২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গণতন্ত্র ও ভিন্নমত

-

দেশে গণতন্ত্র ‘অপহৃত’ হওয়ার জোরালো অভিযোগের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রের সব সেক্টরেই এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাষ্ট্রাচারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে স্থান করে নিয়েছে দুর্নীতি, অনিয়ম ও লাগামহীন স্বেচ্ছাচারিতা। সুস্থ ধারার রাজনীতির চর্চার পরিবর্তে দুর্বৃত্তায়ন স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আইন ও সাংবিধানিক শাসনের পরিবর্তে অবৈধ পেশিশক্তি, অনাচার সর্বোপরি সীমালঙ্ঘন সে স্থান দখল করে নিয়েছে। রাজনীতি চলে গেছে লাঠিয়াল বাহিনী ও বাজিকরদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে ফ্যাসিবাদ ও নৈরাজ্যবাদের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। রাজনীতিতে মেধা ও মননের চর্চার পরিবর্তে ‘নির্মূল’, ‘প্রতিরোধ’, ‘প্রতিহতকরণ’ ও ‘চামড়া তোলা’র রাজনীতি শুরু হয়েছে। ছাত্ররাজনীতি হয়ে পড়েছে লেজুড়বৃত্তি, সন্ত্রাস, নৈরাজ্যনির্ভর ও পিটিয়ে মানুষ হত্যার অনুষঙ্গ।

সঙ্গত কারণেই সংহতির পরিবর্তে দেশে বিভক্তি ও ঘৃণার রাজনীতি এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ফলে রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও বোধ-বিশ্বাসের ভিন্নতার কারণেই প্রতিপক্ষের ওপর জুলুম-নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য এমনকি নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে প্রতিনিয়ত। সম্প্রতি বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ সেই নেতিবাচক ছাত্ররাজনীতির নির্মম বলি হয়েছেন। ফলে রাষ্ট্রের কার্যকারিতা, সংবিধানের ক্রিয়াশীলতা, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই গুরুতর প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। দেশে গণতন্ত্রের নামে ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে কি না সে প্রশ্নও এখন সাধারণ মানুষের মুখে মুখে।

মূলত আধুনিক বিশ্ব গণতান্ত্রিক বিশ্ব। আর গণতন্ত্রে ভিন্নমতের কারণে মানুষ হত্যা তো দূরের কথা অশ্রদ্ধা দেখানোরও কোনো সুযোগ নেই। গণতন্ত্রের সংজ্ঞা নিয়ে বিভিন্নজন বিভিন্ন ব্যাখ্যা করলেও এর কোনো অভিন্ন সংজ্ঞা এখন পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। তবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় রবার্ট ডাল তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘পলিয়ার্কি : পার্টিসিপেশন অ্যান্ড অপজিশন’-এ একটি অতি প্রাণবন্ত বর্ণনা দিয়েছেন। রবার্ট ডালের মতে, গণতন্ত্র বা বহুজনের শাসনব্যবস্থার কতগুলো মৌলিক উপাদান রয়েছে। সেগুলো হলো, সরকারে সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত কর্মকর্তা থাকা; নিয়মিত, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন; সব পূর্ণবয়স্কের ভোটাধিকার এবং নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার; মতপ্রকাশের স্বাধীনতা; সরকার বা কোনো একক গোষ্ঠীর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এমন উৎসের বিকল্প থেকে তথ্য পাওয়ার সুযোগ এবং সংগঠনের স্বাধীনতা। ডালের এই সংজ্ঞা বা বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও এখন পর্যন্ত গণতন্ত্রের সংজ্ঞা ও গুণাগুণ বিচারে এগুলোই সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মানদণ্ড। কিন্তু আমাদের দেশে যে ধরনের গণতন্ত্র চালু আছে তা ডালের সংজ্ঞার সাথে মোটেই সঙ্গতিপূর্ণ নয় বরং তার পুরোপুরি বিপরীত।

এই প্রেক্ষাপটেই বুয়েটিয়ান আবরার হত্যার প্রসঙ্গ উঠে আসে। আবরারের অপরাধ হলো তিনি একটি বিষয় নিয়ে তার উপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছিলেন। এটি তার সাংবিধানিক অধিকার। হয়তো তার উপলব্ধিটা কারো কারো পছন্দ হয়নি। কারো অভিব্যক্তি অপছন্দ করাও ব্যক্তির নাগরিক অধিকার। কিন্তু সে অভিব্যক্তিতে যদি পিটিয়ে মানুষ হত্যা করা হয়, তাহলে তা আর অভিব্যক্তি থাকে না বরং তা দানবীয় ও পাশবিক কর্ম হিসেবেই বিবেচ্য হয়। আইন ও সংবিধান এভাবে মানুষ হত্যার লাইসেন্স কাউকে দেয়নি।

