২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাবরি মসজিদ ও কোর্টের রায়

-

ভারতের সর্বোচ্চ আদালত অযোধ্যার বাবরি মসজিদ মামলায় রায় প্রদান করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস রঞ্জন গগৈয়ের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট সাংবিধানিক বেঞ্চ সেই জমি হিন্দু সম্প্রদায়ের হাতে তুলে দিয়েছেন, যেখানে একসময় বাবরি মসজিদ দাঁড়িয়েছিল। মুসলমানদের অশ্র“ মোছার জন্য তাদের অযোধ্যাতেই পাঁচ একর জমি দিতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যাতে তারা আরেকটি মসজিদ নির্মাণ করতে পারেন। ভারতের জনগণের ওপর চতুর্দিক থেকে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছিল যে, আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে কেউ কোনো প্রকার উৎসবও পালন করবে না, কিংবা কেউ কোনো হাহুতাশও করবে না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যমতে, এই রায়কে কারো জয় বা পরাজয় হিসেবে দেখা উচিত নয়। রামভক্তি হোক বা রহিমভক্তি, এটা আমাদের সবার জন্য ভারতভক্তির আবেগকে শক্ত করার সময়; দেশের মানুষের কাছে তিনি শান্তি-নিরাপত্তা ও জাতীয় ঐক্য বজায় রাখার আবেদনও জানিয়েছেন।

প্রকাশ থাকে যে, আদালতের রায় এ জন্য ঘোষণা করা হয় যে, সব মানুষ তা মেনে নেবে। আমরাও দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে সম্মান জানাই। আর নিজেরাই নিজেদের কাছে কিছু প্রশ্ন করার জন্য অনুমতি চাচ্ছি। স্মর্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের এ রায়কে হিন্দুপক্ষ যেখানে বিশাল রামমন্দির নির্মাণের পথ সুগমকারী ফায়সালা বলে অভিহিত করছে, সেখানে মুসলিম পক্ষ এ রায়ের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে আদালতের কাছে এর রিভিউয়ের জন্য আবেদন করেছে। আরএসসের নেতা মোহন ভাগবত সুপ্রিম কোর্টের রায় পর্যালোচনা করে বলেছেন, সবাই এক হয়ে বিশাল রামমন্দির নির্মাণে এগিয়ে আসবে। প্রকাশ থাকে, সুপ্রিম কোর্টের এ রায় সংঘ পরিবারের জন্য সুসংবাদ বয়ে নিয়ে এসেছে।

‘সংঘ পরিবার’ অযোধ্যায় বিশাল রামমন্দির নির্মাণকে হিন্দুগৌরবের জন্য আবশ্যিক বলে আখ্যায়িত করেছে। এ পরিবারের লোকজন অযোধ্যাকে ‘পবিত্র শহর’ বানাতে চাচ্ছে, যেখানে হিন্দু ছাড়া আর কোনো ধর্মের অনুসারীদের প্রবেশ করা সম্ভব হবে না। বিগত কয়েক দিন ধরে যে বিপুল মুসলমানের প্রতি শান্তি-নিরাপত্তা অব্যাহত রাখা এবং সুপ্রিম কোর্টের রায় সবর্কান্তকরণে মেনে নেয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছিল এবং তাদের প্রতি পদে পদে ধৈর্য-সহিষ্ণুতার সাথে পদক্ষেপ নিতে বলা হচ্ছিল, তা লক্ষ করে এটা অনুমান করা কঠিন ছিল না যে, আদালত এমন একটা রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছেন, যাতে মুসলমানদের শুধুই ধৈর্যধারণ করতে হবে। অথচ এটা নিছক অনুমান ছিল।

কেননা আদালতের রায়ের ব্যাপারে কারো কোনো কিছু জানা ছিল না এবং এ ব্যাপারে কিছু বলারও ছিল না। তবে লক্ষণীয় হচ্ছে, আরএসএসের মতো মুসলিমবিরোধী সংগঠন এ ব্যাপারে প্রথমবারের মতো মুসলমানদের সাথে সংলাপের আয়োজন করেছে। মুসলিম নেতারা, বুদ্ধিজীবী ও উর্দু পত্রিকার সাংবাদিকদের কোথাও চায়ের দাওয়াতে, কোথাও আপ্যায়নে ডেকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যে, তারা মুসলমানদের ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার সাথে পদক্ষেপ গ্রহণের পরামর্শ দেবেন, যাতে তারা অযোধ্যা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়কে টুঁ শব্দ না করেই মেনে নেয়। মুসলমানরা এমন কোনো কাজ যেন না করে, যা জাতীয় ঐক্যে আঘাত করবে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ওপর যার খারাপ প্রভাব পড়বে। এটা তার প্রতিই ইঙ্গিত করে যে, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ধৈর্য মুসলমানদেরই ধারণ করতে হবে। এটা তাদেরই করণীয়।’ যখন রায় ঘোষণা হয়ে গেছে, তখন মুসলমানদের কাছে ধৈর্যধারণ করা ছাড়া আর কিছুই নেই।

এটা তো স্পষ্ট, মুসলমানরা শুরু থেকেই বলে আসছিল, তারা বাবরি মসজিদের বিষয়ে আদালতের রায়কেই মেনে নেবে। পক্ষান্তরে অপরপক্ষ রামমন্দির নির্মাণের জন্য অর্ডিন্যান্স জারি বা পার্লামেন্ট থেকে আইন প্রণয়নের দাবি করছিল। তারা এ ব্যাপারে আদালতকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে প্রস্তুত ছিল।

