২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কালের বিবর্তনে শিক্ষা ও শিক্ষকতা

কালের বিবর্তনে শিক্ষা ও শিক্ষকতা - ফাইল ছবি

ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে কয়েকজন প্রথিতযশা ও দেশবরেণ্য আলোকিত শিক্ষককের সংস্পর্শে আসার সুযোগ আমার হয়েছে। শিক্ষকের জ্ঞানের গভীরতা, চারিত্রিক মাধুর্য, অনুপম আদর্শ ও জীবনের লক্ষ্য অনুধাবন করে শিক্ষক হওয়ার দুঃস্বপ্ন আমি কখনো দেখিনি। শিক্ষাজীবনে অ্যাকাডেমিক কিঞ্চিৎ সাফল্যের কারণে এবং ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের ফলে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল, একটি সরকারি চাকরি হয়তো পেতে পারি। শুধু সার্টিফিকেট দিয়ে একজন শিক্ষক হওয়া যাবে ; এ চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন এক শিক্ষক বলতেন, ‘যে শিক্ষক ভাববে তার লেখাপড়া শেষ, সেই শিক্ষকও শেষ, তার ছাত্রছাত্রীরাও শেষ, কারণ একজন শিক্ষক হবেন অনন্ত অধ্যবসায়ী ছাত্র’।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ পরীক্ষা শেষে ফলাফল পাওয়ার অব্যবহিত পরেই শিক্ষক হওয়ার আবেদন করি। চাকরি যখন হয়ে গেল, মনে হলো এ যেন মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। সত্যিকার অর্থে যখন শিক্ষক হলাম, তখনই আমি এটিকে আমার জীবনের বিশাল সাফল্য মনে করে একজন নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক হওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা শুরু করি।

শিক্ষক হওয়ার আতঙ্ক হলো শিক্ষার লক্ষ্য কি- এ সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকা। আজ ২০ বছর ধরে শিক্ষকতা করছি এখনো আমি নিশ্চিত নই কি লক্ষ্য আমাদের শিক্ষার। শিক্ষার মৌলিক নীতি যা বারট্রান্ড রাসেল ও জুলিয়াস নায়েরের কথায় স্পষ্ট। শিক্ষার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হচ্ছে- প্রাত্যহিক জীবনে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করা।

যে শিক্ষাজীবনে ন্যূনতম অর্থনৈতিক নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ; সে শিক্ষা প্রকৃতপক্ষে কল্যাণকামী শিক্ষা নয়। শিক্ষার দ্বিতীয় লক্ষ্য হচ্ছে একজন আলোকিত মানুষ সৃষ্টি করা। একজন আলোকিত মানুষ নিজের কল্যাণের সাথে অন্যের কল্যাণকে একত্রিত করে নেবে। একজন আলোকিত মানুষ কখনোই নিজের কল্যাণের জন্য অন্যের ক্ষতিসাধন করতে পারে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে এমন কয়েকজন শিক্ষক পেয়েছিলাম, যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়- পৃথিবীর যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করার যোগ্যতা রাখেন। এমিরিটাস প্রফেসর ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, আহসানুল হক এবং ড. শামসুজ্জোহা স্যারসহ অন্য শিক্ষকেরা। শিক্ষার মহানব্রত নিয়ে দেশ মাতৃকার প্রতি গভীর মমত্ববোধের কারণে ব্যাপক ভোগবাদী প্রাপ্তিকে অস্বীকার করে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে জাতিকে আলোকিত করছেন। তাদের একজন ছাত্র হিসেবে এবং এই জাতির একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমি তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।

হাইস্কুলপর্যায় থেকে যেসব পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষককে পেয়েছি তাদের অনেকেই আর্থিকভাবে সচ্ছল ছিলেন না। তারা দরিদ্র ছিলেন কিন্তু অভাবী ছিলেন না। প্রাত্যহিক জীবনে দারিদ্র্যের কষাঘাতের মধ্যে দিনাতিপাত করেছেন। তাদের অভাব তাদের স্বভাবকে নষ্ট করতে পারেনি।

আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক সানাউল্ল্যাহ স্যার মফস্বলে গিয়ে তিন তিনটি হাইস্কুল গড়ে তোলার গৌরব অর্জন করেন। এমন উঁচুমানের শিক্ষাবিদ গ্রামীণ জীবনে বিরল। তিনি ইচ্ছে করলেই নগরের প্রাচুর্যের মধ্যে জীবনযাপন করতে পারতেন। এমন দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী শিক্ষাবিদেরা জাতির কাছে অনন্তকালের জন্য অনুসরণীয় ও বরণীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিহ্নিত হবেন।

শিক্ষকতা জীবনের প্রারম্ভে আমি কয়েকজন উঁচুমানের শিক্ষাবিদের সাহচর্য পেয়েছি; যার ফলে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আমার গভীর মোহ তৈরি হয়েছে। সর্ব প্রথমে আমি যাকে স্মরণ করতে চাই, তিনি হলেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের সাবেক ক্যান্টনমেন্ট এক্সিকিউটিভ অফিসার শফিক আলম মেহদী, যিনি পরে বিমান সচিবসহ বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন।

শিক্ষার প্রতি তিনি গভীর অনুরাগ পোষণ করতেন এবং শিক্ষকতা পেশাকে সর্বোচ্চে স্থান দিয়েছেন। শিক্ষকতা পেশার প্রতি আমার বিশেষ আকর্ষণ অনুভব করার আরেকটি কারণ ছিল আমাদের কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. মো: হুমায়ুন কবীর। তিনি একজন আদর্শ মানুষ। আমরা অনেকেই সুন্দর কথামালা দিয়ে প্রমাণ করতে চাই, আমরা ফেরেশতার মতো মানুষ কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমরা প্রমাণ করি, আমরা যা বলি, আমরা তা করি না।

সম্পদের প্রতি নির্মোহ ড. হুমায়ুন কবীর তার শত্রুর কল্যাণ করার জন্য সদা প্রস্তুত। আমার সাথে ড. কবীরের এখানেই ফারাক। আমি নিজেকে তথাকথিত ভালো মানুষ মনে করি এবং যাকে আমি প্রতিপক্ষ মনে করি, তাকে এড়িয়ে চলি। ড. হুমায়ুন কবীর উপযাচক হয়ে তার শত্রুর কল্যাণ করেন। তাকে আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি এবং অনুকরণ করার চেষ্টা করি কিন্তু তার গুণাবলি অর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তথাপি আমি আনন্দিত এই ভেবে যে, আমার সামনে অর্জন করার মতো গুণাবলিসম্পন্ন একজন ব্যক্তিত্ব আছেন। আসলে শিক্ষকেরা হবেন এমনি অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তাহলেই জাতির কল্যাণ নিশ্চিত হবে।

শিক্ষকেরা জাতির দর্পণ। তারা জাতির নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিদের পথ প্রদর্শক। নেতৃত্ব সৃষ্টি ও জাতি গঠনে তাদের ভূমিকার বিকল্প নেই। কোন জাতি কতটা উত্তমরূপে পরিচালিত হচ্ছে; সেটা নির্ভর করছে সে জাতির শিক্ষকসমাজ কতটা যোগ্যতর। শিক্ষকদের মূল্যায়ন করার ক্ষমতা তখনি সে জাতির হবে, যখন জাতির নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তিরা তাদের শিক্ষকদের পথপ্রদর্শক হিসেবে মনে করবে। একজন শিক্ষক কখনোই তার বুন্ধ-বান্ধবকে দৃষ্টান্ত হিসেবে নিতে পারেন না।

ব্যাংক, বীমা বা সরকারি অফিসে আমলারা স্বাচ্ছন্দ্যকর চাকরি করেন কিন্তু জাতি গঠনে তাদের ভূমিকা নগণ্য। তারা কতটা নৈতিকতা সম্পন্ন হবেন সেটা নির্ভর করবে তাদের শিক্ষক সমাজ কতটা নৈতিকতা সম্পন্ন। একজন আমলা বা ব্যাংক কর্মকর্তাকে ছাত্রছাত্রীরা অনুসরণ করে না, কিন্তু তারা ব্যাংক কর্মকর্তা বা আমলা হতে চায়। শিক্ষকেরা হচ্ছেন ছাত্রছাত্রীদের আদর্শ ব্যক্তিত্ব।

আজ ভোগবাদী ভাবনা শিক্ষক সমাজে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। কিছু শিক্ষক প্রাইভেটের নামে ছাত্রছাত্রীদের পণবন্দী করছেন। ফলে পুরো শিক্ষক সমাজ কিছু শিক্ষকের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীরা হারাচ্ছে তাদের অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। শিক্ষক সমাজের অনৈতিক আচরণ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সংক্রামিত হচ্ছে। দু-একটি ডাল ভেঙে পড়লে, বৃক্ষের কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু শেকড় নষ্ট হয়ে গেলে বাইরে থেকে বৃক্ষটির স্বরূপ অনুভব করা না গেলেও তার অস্তিত্ব দ্রুত বিপন্ন হতে বাধ্য।

শিক্ষক সমাজ যদি অন্যদের মতো সম্পদের মোহে লালায়িত হয়; তাহলে জাতির ধ্বংস অনিবার্য। আজ শিক্ষার মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে- ভোগের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। পশ্চিমা ভোগবাদী শিক্ষা মহাপ্লাবনের মতো আমাদের সবকিছু কেড়ে নিচ্ছে। ভোগবাদী শিক্ষা আমাদের বিলাসের দাস বানিয়েছে।
উপসংহারে একটি কথা না বললেই নয়, কিছুদিন আগে একটি জরিপ হয়েছে।

জরিপে এ তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে যে, বর্তমানে প্রায় ৭০ শতাংশ ছাত্রছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকাদের তাদের আদর্শ মানুষ মনে করে না। আমি এই জরিপের ফলাফলকে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক বলে মনে করছি। আমি জানি, বর্তমানে শিক্ষকদের প্রতি সামাজিক নেতৃত্বের ভয়ানক শ্যেনদৃষ্টি রয়েছে। দেশের প্রভাবশালী পত্রিকাগুলো শিক্ষকদের দোষ-ত্রুটিকে অত্যন্ত বড় করে উপস্থাপন করছে।

শিক্ষকদের পক্ষে আমি সাফাই গাচ্ছি না; কিছু শিক্ষকের ত্রুটির জন্য পুরো শিক্ষক সমাজকে আসামির কাঠ গোড়ায় দাঁড় করানো কি ঠিক হবে? বলতে চাই, সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ শিক্ষক নীতি, নৈতিকতার মানদণ্ডে হয়তো উত্তীর্ণ নন, কিন্তু বাংলাদেশের যেকোনো পেশাজীবীর তুলনায়, শিক্ষকেরাই এখন পর্যন্ত অনুকরীয় ব্যক্তিত্ব। শিক্ষকদের যদি প্রত্যাখ্যান করা হয়, তাহলে ছাত্রছাত্রীরা কাকে অনুসরণ করবে? জাতিকে শেকড়হীন করার এমন আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসার এবং উত্তরণের জন্য আমি বিবেকবানদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি এবং তাদের ভূমিকা কামনা করছি।

লেখক : ইংরেজির সহকারী অধ্যাপক,
শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজ


আরো সংবাদ



premium cement