আমাদের দেশ সাংবিধানিকভাবে গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। আর গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও প্রাণশক্তিই হচ্ছে বাকস্বাধীনতা। সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘Freedom of thought and conscience is guaranteed.’ অর্থাৎ চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। ৩৯(ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘The right of every citizen to freedom of speech and expression are guaranteed.’ অর্থাৎ ‘প্রত্যেক নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা দান করা হইল’। তাই আবরারের যেকোনো বিষয়ে নিজস্ব মতামত প্রকাশ তার সাংবিধানিক ও নাগরিক অধিকার। কারণ, আমাদের সংবিধান সব শ্রেণীর নাগরিকের জন্য সমঅধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে।

মূলত বাকস্বাধীনতা হচ্ছে ব্যক্তি বা সম্প্রদায়ের; নির্ভয়ে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা ছাড়াই, অনুমোদন গ্রহণের বাধ্যতা ব্যতিরেকে নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করার স্বীকৃত মূলনীতি। ‘মতপ্রকাশের স্বাধীনতা’ (freedom of expression) শব্দপুঞ্জটিকেও কখনো কখনো বাকস্বাধীনতার স্থলে ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী অভিব্যক্তির স্বাধীন প্রকাশকে শনাক্ত করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘প্রত্যেকের অধিকার আছে নিজের মতামত এবং অভিব্যক্তি প্রকাশ করার। এই অধিকারের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকবে নিজের স্বাধীন চেতনায় কোনো বাধা ব্যতীত অটল থাকা; বিশ্বের যেকোনো মাধ্যম থেকে যেকোনো তথ্য অর্জন করা বা অন্য কোথাও সে তথ্য বা চিন্তা মৌখিক, লিখিত, চিত্রকলা অথবা অন্য কোনো মাধ্যম দিয়ে জ্ঞাপন করার অধিকার।’ আর ভিন্নমত গণতন্ত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিষয়টি আরো প্রান্তিকতায় নেমে এসেছে। ভিন্নমতের প্রতি ন্যূনতম সম্মান তো দেখানো হচ্ছেই না বরং যেকোনো মূল্যে তা প্রতিহত করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে। গত বছর নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারীদের ওপর যারা হামলা চালিয়েছিল, তাদের পরিচয় নিয়ে অভিযোগের তীর ছিল সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ কর্মীদের দিকেই। এ ছাড়া সামাজিক মাধ্যমে ভিন্নমত প্রকাশের কারণে মামলা ও গ্রেফতারের অনেক ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত। এ ধরনের হাজার হাজার মামলা আদালতে বিচারাধীন। এখন পরিস্থিতির এতই অবনতি হয়েছে যে, ভিন্নমত প্রকাশ কেবল বিপজ্জনক নয়, তা ইতোমধ্যে বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। সরকারের সমালোচনা করলেই আক্রান্ত হতে হবে এমন একটি আতঙ্ক রয়েছে অনেকের মধ্যে। এমনকি নিজের জীবন দিয়ে হলেও এর প্রায়শ্চিত্ত করতে হতে পারে। এর আগে সরকারবিরোধী পোস্টের কারণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আলোকচিত্রী ড. শহীদুল আলমকে কারাভোগ করতে হয়েছে। সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা সারাক্ষণই সামাজিকমাধ্যমে মনিটর করছে এবং যারা লেখালেখি করেন সবাই একটা আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন। ফলে অনেকেই হয়রানি ও মামলা আতঙ্কে লেখালেখি ছেড়েও দিয়েছেন। এ ধরনের একটি ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টির পেছনে রাজনৈতিক অসহনশীলতার অভাব, সুশীল সমাজের নিষ্ক্রিয়তা এবং সাধারণ মানুষের আত্মসচেতনতার অভাবকে দায়ী করা হচ্ছে।

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যার ঘটনা শুধু দেশে নয় বরং বহির্বিশ্বেও আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। শুধু ভিন্নমত বা রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে এ ধরনের পিটিয়ে হত্যার ঘটনাকে সবাই ধিক্কার জানিয়েছে। এমনকি জাতিসঙ্ঘসহ বিভিন্ন দূতাবাস থেকেও এই নির্মম ঘটনার নিন্দা জানানো হয়েছে। অথচ সরকার বরাবরই দাবি করে আসছে যে, আমরা সারা বিশ্বে নিজেদের উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে গেছি। প্রধানমন্ত্রী শান্তির জন্য কয়েক দিন আগেও ভারত থেকে একটা পুরস্কার পেয়েছেন। ইতপূর্বে ‘মাদার অব হিউম্যানিটি’ অভিধাও তিনি লাভ করেছেন আমাদের মন্ত্রিসভার মাধ্যমে। কিন্তু এসব অর্জনের সাথে আমাদের দেশের বাস্তবতার মিল আছে বলে মনে হচ্ছে না বরং সরকারের অভ্যন্তরের সুবিধাবাদীরা এসব অর্জনকে বিসর্জন দেয়ার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছেন। আত্মস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই রাজনীতিকে একেবারে প্রান্তিকতায় ঠেলে দেয়া হয়েছে। মূলত পরমতসহনশীলতা গণতন্ত্রের মূল উপাদান। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকের কিছু অধিকার সংরক্ষণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র কোনো অজুহাতেই এ দায়িত্ব উপেক্ষা করতে পারে না।

প্রতিটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিক তিন ধরনের অধিকার ভোগ করবে- ১. সামাজিক অধিকার, ২. রাজনৈতিক অধিকার এবং ৩. অর্থনৈতিক অধিকার। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে নিম্নে নাগরিক অধিকার নিয়ে আলোচনা করা হলো :

সামাজিক অধিকার : জীবন ধারণের অধিকার. ২. ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার, ৩. মত প্রকাশের অধিকার, ৪. সভা-সমাবেশ করার অধিকার, ৫. সম্পত্তি ভোগের অধিকার, ৬. ধর্মীয় অধিকার, ৭. আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার, ৮. চুক্তির অধিকার, ৯. ভাষার অধিকার, ১০. পরিবার গঠনের অধিকার ও ১১. শিক্ষা লাভের অধিকার।

রাজনৈতিক অধিকার : ভোটাধিকার, ২. প্রার্থী হওয়ার অধিকার, ৩. অভিযোগ পেশ করার অধিকার, ৪. সমালোচনা করার অধিকার, ৫. চাকরি লাভের অধিকার ও ৬. বসবাসের অধিকার।

অর্থনৈতিক অধিকার : কাজের অধিকার, ২. উপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভের অধিকার, ৩. অবকাশ যাপনের অধিকার, ৪. সঙ্ঘ গঠনের অধিকার ও ৫. রাষ্ট্র প্রদত্ত প্রতিপালনের অধিকার ইত্যাদি।

গণতন্ত্রের মূলমন্ত্র জনগণের শাসন, শাসকগোষ্ঠীর জবাবদিহি, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন গণমাধ্যমকে সরকার মোটেই গুরুত্ব না দিয়ে তাদের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্যই গণতান্ত্রিক সব রীতিনীতি উপেক্ষা করছে, যা আমাদের জন্য রীতিমতো অশনিসঙ্কেত। তাই সার্বিক দিক বিবেচনায় দেশ ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকে ধাবিত হচ্ছে কি না সে প্রশ্নের কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।

smmjoy@gmail.com


আরো সংবাদ



premium cement
বৃষ্টির নামাজ আদায়ের নিয়ম আজও স্বর্ণের দাম ভরিতে ৬৩০ টাকা কমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২৮ এপ্রিল খুলে দেয়ার প্রস্তুতি, ক্লাস চলবে শনিবারও মিরসরাইয়ে জুস খাইয়ে অজ্ঞান করে লুট, মূল হোতা গ্রেফতার বৃষ্টি কামনায় ঈশ্বরগঞ্জে জামায়াতে ইসলামীর ইসতিসকার নামাজ আদায় কুবিতে আল্টিমেটামের পর ভিসির কার্যালয়ে তালা ঝুলাল শিক্ষক সমিতি সাজেকে সড়ক দুর্ঘটনায় ৫ শ্রমিক নিহতের খবরে ঈশ্বরগঞ্জে শোক দুর্যোগে এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি মৃত্যু কেন বাংলাদেশে? জবিতে ভর্তি পরীক্ষায় আসন বেড়েছে ৫০টি বিএনপি ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে : ওবায়দুল কাদের মাটির নিচে পাওয়া গ্রেনেড মাইন মর্টার শেল নিষ্ক্রিয় করল সেনাবাহিনী

সকল