এ কথা কারো কাছে গোপন নেই যে, বর্তমানে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের স্থানে একটি অস্থায়ী মন্দিরের শক্ত কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে যেখানে রাত-দিন পূজা করা হচ্ছে। ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদের শাহাদতের সময়ও সেখানে মূর্তি রাখা ছিল, যা ২২ ডিসেম্বর, ১৯৪৯ সালের রাতে জোরপূর্বক রাখা হয়েছিল। তখন প্রশাসন মসজিদের পবিত্রতা বজায় রাখা এবং সেখান থেকে মূর্তি সরানোর পরিবর্তে মসজিদে তালা লাগিয়ে দেয়। এ কারণে নামাজের ধারাবাহিকতা সেখানে বন্ধ হয়ে যায়। সংঘ পরিবারের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফলে ১ ফেব্র“য়ারি, ১৯৮৬ সালে গণপূজাপাঠের জন্য বাবরি মসজিদের দরজা খুলে দেয়া হয়েছিল। এটা সেই স্তর, যখন ভারতে সাম্প্রদায়িকতার ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। বাবরি মসজিদের স্থানে সংঘ পরিবারের রামমন্দির নির্মাণের আন্দোলন এতটাই ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করে যে, ৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২ সালে লক্ষাধিক উগ্রপন্থী হিন্দু বাবরি মসজিদকে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায়ে আনন্দের একটি দিক রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট বাবরি মসজিদের ভেতর মূর্তি রাখা এবং এ মসজিদকে ধ্বংস করার ঘটনাগুলোকে বেআইনি ও অপরাধমূলক তৎপরতা বলে আখ্যায়িত করেছেন। তবে হিন্দুদের বিশ্বাস এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার খননের ভিত্তিতে তারা রায় মন্দিরের পক্ষে দিয়েছেন। তবে আদালত এটা মানতে অস্বীকার করেছেন যে, মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট স্বীকার করেছেন, সেখানে বাবরি মসজিদ ছিল, সেখানে নামাজ আদায় হতো। তবে সেখানে হিন্দুও পূজার জন্য যেত। সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, নামাজের ধারাবাহিকতা বন্ধ হওয়ার দ্বারা মসজিদের অস্তিত্ব শেষ হয়ে যায় না। আদালত মসজিদের নিচে কোনো অবকাঠামোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তবে এ কথাও বলেছেন, ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে বিভাগ বলেনি, মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল।’ সুপ্রিম কোর্ট মূলত হিন্দুদের আস্থা-বিশ্বাসকে তার রায়ের ভিত্তি বানিয়েছেন।

আদালতের বক্তব্য- হিন্দুদের বিশ্বাস, ভগবান রামের জন্ম ‘গর্ভগৃহে’ হয়েছিল। একবার যদি আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, তাহলে আদালতকে বিষয়টি থেকে দূরে থাকা উচিত। আর সাংবিধানিক ব্যবস্থাপনার অধীনে গঠিত আদালতকে ভক্তদের আস্থা ও বিশ্বাসের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে বিরত থাকা উচিত। অথচ আদালত এ মামলার শুনানির আগে স্পষ্ট করেছিলেন যে, ‘তারা কোনো আস্থা বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে নয়, বরং মালিকানার অধিকারের ভিত্তিতে এ মামলার রায় দেবেন।’ এ আদালতের রায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সেটি, যেখানে তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে এক ‘অপরাধমূলক বেআইনি কর্ম’ বলে অভিহিত করেছেন। পাশাপাশি এ কথাও মেনে নিয়েছেন যে, সেক্যুলার ভারতের আইনের ভিত্তি হলো বিশ্বাস। বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্র মামলার তদন্তকারী বিচারপতি মনমোহন সিং লিবরাহানও তার প্রতিবেদনে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করাকে একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ্য করেছিলেন।

উল্লেখ্য, সুপ্রিম কোর্টে বাবরি মসজিদের মামলার শুনানি শুরু হলে বিচারপতি লিবরাহান এ বিষয়ে জোর দেন যে, সুপ্রিম কোর্টকে মালিকানা অধিকারের মামলায় রায় দেয়ার আগে বাবরি মসজিদ ধ্বংস ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি করা উচিত, কেননা এ মামলা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আজ যখন সুপ্রিম কোর্ট নিজে থেকেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে এক অপরাধমূলক বেআইনি তৎপরতা বলে অভিহিত করেছেন, তখন সিবিআই আদালতে ওই সব ব্যক্তির বিরুদ্ধে চলমান মামলা নিয়েও আদালতের ভাবা উচিত, যারা বাবরি মসজিদ শহীদ করেছিল। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলা কচ্ছপ গতিতে চলছে। ওই মামলায় সংঘ পরিবারের প্রায় চল্লিশজন নেতার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। মুসলমানরা বাবরি মসজিদ হারিয়ে ফেলেছে। তারা ওই সব লোকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা অবশ্যই চান, যারা আইন, সংবিধান ও আদালতের ধ্বজা উড়িয়ে বাবরি মসজিদকে প্রকাশ্য দিবালোকে শহীদ করে ভারতকে বিশ্ববাসীর সামনে লজ্জায় ফেলে দিয়েছিল। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত কি এ দিকে দৃষ্টি দেবেন?

লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক উর্দুটাইমস ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement