২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হাইব্রিড শাসন ও নির্বাচনের মর্যাদা

-

দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ধ্বংসের অভিযোগ অতীতে বিরোধী দলের মুখেই বেশি বেশি শোনা যেত। কিন্তু এর পরিসর আগের তুলনায় বেড়েছে। অভিযোগটা এখন দেশীয় গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক মহল পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। সাম্প্রতিক সময়ে সে অবস্থার আরো অবনতি ঘটেছে বলেই মনে হচ্ছে। এখন সরকারসংশ্লিষ্টদের মুখেও দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এমনকি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশন এবং কমিশনের শীর্ষ কর্তাদের মুখেও সে কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। যা আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনব্যবস্থার মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করেছে বলেই মনে করা হচ্ছে। এমনকি তা সরকারসহ পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থার ক্রিয়াশীলতা ও কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দিয়েছে।
গত এক দশকে আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও নির্বাচনের মান একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। নিকট অতীতে ক্ষমতাসীনেরা এসব অভিযোগ পাত্তা না দিলেও গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের নির্বাচনব্যবস্থার যে মর্যাদাহানি ঘটেছে, সে ঢাকঢোল আর বিরোধী দলকে পেটাতে হচ্ছে না; বরং এ ক্ষেত্রে এখন যন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন সরকারসংশ্লিষ্টরাই। আর তার সাথে যুক্ত হয়েছেন খোদ নির্বাচন কমিশনের শীর্ষ কর্তারাও।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, বুদ্ধিজীবী মহল, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ সর্বমহলে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি সম্প্রতি নির্বাচনের মর্যাদা ফিরিয়ে আনার ওপর জোর দিয়ে সে কথারই প্রতিধ্বনি করেছেন খোদ ১৪ দলের সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন। তার কথায় স্পষ্ট হয়, আমাদের দেশে নির্বাচনের মর্যাদাহানি হয়েছে। তিনি জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তৃতায় বলেছেন, ‘নির্বাচন নিয়ে জনগণ আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। মসজিদে মাইকে ঘোষণা দিয়েও ভোটারদের আনা যায় না। উপজেলা নির্বাচনেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। এটা কেবল নির্বাচনের জন্য নয়, গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।’ এর আগেও তিনি বলেছিলেন, ‘উপজেলা নির্বাচনে এবার রাতের বেলা ভোট হবে না। এখন দিনের বেলাতেই হবে ভোট ডাকাতি।’ (বাংলা ট্রিবিউন, ৬ মার্চ ২০১৯)।
এ বিষয়ে সরকারের আরেক শরিক জাসদ নেতা শরীফ নূরুল আম্বিয়ার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন নিয়ে বলেছেন, ‘ভোটের আগের রাতেই ভুয়া ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করে রাখাসহ নানা অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে।’ (দ্য ডেইলি স্টার, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯)। সরকারের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির এমপি ও সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের আত্মস্বীকৃতিতেই আমাদের দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন, নির্বাচনী ব্যবস্থার গ্রহণযোগ্যতা ও নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতার বাস্তব চিত্রটি ফুটে উঠেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাশেদ খান মেননের সংসদ সদস্য হওয়া নিয়েও জনমনে হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে।
ইদানীং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অপর নির্বাচন কমিশনারের কথাবার্তায়ও নির্বাচনে গুরুতর অনিয়মের কথা ফুটে উঠেছে, যা হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয়ার সাথে তুলনা করছেন অনেকেই। এ বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, ‘... যদি ইভিএমে ভোটের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আর আগের রাতে ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভর্তি করার সুযোগ থাকবে না।’ (প্রথম আলো, ৮ মার্চ ২০১৯)। তিনি আরো বলেছেন, ‘কারা সেজন্য দায়ী, তাদের কী করা যাবে সেই দীক্ষা শিক্ষা দেয়ার ক্ষমতা-যোগ্যতা আমাদের কমিশনের নেই এবং সেভাবে বলারও সুযোগ নেই যে, কী কারণে হচ্ছে, কাদের কারণে হচ্ছে, কারা দায়ী।’ (বিডিনিউজ২৪.কম, ৮ মার্চ ২০১৯)।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুতর অনিয়ম ও ইসির অসহায়ত্বই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু তিনি যে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ইভিএমের কথা বলেছেন, তা মোটেই বাস্তবসস্মত নয়। কারণ, রাতে ব্যালটবাক্স ভর্তিকারীদের নির্বাচন কমিশন যদি কিছু বলতে না পারে, তাহলে ইভিএম মেশিনগুলো তারা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে, তা মোটেই বোধগম্য নয়। যারা রাতে বাক্স ভরেছেন, তারা ইভিএম মেশিনেও রাতে ভোট দিলে তা ঠেকানোও মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এ বক্তব্য ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র চেষ্টা বলেই মনে করা হচ্ছে।
রাতে ব্যালটবাক্স ভরা বিষয়ে সিইসি এখন যা বলছেন, নির্বাচনের পর একই কথা বলেছিল টিআইবি। ৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে তারা ৪৭টি কেন্দ্রে অনিয়ম পেয়েছিল। টিআইবির প্রতিবেদন অনুযায়ী, শতকরা ৬৬ ভাগ কেন্দ্রে রাতে ভোট দেয়ার ঘটনা ঘটেছিল। সেই সময় টিআইবির গবেষণা সম্পর্কে ইসির বক্তব্য ছিল, ‘এটা কোনো গবেষণাই নয়। পূর্বনির্ধারিত মনগড়া তথ্য দেয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।’ কিন্তু সিইসির এখনকার বক্তব্য আর টিআইবির প্রতিবেদনের মূল বক্তব্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না নির্বাচন কমিশনের কাছে তার সদুত্তরও।
