঐতিহাসিকদের উক্তি দ্বারা বিশ্লেষণ করি বোধকরি বিষয়টি আরোও বিশদভাবে প্রতিভাত হবে। সঙ্গত কারণেই কিছু দালীলিক প্রমাণসম্বলিত উক্তির উদ্ধৃতি দিচিছ।
মধ্যযুগে সবচাইতে প্রভাব বিস্তারকারী ধর্ম ছিল ইসলাম। সেই ধর্মের অনুসারী মুসলিম জাতির বিশ্বসভ্যতায় তাদের অবদান সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পাশ্চাত্যের প্রখ্যাত ঐতিহাসেক ইৎরভধঁষঃ বলেন :


“প্রাচীনকালে মিসর, চীন বা ভারতে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ার কোনো নিদর্শন আমরা খুঁজে পাই না। প্রাচীন গ্রিসে এর ছিটেফোঁটা দেখতে পাওয়া যায়। রোমেও এর উপস্থিতি ছিল না। কিন্তু আরবদের মাঝে এই বিজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ছিল। সুতরাং তাদেরকেই আধুনিক বিজ্ঞানের জনকরূপে চিহ্নিত করা যায়।

মধ্যযুগের ইসলামি সভ্যতার মূল্যায়ন করতে গিয়ে কেনেথ এইচ, ক্রান্ডাল আরো বলেন : “সকলেই জানেন খৃস্টান তথা পাশ্চাত্য জগত যখন অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত ছিল, তখন চীনের সীমানা থেকে শুরু করে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় বিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী ছিলেন মুসলমানগণ ----- বিভিন্ন কৃষ্টির সমবায়ে নতুন যে ইসলামী সভ্যতার সূত্রপাত হয় তা নবম, দশম ও একাদশ শতকে পরিপূর্ণরূপে বিকাশ লাভ করে। মধ্যযুগে ইসলামের এই সমৃদ্ধ ভাণ্ডার থেকে পাশ্চাত্যজগত বহু কিছু গ্রহণ করেছে এবং এভাবেই পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ শতকে ইউরোপীয় রেনেসাঁর সূত্রপাত ঘটেছে।”

রবার্ট ব্রিফল্ট তাঁর ঞযব গধশরহম ড়ভ ঐঁসধহরঃু গ্রন্থে বলেন : “সম্ভবত আরববাসীদের দ্বারা প্রভাবিত না হলে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার ক্রমবিকাশের পূর্ববর্তী পর্যায়গুলি অতিক্রম করে বর্তমান রূপ লাভ করতে সক্ষম হত না। ---- ইউরোপের বিজ্ঞানে চরম উন্নতি বলতে আমরা যা বুঝি তা প্রাচীন গ্রীকদের অক্লান্ত অনুসন্ধান ও উৎসাহ, নতুন শিক্ষা পদ্ধতির আবিস্কার - - - - এই উৎসাহ ও পদ্ধতিসমূহ ইউরোপীয় ভূখন্ডে আরববাসীদের দ্বারা প্রচলিত হয়েছিল।”
মধ্যযুগের ইসলামি সভ্যতা অতি আলোকিত ও বিকশিত হয়েছে ঐতিহাসিক হিট্টির বক্তব্য থেকে। তিনি বলেন : “অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত আরবী ভাষাভাষি লোকেরা সমগ্র বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান আলোর দিশারী ছিলেন। তাদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান ও দর্শন এমনভাবে পুনর্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত হয় যে, এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ সম্ভবপর হয়েছে।

উপরিউক্ত প্রথিতযশা খ্যাতিমান ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদদের বক্তব্যগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মধ্যযুগের বর্বরতার সাথে ইসলামি সভ্যতার সম্পৃক্ততার লেশমাত্রটুকুও ছিল না। বরং মধ্যযুগটা ছিল ইসলামি সভ্যতার (মড়ষফবহ ধমব) সোনালী যুগ। ওই যুগে ইসলামি সভ্যতা তার জ্ঞানের আলোকবর্তিকা থেকে নিঃসৃত আলোকরশ্মিগুলো দ্বারা বিকিরণ দিয়ে যাচ্ছিল বিশ্বের তাবৎ দিকে। যেসময়টাতে ইউরোপ আফ্রিকা ও দূরপ্রাচ্যের অঞ্চলগুলো জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষাদীক্ষায় ছিল দূর থেকে বহু দূরে। অজ্ঞতা আর বর্বরতার আধারে নিমজ্জিত ছিল সর্বত্রই। ওই সময়টাতে আরব উপদ্বীপ থেকে জ্ঞানের বিকীরণগুলো আলোকিত ও উদ্ভাসিত হয়ে প্রতিভাত করে যাচ্ছিল আধারে থাকা জনপদগুলোকে। এক সময়ের যাযাবর বেদুইন আরবরা মধ্যযুগে ঐশী জ্ঞানের পরশ পেয়ে তারা সাঁতার কাটতে আরম্ভ করলেন জ্ঞানের অথৈ সাগরে। বিচরণ করতে আরম্ভ করলেন জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা ও পল্লবিতে। মন্থর করে দিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কন্টকাকীর্ণ পথকে।

