২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

সুশাসন চাই সর্বক্ষেত্রে

-

আফ্রিকার সবচেয়ে সুপরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম ইউনিভার্সিটি অব সাউথ আফ্রিকা। এর প্রধান ফটকে লেখা রয়েছে, যা বাংলায় অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়ায়- কোনো জাতিকে ধ্বংস করার জন্য পারমাণবিক হামলা কিংবা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দরকার নেই; বরং সেই জাতির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় প্রতারণার সুযোগ দিলেই হবে। কারণ, এভাবে পাস করা ডাক্তারদের হাতে রোগীর মৃত্যু হবে। ইঞ্জিনিয়ারদের তৈরি দালানকোঠা, ইমারত ধ্বংস হবে। অর্থনীতিবিদদের দিয়ে পরিচালিত পাবলিক ও দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়া হবে। এ ছাড়া বিচারকদের হাতে বিচারব্যবস্থার কবর রচনা হবে। সুতরাং শিক্ষা ভেঙে পড়ার অর্থ হলো একটি জাতির অবলুপ্তি। বিগত ৪৮ বছর একটি সুস্থ ধারার শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এ দেশের শাসক সম্প্রদায়। এ কারণে উন্নয়ন প্রকল্পের সর্বস্থানে দুর্নীতি নামক ভয়ঙ্কর রোগ জন্ম নিয়েছে। প্রতিদিনের খবর দেখলে এর সত্যতা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রকল্প বাজেটের অর্ধেক টাকা যায় নিজেদের পকেটে। বাকি অর্ধেক টাকা ব্যয় হয়। সে কারণে কাজটি উন্নতমানের হয় না।

সম্প্রতি একটি পত্রিকার হেডলাইন ছিল এ রকম- কোচিং বাণিজ্যের চেয়েও ভয়াবহ হলো ডাক্তারদের ল্যাবরেটরি টেস্টের কমিশন বাণিজ্য। রোগী গেলেই একগাদা টেস্টের ঝামেলায় পড়তে হয়। ড্রাইভারদের লাইসেন্সের মতো যদি ডাক্তারদের লাইসেন্স চেক করা হতো তবে অসংখ্য ভুয়া ডাক্তারের তালিকা বের হয়ে আসত। কিছু ডাক্তার আছেন তারা কোনোভাবেই ঢাকা থেকে যেতে চান না। কারণ, এখানে আয়রোজগার জেলা শহর থেকে বেশি। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ভারত, থাইল্যান্ড বা সিঙ্গাপুর যায় সঠিক চিকিৎসা নিতে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। গুণী মানুষের কথা- তুমি যদি যুদ্ধ ছাড়াই কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তাহলে সেই জাতির যুবকদের মাঝে অশ্লীলতা ও নগ্নতা ছড়িয়ে দাও। আজ আমরা সেটারই শিকার। মানুষ কোনটা মন্দ এবং কোনটা ভালো তা জানে। কিন্তু চুপ থাকে- কারণ বোবার শত্রু নেই। বাংলাদেশের সার্বিক অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, সত্য কথা বললেই যেকোনো সময় তার ওপর বিপদ হানা দিতে পারে। কিন্তু আল্লাহ বলেছেন- ‘সত্য কথা বলতে গিয়ে যদি আপন মানুষ পর হয়ে যায়, তবুও তুমি সত্য কথা বলো। কারণ কারো কাছে পর হলেও আল্লাহর কাছে তুমি হবে প্রিয়।’ বিশ্বের সেরা এক হাজারের মধ্যেও আমাদের গর্বের ধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। শিক্ষাব্যবস্থা যে তলানীতে চলে গেছে, সচেতন মানুষ মাত্রই তা বুঝতে পারে।

প্রতিহিংসায় জ্বলছে সরকারি ৯টি বিশ্ববিদ্যালয়। এরকম চিত্র বিশ্বের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে বলে মনে হয় না। অক্টোবর ২০১৯ প্রাগৈতিহাসিক আমলের মধ্যে একটি ভয়ঙ্কর খুন জাতি অবলোকন করেছিল নামীদামি বুয়েট ইউনিভার্সিটিতে। বুয়েট প্রশাসন এই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। নিশ্চিত যে আবরার শহীদ হয়েছে, আর জাতির কাছে রেখে গেছে কিছু প্রশ্ন। দেশের স্বার্থ নিয়ে কথা বললে আবরারের মতো যেকোনো মানুষকে পৈশাচিক কায়দায় খুন হতে হবে। মৃত্যুর মাধ্যমে আবরার এ রকম একটি বার্তা দিয়ে গেল।

ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সব কিছু উজাড় করে দেবো প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে- এটা কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হতে পারে না। দেশ সুরক্ষার চেতনা নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। একটি স্বাধীন সার্বভৌম সরকার কখনোই পরাধীনতার শৃঙ্খলে জাতিকে আবদ্ধ করতে পারে না। স্বীয় স্বার্থ চরিতার্থে জাতীয় স্বার্থ বিলীন করে দিলে তার পরিণাম খুব ভালো হয় না। ইতিহাসে এর বহু প্রমাণ আছে। আমাদের দেশের অবস্থা সেরকম কি না তা ভাবার সময় এসেছে। মুসোলিনি বলেছেন, স্বৈরাচারের ওপরের স্তর হচ্ছে ফ্যাসিবাদ। তিনি ফ্যাসিবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন এভাবে- যখন স্বৈরাচারের সাথে করপোরেট হাউজগুলো একাকার হয়ে যায় তখন প্রতিষ্ঠা পায় ফ্যাসিবাদ। আমাদের দেশে শুধু করপোরেট হাউজগুলোই নয়, সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বলা যায় বিচার বিভাগ এবং সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্বৈরতন্ত্রের সাথে একাকার হয়ে গেছে। অর্থের বিনিময়ে এক শ্রেণীর তল্পিবাহক, মিডিয়া, এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী ওদের সাথে মিলে গেছে। ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী দুঃখ করে বলেছেন, ‘এ দেশের বুদ্ধিজীবীরাও বিশ্বাসঘাতক ও মীরজাফর।’ (তথ্যসূত্র : জাতীয় দৈনিক, ১৫-১০-১৯)।

২ নভেম্বর ২০১৯ শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি আয়োজিত ‘হুমকির মুখে বাকস্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেছেন, নাগরিকের বাকস্বাধীনতা না থাকলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতাই থাকবে না। তিনি আরো বলেন, আমার জীবন হয়ে যাচ্ছে পশুর জীবন। মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি। অনেক রক্ত ঝরেছে স্বাধীনতা যুদ্ধে। স্বাধীন দেশে পশুর মতো বাঁচা যায় না। এখন যতগুলো আইন তৈরি হচ্ছে, প্রতিটি আইনেই নাগরিকের বাকস্বাধীনতা খর্ব হয় এমন শর্তজুড়ে দেয়া হচ্ছে। তর্কহীন, প্রশ্নহীন সমাজ মৃত সমাজ। নিজেদের বাঁচার জন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে নেয়ার জন্য প্রধান স্তম্ভ বাকস্বাধীনতা। কথার স্বাধীনতা না থাকলে কোনো সৃষ্টিশীল কাজ হয় না। পৃথিবীজুড়েই এর চর্চা চলছে। বিবিসি, সিএনএন এসব মিডিয়া যারা দেখে তারাই উপলব্ধি করতে পারবে বাকস্বাধীনতার মর্ম কী।

সরকারের কাছ থেকে আমরা শুধু উন্নয়নের গল্প শুনি। শাসক দলের কেউ কেউ বলেন, বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো উন্নত হয়ে গেছে। যদি তাই হয়, তাহলে আট কিলোমিটার রাস্তা পেরোতে আমাদের দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে কেন? আর ওই দুটো দেশে সময় লাগে মাত্র ৩০ থেকে ৪০ মিনিট। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি- আমরা আসল কথাটা বলি না, সড়ক নির্মাণে যে দুর্নীতি হয় তা অনেক দেশের যোগাযোগ খাতে বাজেটের সমতুল্য। স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, শাসক শ্রেণীর কারণে সাধারণ যাত্রীরা কেন ভোগান্তির শিকার হবে? এখন গাড়িতে উঠে ভাবি, নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছতে পারব তো। মেয়েরা ভাবে, সম্মান নিয়ে ধর্ষিতা না হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারব তো। শিক্ষার্থীরা ভাবে- নিরাপদে শিক্ষাজীবন অতিক্রম করতে পারব তো। এ প্রসঙ্গে সংসদ সদস্য মঈনউদ্দিন খান বাদল বলেছেন, দেশে ৭০ শতাংশ সংসদ সদস্যই কোটিপতি। তারা তো গত ৩০ বছরেও বাসে চড়েননি। তাহলে তারা কিভাবে সাধারণ মানুষের কষ্টের কথা সংসদে বলবেন। যারা আইন করেন, তারা নিজেরাই পরের দিন আইন ভঙ্গ করেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে ওভারব্রিজ ও ফ্লাইওভার নির্মাণের যে সংস্কৃতি চলছে তা বন্ধ করা উচিত। লক্ষণীয় যে, শিশু ও বৃদ্ধরা ওভারব্রিজে উঠতে পারে না, নামতেও পারে না। এসব ক্ষেত্রে দুর্ঘটনাও ঘটছে। অন্য দিকে একের পর এক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হচ্ছে, এই ফ্লাইওভারগুলোতে কয়টা বাস ওঠে আর কয়টা প্রাইভেট কার ওঠে, তাও ভাবতে হবে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়োজিত কর্মকর্তার এসব বিষয়ে চিন্তা করা দরকার বলে মনে করি। প্রত্যেক মানুষের যেমন অধিকার আছে- তেমনি আছে কর্তব্য ও দায়িত্ববোধ। বাবা-মা, ছাত্র-শিক্ষক, রাষ্ট্রের প্রতিটি অবস্থানে যারা আছেন- তাদেরও অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ আছে।

লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
Email: harunrashidar@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠন মজবুত করতে হবে : শামসুল ইসলাম ইউরো ২০২৪’কে সামনে রেখে দল নির্বাচনে বিপাকে সাউথগেট ভারতীয় পণ্য বর্জনকে যে কারণে ন্যায়সঙ্গত বললেন রিজভী মাকে ভরণ-পোষণ না দেয়ায় শিক্ষক ছেলে গ্রেফতার প্রথম বাংলাদেশী আম্পায়ার হিসেবে আইসিসির এলিট প্যানেলে সৈকত ঢাবির সব ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ নিরাপত্তা-বিষয়ক আলোচনা করতে উত্তর কোরিয়ায় রুশ গোয়েন্দা প্রধান বদলে যেতে পারে এসএসসি পরীক্ষার নাম সীমান্তে বাংলাদেশীদের মৃত্যু কমেছে : পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাস্তি কমিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনে উদ্বেগ টিআইবির যখন দলকে আর সহযোগিতা করতে পারবো না তখন অবসরে যাবো : মেসি

সকল