২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিকলমুক্ত হলো রাণীনগরের সাদেকুল

বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়েছেন সাদিকুল - ছবি : নয়া দিগন্ত

বাড়ির বাইরে, উঠানের একপাশে গরু রাখার দুটি কক্ষের একটিতে রাখা হতো সাদেকুলকে। গ্রীলের দরজায় তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা থাকতো। রাত-দিন সবসময় ওই ঘরের মধ্যে সাদেকুলের জীবন যাপন। খাবার দেয়া হতো গ্রীলের ফাঁক দিয়ে। মাঝেমধ্যে তার বড় ভাই বের করতেন গোসলের জন্য।

ছাট্ট ঘরের মধ্যে বসে সাদেকুল নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতো বাইরের দিকে। গ্রামের সবাইকেই চিনতে পারতো তাই সামনের রাস্তা দিয়ে কেউ গেলেই কথা বলতো। বাইরে যাওয়ার জন্য তালা খুলে দেয়ার অনুরোধ করতো। এই অবস্থায় ধীরে ধীরে সাদেকুলের মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যেতে বসেছে। স্মৃতি শক্তিও।

অমানবিক এই দৃশ্য গ্রামবাসী দেখে আসছে প্রায় তিন বছর ধরে। কষ্ট পেয়েছেন; অনেকের মধ্যে ক্ষোভ জন্মেছে। এই অবস্থার অবসান ঘটলো গত বুধবার। দুপুরে রাণীনগর থানার ওসি মো: জহুরুল ইসলাম ও সমাজসেবা কর্মকর্তা রেজোয়ানুল হক সাদেকুলকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। এর আগে যুবক সাদেকুলের বন্দিদশা নিয়ে বুধবার ছবিসহ প্রতিবেদন দৈনিক নয়া দিগন্তের অনলাইন ভার্সনে প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনটি প্রশাসনের কর্মকর্তাদের দৃষ্টিগোচর হওয়ায় সাদেকুলকে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হয়।

সাদেকুলের মুক্তির পর গ্রামবাসী ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তা, মানবাধিকার কর্মীরা নয়া দিগন্তের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।

উদ্ধারের সময় সমাজসেবা কর্মকর্তা রেজোয়ানুল হক বলেন, পাগল বা মানসিক ভারসাম্যহীন হলেও কোনো মানুষকে এভাবে বন্দি করে রাখা অনুচিৎ। আইনত অপরাধ। সাদেকুলকে একটি ঘরের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বন্দি রাখায় ধীরে ধীরে সে আরো বেশি মানসিক ক্ষতির মুখে পড়েছে। তার পরিবারের লোকজন কাজটি ঠিক করেনি। রাণীনগর থানার অফিসার ইনচার্জের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পারি। এরপর বুধবার সকালে অফিসার ইনচার্জ জহুরুল হকের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ঘটনাস্থল থেকে সাদেকুলকে উদ্ধার করে নওগাঁ মেডিকেল কলেজে নিলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক বলেন, সাদেকুল দীর্ঘদিন যাবৎ ফিজোফ্রেনিয়া রোগে ভোগছেন। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। আমরা আপাতত তাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছি। কাল-পরশু তাকে রাজশাহী মেডিকেলের মানসিক বিভাগে ভর্তি করাবো। তার সকল চিকিৎসা ব্যয় আমার দফতর থেকে বহন করা হবে।

রাণীনগর থানার অফিসার ইনচার্জ মো: জহুরুল হক বলেন, বিশ্বস্ত খবরে জানতে পারি ভবানীপুর গ্রামের সাদেকুলকে তথাকথিত পাগল বানিয়ে তার স্বজনরা প্রায় তিন বছর ধরে একটি ঘরে আটক রেখেছে। এমন বিষয় শুনে সমাজসেবা অফিসারকে সাথে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে সাদেকুল ইসলামকে উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের পর সাদেকুলকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য নওগাঁ সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে ফিজোফ্রেনিয়া রোগে ভোগছেন, নওগাঁ মেডিকেল কলেজের চিকিৎসকরা তাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের মানসিক বিভাগে ভর্তির পরামর্শ দিয়েছেন। সাদেকুলের চিকিৎসা ব্যয়ের দ্বায়িত্ব উপজেলা সমাজসেবা অফিস নিয়েছেন।

স্থানীয়রা জানান, নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার ভবানীপুর মোবারক পাড়া গ্রামে সাদেকুল ইসলামকে তিন বছর ধরে কখনো শিকল বন্দি আবার কখনো গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। পাগলামি করে মানুষের ক্ষতি করছে এমন অজুহাতে তাকে গৃহবন্দি করে রাখার অভিযোগ ভাই শেরেকুল ইসলামের বিরুদ্ধে।

পাশের ঘোষগ্রাম কফিলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন সাদেকুল। সেই সময় মানসিক রোগে আক্রান্ত হলে বিভিন্ন স্থানে তার চিকিৎসায় ছুটেছে পরিবার। পরবর্তীতে বাড়িতেই বন্দি রাখা হয়। সবশেষ বছর তিনেক আগে বাড়ির বাইরে গোয়াল ঘরের একটি কক্ষে ঠাঁই মিলে সাদেকুলের।

সাদেকুলের বড় ভাই শেরেকুল ইসলাম জানান, অনেক টাকা খরচ করে চিকিৎসা কানোর পরও সাদেকুলের রোগ নিরাময় করা যায়নি। অভাবের সংসারে আর কোনো খরচ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement