১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

পানগাঁও আইসিটিতে শুল্কায়ন জটিলতায় আটকা পড়েছে শতাধিক পণ্যবোঝাই গাড়ি

একই পণ্যে ভিন্ন শুল্ক মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে আমদানিকারকেরা; ট্রান্সপোর্ট ভাড়া গুনতে হচ্ছে ৫ লাখ টাকা
পানগাঁও আইসিটিতে খালাসের অপেক্ষায় থাকা শতাধিক পণ্যবোঝাই ট্রাক -

খালাস হওয়ার অপেক্ষায় পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালে (আইসিটি) রয়েছে শতাধিক আমদানিপণ্য বোঝাই ট্রাকও কাভার্ড ভ্যান। আমদানিকৃত পণ্যের ডিক্লারেশনের সাথে বাস্তবতার মিল না থাকায় এসব পণ্যবোঝাই গাড়ি আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। একই অভিযোগের কারণে আটক হলেও কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তার সাথে কিছু আমদানিকারকের বিশেষ সখ্যতার ফলে তাদের গাড়ি ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। ফলে আটক থাকা সাধারণ আমদানিকারকদের গাড়ির ভাড়া বাবদ প্রতিদিন গুনতে হচ্ছে পাঁচ লাখ টাকা। এ ছাড়াও একই আমদানিকৃত পণ্যে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ শুল্কায়নের ঘটনাও ঘটছে। এতে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমদানিকারক ও পরিবহন মালিকরা। এই বৈষম্য শুল্কায়নের ফলে এই বন্দর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। কাস্টমস কর্মকর্তাদের এমন কর্মকাণ্ডে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পানগাঁও আইসিটি আদৌ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে কি না তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৫ মে এই বন্দর দিয়ে জন্মদিনের বেলুন খালাস করে এশিয়ান গ্লোবাল লিঙ্ক নামে একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এর শুল্কায়ন করা হয় প্রতি কেজিতে দেড় ডলার করে। একই পণ্য গত ২৬ আগস্ট খালাস করে এম এস সাদ এন্টারপ্রাইজ। সেই পণ্যেও প্রতি কেজিতে দেড় ডলার করে শুল্কায়ন করা হয়। কিন্তু মাত্র এক দিন আগে ২৫ আগস্ট এক কনটেইনার একই পণ্য শুল্কায়ন করতে গেলে প্রতি কেজিতে সাড়ে ৩ ডলার দাবি করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে আমদানিকারক ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের মধ্যে আইনগত প্রতিকার নিয়ে তর্কবিতর্ক হয়।
পানগাঁও আইসিটির এসব অনিয়ম ও কনটেইনার আটকের অভিযোগ পুরনো। দীর্ঘদিন ধরে পোর্টে কনটেইনার আটকে আছে এমন অভিযোগের তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) নির্দেশনা দেয় এবং তদন্ত প্রতিবেদন ১৫ দিনের মধ্যে দুদকের কাছে প্রেরণের অনুরোধ করা হয়।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, টার্মিনাল পুরোদমে চালু না হওয়ায় সরকার বঞ্চিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ শুল্ক থেকে। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, জনবল ও যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও কনটেইনার টার্মিনাল সচল না হওয়ার নেপথ্যে কাস্টমস কর্মকর্তাদের অযোগ্যতা ও হয়রানিকে দায়ী করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় এমপি, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে যোগাযোগও করছেন তারা। তারপরেও কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় পানগাঁও পোর্ট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। বিকল্প পোর্ট হিসেবে কমলাপুর আইসিডি এবং চট্টগ্রাম বন্দরকে বেছে নিচ্ছেন তারা। ফলে দিন দিন রাজস্ব কমছে এই পোর্টে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক আমদানিকারক ও সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অভিযোগ করে বলেন, এই পোর্টের কাস্টমস কমিশনারের প্রশাসনিক দুর্বলতায় সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন অতিরিক্ত কমিশনার ও একজন সহকারী কমিশনার। কোন পণ্যে কোন এইচএস কোডে শুল্কায়ন করা হবে তা নির্ধারণ করে দেন তারা। যেসব সিঅ্যান্ডএফ ও আমদানিকারক তাদের খুশি করতে পারবে তাদের পণ্য এইচএস কোডের মারপ্যাচে নামমাত্র শুল্কায়ন করা হয়। আর যারা এই দুই কর্মকর্তার সাথে সমঝোতা করতে ব্যর্থ হবে তাদের অতিরিক্ত শুল্কায়ন ছাড়াও অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন অনিয়ম দেখিয়ে মামলাও দেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে পণ্যবাহী কনটেইনার কম খরচে নৌপথে ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে আসার লক্ষ্যে রাজধানীর অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে ওই আইসিটি নির্মাণ করা হয়। ২০১৩ সালের ৭ নভেম্বর এটি উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রতিষ্ঠার ছয় বছর পেরিয়ে গেলেও এটি পুরোদমে চালু হয়নি। এই বন্দর থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির টার্গেট থাকলেও দিন দিন তা কমে যাচ্ছে।
এক অর্থবছরের ব্যবধানে কনটেইনার আমদানির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পানগাঁও পোর্টে কনটেইনার এসেছে এক হাজার ২২৩টি। অথচ ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এসেছে ৯২৪ কনটেইনার পণ্য। অর্থাৎ কনটেইনার আমদানি কমেছে ২৯৯টি। এ কারণে রাজস্ব আদায়ে দেখা দিয়েছে বিপর্যয়। এ দিকে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের এনবিআরের বেঁধে দেয়া লক্ষ্যমাত্রা ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে ৮৬০ কোটি টাকা। আর সদ্য বিদায়ী অর্থবছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা এক হাজার ১০২ কোটি টাকার মধ্যে আদায় হয়েছে মাত্র ৫৬০ কোটি টাকা। কাস্টমস কর্মকর্তাদের হয়রানির কারণে রাজস্ব আদায় অর্ধেকে নেমে এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ টার্মিনালে আমদানিকৃত পণ্যের নাম, বিবরণ, গুণগত মান, মূল্য, এইচএস কোড ইত্যাদিতে মিথ্যা ঘোষণা দেয়ার ঘটনা ঘটছে অহরহ। এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করছেন শুল্ক কর্মকর্তারা। তারা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের কাছ থেকে বাড়তি আর্থিক সুবিধা আদায় করে বেশি শুল্কপণ্যকে কম শুল্কপণ্য দেখিয়ে শুল্কায়ন করছেন। এ সময় যেসব ব্যবসায়ীর সাথে শুল্ক কর্মকর্তাদের বোঝাপড়া হচ্ছে না তাদের পণ্য খালাসে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ করছেন। একই পণ্যে আদায় করা হচ্ছে ভিন্নভিন্ন শুল্ক। ফলে তাদের পোর্টের ভাড়া বাবদ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় এবং ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে পানগাঁও কাস্টমস হাউজের কমিশনার ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর সাথে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।


আরো সংবাদ



premium cement