গত ৩০ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অনেক অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন কমিশন কোনো ক্ষেত্রেই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। খুলনার একটি আসনে মোট ভোটারের চেয়ে প্রার্থীদের প্রাপ্ত মোট ভোট বেশি হওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। এই রিপোর্ট প্রকাশ করায় কথিত ‘অসত্য সংবাদ’ প্রকাশের দায়ে সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমকর্মীকে গ্রেফতারও করা হয়েছিল। কিন্তু সংবাদটি যে অসত্য ছিল না, ডয়চে ভেলেসহ অন্যান্য গণমাধ্যম তথ্য ও ভিডিও চিত্রের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে। বগুড়ার কয়েকটি কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়ার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। এসব ঘটনার কোনো তদন্ত নির্বাচন কমিশন করেছেÑ এমন তথ্য জানা যায়নি, বরং এমন মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের পক্ষে নির্বাচন কমিশন সর্বকালের সবচেয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুর তুলেছিল।
মূলত আমাদের দেশে গোলকধাঁধার গণতন্ত্র ও নির্বাচনী সংস্কৃতি প্রচলিত আছে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞার সাথেই আমাদের দেশের গণতন্ত্রের সাদৃশ্য পাওয়া যায় না। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক হেরোডোটাস গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়ে বলেছেন, গণতন্ত্র এমন এক ধরনের শাসনব্যবস্থা, যেখানে শাসনক্ষমতা কোনো শ্রেণী বা শ্রেণী সমষ্টির ওপর ন্যস্ত থাকে না, বরং তা সমাজের সদস্যদের ওপর ন্যস্ত থাকে। হিনস হাও-এর মতে, রাজনৈতিক দৃষ্টিতে গণতন্ত্র বলতে এমন এক মতবাদকে বোঝায়, যেখানে জনগণ রাষ্ট্রকে তার ইচ্ছামতো এমন এক জবরদস্তি শক্তি প্রদান করে, যার আনুগত্য করতে ভূখণ্ডের সব মানুষ বাধ্য হয়। অ্যারিস্টটলের মতে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ধনী মানুষের চেয়ে গরিব মানুষের ক্ষমতা বেশি হবে। কেননা তারা সংখ্যায় অধিক। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটবে।
গণতন্ত্রের সর্বজনীন কোনো সংজ্ঞা এখনো আবিষ্কার হয়নি। প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ, ওয়েস্টমিনস্টার, জ্যাকসনিয়ান, উদারনৈতিক, ধর্মীয়, তৃণমূল, অংশীদারি, সামাজিক, ডেমার্কি বা লট্টোক্রেসি বা লটারিভিত্তিক গণতন্ত্রসহ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রায়োগিক দিক থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের ৩২টিরও বেশি প্রকারভেদ দেখা যায়। পরিস্থিতির প্রয়োজনেই এসব প্রকারভেদের জন্মলাভ ও বিকাশ ঘটেছে। কিন্তু আমাদের দেশে যে ধরনের গণতন্ত্র চালু আছে তা কোনো সূত্রের মধ্যে ফেলানোর সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। আমাদের প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক শাসন তো দূরের কথা, সরকার পরিচালনায় সাধারণ মানুষের ন্যূনতম অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
আমাদের দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিম্নমুখী বললে অত্যুক্তি হওয়ার কথা নয়। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০০৬ সাল থেকে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোকে চারটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে গণতন্ত্রের র্যাংকিং প্রকাশ করে আসছে। ক্যাটাগরি চারটি হলোÑ পূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ত্রুটিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, হাইব্রিড শাসন ও কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন। ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনেও গণতন্ত্রের গোলকধাঁধার নানা চমকপ্রদ তথ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। ১৬৭টি দেশ নিয়ে প্রকাশিত সর্বশেষ র্যাংকিংয়ে ২০১৬ সালে বিশ্বের মাত্র ১৯টি দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র চালু ছিল। ৫৭টি দেশে গণতন্ত্রের অবনমন ঘটেছে।
এবার ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের সূচকে চার ধাপ এগোলেও বাংলাদেশকে আগেরবারের মতো ‘হাইব্রিড শাসনব্যবস্থার’ বিভাগে রাখা হয়েছে। ‘হাইব্রিড’ বলতে এমন ব্যবস্থাকে বোঝানো হয়, যেখানে প্রায়ই অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। বিরোধী দল এবং বিরোধী প্রার্থীদের ওপর সরকারের চাপ নৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার এবং দুর্বল আইনের শাসন। নাগরিক সমাজ দুর্বল। বিচারব্যবস্থা স্বাধীন নয় এবং সাংবাদিকদের হয়রানি এবং চাপ দেয়া হয়। মূল্যায়নের ১০ পয়েন্টের মধ্যে এবার বাংলাদেশের স্কোর ৫ দশমিক ৫৭। আগের বছর ছিল ৫ দশমিক ৪৩।
বিশ্বের অনেক দেশে রাজনৈতিক-শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুক, বংশপরম্পরায় পরিবারের সদস্যরা শাসনক্ষমতার কেন্দ্র্রবিন্দুতে থাকছেন। নানা কারণে সম্মোহিত মানুষদের ভোটে উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে। রাজতন্ত্রের আধুনিক সংস্করণ বলে মহলবিশেষে অভিযোগ করা হলেও গণতন্ত্র নামেই অভিহিত করা হচ্ছে। অন্য দিকে, গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলন ও ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য গণমানুষের ভোটাধিকার হরণও আমাদের দেশের গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। আর এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসা মোটেই সহজসাধ্য নয়, যদি রাজনৈতিক অঙ্গীকার না থাকে। হ
ংসসলড়ু@মসধরষ.পড়স


আরো সংবাদ



premium cement