২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

৮ বছর ধরে শেকলে বাঁধা করসিনার জীবন!

শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে দুই সন্তানের জননী করসিনা আক্তারকে - সংগৃহীত

পঞ্চগড়ে স্বামীর নির্যাতনের কারণে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়া এক নারীকে আট বছর ধরে লোহার শেকলে বেঁধে রাখা হয়েছে। দুই সন্তানের জননী করসিনা আক্তার নামের এই নারী সদর উপজেলার সাতমেড়া ইউনিয়নের হড়েয়াপাড়া গ্রামের কলিমউদ্দিনের মেয়ে। স্বামীর নির্যাতনের কারণেই ওই নারী মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে।

জানা যায়, করসিনার স্বামী ৬ বছর আগে তাকে তালাক দেয়। তার দুই সন্তান তার স্বামীর বাড়িতেই থাকে। বর্তমানে সে বাবার বাড়িতে শেকল পড়া অবস্থায় জীবন পার করছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, করসিনার বাম পায়ে লোহার শেকল পড়িয়ে ঘরের খুঁটিতে তালা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। এর আগে ডান পায়ে শেকল ছিল। সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হলে বাম পায়ে শেকল দেওয়া হয়। এভাবে পা বদলিয়ে দিনের পর দিন আটকিয়ে রাখা হয় তাকে। স্বাভাবিকভাবে কেউ করসিনাকে দেখলে সুস্থই মনে করবেন। কথা বলতে চাইলে গুছিয়ে কথাও বলেন। বাবা মাসহ নিজের এবং ছেলে মেয়েদের নামও লেখতে পারেন সুন্দর করে। তবে অজ্ঞাত কারণে মাঝে মধ্যেই মারমুখী হয়ে উঠেন তিনি। সুযোগ পেলেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে দূরে কোথাও চলে যান। কখনো কখনো রেগে গিয়ে সামনে কাউকে পেলেই মারপিট করেন।

করসিনার পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে সুস্থ ও মেধাবী ছিলেন করসিনা। দশম শ্রেণিতে লেখাপড়া করার সময় তেঁতুলিয়া উপজেলার মানিকডোবা গ্রামের নাজিম উদ্দিনের ছেলে আবুল হোসেনের সঙ্গে তাকে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের পর শুরুতে কোন সমস্যা ছিল না। এর মধ্যে একটি ছেলে সন্তান জন্ম দেন করসিনা। এরপর শুরু হয় তাও উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নির্যাতনের মধ্যেই এক যুগের বেশি সময় সংসার করেন তিনি। পরে একটি মেয়ে সন্তানের জন্ম দেন সে।

দ্বিতীয় সন্তানের মা হওয়ার পর থেকে সামান্য রাগারাগি হলে স্বামীর নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যেতো। এক সময় তাকে পাগল আখ্যা দিয়ে পায়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখেন স্বামী আবুল হোসেন। সংসার জীবনের শেষের দুই বছর তাকে নির্যাতনের পাশাপাশি কখনো বেঁধে রাখেন, কখনো ঘরে আটকিয়ে রাখতেন তার স্বামী, জানান তারা।

এরপর ছেলে-মেয়েদের নিজের কাছে রেখে করসিনাকে তার বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেন স্বামী আবুল হোসেন। এর কিছুদিন পর আবুল হোসেন তাকে তালাক দেন ও তালাকের দুই মাসের মধ্যে আবারও সে বিয়ে করে সংসার করতে থাকেন।

বর্তমানে বড় ছেলে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে এবং মেয়ে আশামনির বয়স সাত বছর।

তালাকপ্রাপ্তির পর করসিনার মানসিক সমস্যা আরও বেড়ে যায়। তিনি বাবার বাড়িতে থাকতে চান না। স্বামীর বাড়ি যেতে চান। ছেলে মেয়েদের দেখতে যেতে চান। ভালো কোন খাবার দিলে ছেলে মেয়েদের জন্য তুলে রাখেন। কখনো কখনো অসংলগ্ন আচরণ করেন। এরই মধ্যে একাধিকবার বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। দিনমজুর বাবা মেয়ের চিকিসার জন্য অনেক চেষ্টা করেছেন। তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালেও চিকিৎসার জন্য দুই মাস রাখা হয়। তবে আর্থিক অনটনে পরিপূর্ণ চিকিৎসা হয়নি তার। বাধ্য হয়ে আট বছর ধরে তার পায়ে শেকল দিয়ে বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়েছে।

স্থানীয় প্রতিবেশি নুরুজ্জামান জানান, স্বামীর অবহেলা ও সন্তানদের ভালবাসা না পেয়ে করসিনার অসুস্থতা দিন দিন বাড়ছে। উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি পারিবারিক সহানুভূতি পেলে সে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। তার চিকিৎসার জন্য সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা প্রয়োজন।

করসিনার মা আলিমা বেগম জানান, শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা ছাড়া কোন উপায় নেই। নিজের মেয়েকে এভাবে রাখতে খুব খারাপ লাগে। কিন্তু কি আর করার আছে। সুযোগ পেলেই সে পালিয়ে যায়। কোথায় চলে যায় কোন ঠিক নেই। তখন যদি তার অন্য কিছু একটা হয়ে যায়। সেই ভয়ে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে।

করসিনার বাবা কলিম উদ্দিন জানান, বিয়ের আগে মেয়েটি আমার ভালোই ছিল। বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই তার ওপর নানা রকম নির্যাতন শুরু হয়। স্বামীর নির্যাতনের কারণে মেয়ে মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। আমরা তার স্বামীকে মেয়ের চিকিৎসার জন্য খরচও দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সে কোন কথা শোনেনি। পাগল বলে আমার মেয়েকে সে তালাক দিয়ে দেয়। এখন টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করাতে পারছি না।

এ ব্যাপারে সাতমেরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান জানান, তার চিকিৎসার জন্য ভিজিডি কার্ড দেয়া হয়। বিষয়টি জেলা প্রশাসককেও জানানো হয়েছে। জেলা প্রশাসক চিকিৎসা সহায়তার জন্য একটা ব্যবস্থা নিবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন।

জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমীন বলেন, ‘বিষয়টা আমরা জানতাম। ইতিপূর্বে পুলিশ নিয়ে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। পরিবারের সদস্যরা চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চাইলে আমরা করবো।’ সূত্র : ইউএনবি।


আরো সংবাদ



premium cement