তারা জন্ম দিলেন এমন কতিপয় জগৎদিখ্যাত মহান মনীষীদের যারা জ্ঞানের অমীয় সুধা পানে আপন অস্তিত্বকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন জ্ঞানসত্ত্বার মাঝে। যারা জ্ঞান আহরণ করেছেন আকাশের দিকপাল পেরিয়ে দূর সীমানার গ্রহ থেকেও। যারা নতুন এক আমেজ, সতেজ ও অনুভূতি সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর মাঝে। যারা পুনরুজ্জীবিত করেছেন মৃতপ্রায় পৃথিবীকে।

যাদের জ্ঞানের ডানায় ভর দিয়েই আজ বিশ্বসভ্যতা পৌঁছেছে এক গগণসুউচ্চ মিনারায়। যাদের লব্ধজ্ঞান দ্বারাই আজ আলোকিত ও উদ্ভাসিত এই নয়নাভিরাম অনিন্দ্য সুন্দর পৃথিবী। আর ওই মনীষীদের প্রত্যেকেই ছিলেন জ্ঞানের একেকটি সুউচ্চ মিনার। বিজ্ঞান উৎকর্ষের মহাসাগর। আর পর্বতসম জ্ঞানের অধিকারী এই মুসলিম মনীষীগণ প্রত্যেকেই এই ধরাপৃষ্ঠে আবির্ভূত হয়েছিলেন ঠিক মধ্যযুগের মধ্যেই।
যেসমস্ত মুসলিম মনীষীগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্যে তারা ঘটিয়েছেন অভূতপূর্ব মহাবিপ্লব, মানব জীবনে সৃষ্টি করেছেন মহাজাগরণ; তাদের মধ্যহতে অন্যতম হলেন, ইমাম আবু হানিফা, ইমাম বুখারী, জাবের ইবনে হাইয়্যান, ইমাম গাজ্জালী, আল ফারাবী, আল বাত্তানী, আলবেরুনী, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে নাফিস, রুমী, ইবনে রুশদ, মহাকবি ফেরদৌসী, ইবনে খালদুন যিনি হলেন আধুনিক সমাজ বিজ্ঞান ও রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জনক। প্রভূত মনীষীদের জন্ম ও মৃত্যুই হলো মধ্যযুগেই। অর্থাৎ ৮ম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগের মধ্যেই। আর ওই মনীষীদের বাদে এরকম আরোও হাজারো মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিক রয়েছেন যাদের থেকে প্রবাহিত হয়েছে জ্ঞানের ফল্গুধারা। এরা সবাই আবির্ভূত হয়েছেন ওই মধ্যযুগেই। ইতিহাস অনুসন্ধান করলে দেখা যায় ওই সময়টাতে পাশ্চাত্যে এরকম সুউচ্চ জ্ঞানের অধিকারী মনীষীদের ছিটেফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

তাছাড়া মধ্যযুগের ওই সময়টাতে ইসলামি বিশ্বে এমন কতিপয় বিখ্যাত মহা বিদ্যাপিঠ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল যে সময়টাতে প্রতীচ্য কিংবা দূরপ্রাচ্যের কোথাও তার ন্যূনতম অস্তিত্বও ছিল না। ওই বিদ্যাপিঠসমূহ থেকে প্রতিটিই পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় সমুজ্জ্বল হয়ে কিরণ ছড়িয়ে যাচ্ছিল পৃথিবীর তাবৎ আনাচে কানাচে। আর জন্ম দিয়েছে সহস্র সহস্র জ্ঞানের সুউচ্চ মিনার মুসলিম পন্ডিতদের। যার ফলশ্রুতিতে আদৌ পর্যন্ত ওই প্রতিষ্ঠানগুলো চির অম্লান ও চিরভাস্কর হয়ে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে ইতিহাসের সোনালী অধ্যায়ে। ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম হলো ৬২২ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত মসজিদে নববী। যেখানে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন আসহাবে সুফফাগণ। তার পরে ৮৩০ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত হয় বাইতুল হিকমাহ নামক বিশ্ববিদ্যালয়। মরক্কোর ফাস নগরীতে ৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় কারাভীন বিশ্ববিদ্যালয়। মিসরে ৯৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় বিশ্বখ্যাত আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়। আর ১০৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় আরেক বিশ্বখ্যাত বিদ্যাপিঠ নিজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৮ম শতাব্দীতে স্পেনের কর্ডোবায় প্রতিষ্ঠিত হয় কর্ডোবা বিশ্ববিদ্যালয়। যা আলোকিত করেছিল সমগ্র ইউরোপকে।

আর এই সময়টাতে ইউরোপের কোথাও কোনো বিদ্যাপিঠ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বর্তমান ইউরোপে যেসমস্ত নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞানের পুষ্প কলি থেকে সৌরভ ছড়িয়ে যাচ্ছে এর সবগুলোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওগুলোর অনেক পরে। তাছাড়া যেসব ইউরোপীয় মনীষীগণ আধুনিক বিশ্বসভ্যতার রূপকার, যারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতিটি শাখায় বিচরণ করে পাশ্চাত্যকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায় তাদের সবাই পৃথিবীতে জন্মেছেন মধ্যযুগের পরেই। অর্থাৎ পঞ্চদশ শতাব্দীর পর থেকেই। তাদের এমন একজন খুঁজে পাওয়া যায় না যারা পঞ্চদশ শতাব্দীর আগে আবির্ভূত হয়েছেন। তাদের মধ্য হতে অন্যতম হলেন, গ্যালিলিও গ্যালিলাই, নিকোলাস কোপানির্কাস, টমাস আলভা এডিসন, জর্জ বার্ণাডশ, আইজাক নিউটন, আলবার্ট আইনস্টাইন, উইলয়াম শেক্সপীয়র, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, লুই পাস্তুর, আব্রাহাম লিংকন, জন কিটস, চালর্স ডারউইন, কালমার্কস, অলভিল রাইট, উইলবার রাইট, বারট্রান্ড রাসেল ও ফ্রান্সিস বেকনসহ আরোও অনেক মনীষী। তাদের সবার আবির্ভাবই হলো পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে উনবিংশ শতাব্দীর মাঝে। যারাই আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার ভিত রচনা করে দিয়েছেন।

সুতরাং উপরিউক্ত তুলনামূলক বিশ্লেষণ দ্বারা এটাই প্রতীয়মান হয় যে, মধ্যযুগে ইসলামি বিশ্বের গগণজুড়ে যখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমুজ্জ্বল নক্ষত্রগুলো ঝলমল করে আলোকিত ও উদ্ভাসিত করে রেখেছিল বিশ্বকে ঠিক ওই সময়টাতে ইউরোপের আকাশ ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সমাজ ছিল আধারে নিমজ্জিত। যে সময়টাতে ইসলামি বিশ্বে প্রবাহিত হচ্ছিল শান্তি-শৃঙ্খলার স্নিগ্ধ কোমল বায়ু ঠিক ওই সময়টাতে ইউরোপ জুড়ে বিরাজমান ছিল অজ্ঞতা আর বর্বরতা। সুতরাং মধ্যযুগের বর্বরতার সাথে ইসলামি সভ্যতার মোটেও কোনো সম্পৃক্ততা নেই। বরং মধ্যযুগটা ছিল ইসলামি সভ্যতার (মড়ষফবহ ধমব) সোনালী যুগ। যা ইউরোপসহ তাবৎ বিশ্বের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছিল।

মধ্যযুগে ইউরোপ বর্বরতার কোন শীর্ষে এবং দৈন্যদশার কোন পর্যায়ে উপনীত ছিল তার সুস্পস্ট প্রমাণ পাওয়া যায় রবার্ট ব্রিফল্ট এর ভাষায়। তিনি তাঁর ঞযব গধশরহম ড়ভ ঐঁসধহরঃু গ্রন্থের ১৬৪ নং পৃষ্ঠায় বলেন:
খ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দী থেকে ১০ম শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপ গভীর আধারে নিমজ্জিত ছিল এবং তা ক্রমান্বয়ে আরো প্রকট ও ভয়াবহতার দিকেই ধাবিত হচ্ছিল। তখনকার ভয়-ভীতি ও বর্বরতা ছিল প্রাচীন কালের ভয়-ভীতি ও বর্বরতার চেয়েও বহুগুণ বেশি। কারণ তার উদাহরণ ছিল এক বিরাট সভ্যতার লাশের, যে লাশে পচন ধরে তা গলে গিয়েছিল। সেই সভ্যতার চিহ্নাদি লোপ পাচ্ছিল এবং তার উপর ধ্বংসের মোহর অঙ্কন ছিল। সে সমস্ত দেশ যেখানে ওই সভ্যতা ও সংস্কৃতি চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল যেমন ইটালি, ফ্রান্স, সেখানে ধ্বংসের তান্ডব, অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলারই রাজত্ব বিরাজমান ছিল।

মধ্যযুগে ইসলামি সভ্যতা ও ইউরোপ কোনো পর্যায়ে ছিল তা- আরো প্রতিভাত হয় মহাত্মা গান্ধীর উক্তি থেকে। তিনি বলেন, “প্রতীচ্য যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত, প্রাচ্যের আকাশে তখন উদিত হলো এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং অর্ধ পৃথিবীকে তা দিল আলো ও স্বস্থি। ইসলাম মিথ্যা ধর্ম নয় শ্রদ্ধার সাথে হিন্দুরা তা অধ্যয়ন করুক, তা হলে আমার মতই তারা একে ভালোবাসবে।

লেখকের সভ্যতার দ্বন্দ্ব ও আগামী দিনের পৃথিবীতে ইসলাম গ্রন্থ থেকে


আরো সংবাদ



premium cement