শিশুর মাথা কাটার ঘটনায় স্তব্ধ নেত্রকোনা

প্রকাশ্য দিবালোকে শত শত লোকের সামনে সজিব নামে ৭ বছরের এক শিশু সন্তানের রক্তঝড়া কাটা মস্তকের লোমহর্ষক প্রদর্শনের ঘটনায় গোটা নেত্রকোনা স্তব্ধ হয়ে পড়েছে। লোমহর্ষক বীভৎস এই ঘটনা এবং ঘাতককে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় শিশু, নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষের মাঝে এখন তীব্র আতঙ্ক বিরাজ করছে। আর এই সঙ্কট কাটিয়ে উঠার জন্য গতকাল জুমা নামাজ শেষে মসজিদে মসজিদে মুনাজাত করা হয়। গত বৃহস্পতিবারের এই ঘটনায় থানায় দুইটি মামলা দায়ের হয়েছে। একটি মামলা দায়ের করেন নিহত শিশু সজিবের বাবা রহিছ উদ্দিন আর ঘাতক রবিন গণপিটুনিতে নিহত হওয়ায় পুলিশ স্বেচ্ছায় বাদি হয়ে অজ্ঞাত নামে আসামি উল্লেখ করে অপর একটি মামলা দায়ের করে।
এই ঘটনার আলোকে গতকাল বেলা ১১টার দিকে পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করা হয়। প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী জানান, শিশু হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কতিপয় লোক ছেলে ধরা ও পদ্মা সেতুতে ছেলে শিশুদের মাথা দেয়ার কথা বলে যে গুজব ছড়ানো হচ্ছে, তা আদৌ সত্য নয়, নিতান্তই অসত্য ও বিভ্রান্তিমূলক। তিনি সাংবাদিকদের মাধ্যমে এ ধরনের গুজব না ছড়ানোর জন্য সবার প্রতি অনুরোধ জানান। পাশাপাশি সব অভিভাবকদের আতঙ্কিত না হওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। তবে কী কারণে কেন এই নৃশংস লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘঠিত হলো তা তিনি আয়োজিত ব্রিফিংয়ে বলতে পারেননি। বিষয়টি তদন্ত করে শীঘ্রই হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা হবে বলে সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেন। এ সময় পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গত কিছুদিন ধরে শিশুধরা, গলাকাটা ও জেলার বিভিন্ন স্থানে একাধিক শিশুর নিখোঁজ হওয়ায় শহরে মাইকিংয়ের ঘটনায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। গত ১২ জুলাই বিকেলে সদর উপজেলার বাংলা নামক স্থানে শান্তি ফিলিং স্টেশন এলাকায় অজ্ঞাত এক নারী পাশের এক বাড়ি থেকে এক কন্যা শিশুকে চুরি করে নিয়ে পালানোর সময় জনতার হাতে ধরা পড়ে। গণপিটুনি দেয়ার একপর্যায়ে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করতে পুলিশ শিশুধরা আটক ওই নারীকে পাগলি বলে জানায়। এতে সাধারণ লোকজন হতাশ হয়ে পড়েন। বৃহস্পতিবারের লোমহর্ষক ওই ঘটনার রক্তঝড়া শিশুর কাটা মস্তকের ছবি ও ভিডিও চিত্রসহ সংবাদ দ্রুত সারা দেশে ভাইরাল হয়ে পড়লে শিশুসহ নারী-পুরুষের মাঝে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। একই দিন সদর উপজেলার বাংলায় অপর এক শিশুকে শিশুধরা ছুড়ি দিয়ে গলার এক অংশ পোজ দিয়ে কেটে ফেলায় কান্নারত ভিডিও ফুটেজ লোকজনকে আরো আতঙ্কিত করে তোলে। সন্ধ্যার পর পর ভয় ও আতঙ্কে শহর প্রায় ফাঁকা হয়ে পড়ে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অনেকে বিনিদ্র রাত কাটান। যারা রাতে জানালা খুলে ঘুমাতে যেতেন তারাও ভয়ে জানালা বন্ধ রাখেন। ওই দিন রাতে শহরের ইসলামপুর এলাকায় জনৈক মন্নাফের বাড়িতে চোর প্রবেশ করায় টের পেয়ে গলাকাটা বলে চিৎকার শুরু করলে বহু লোকজন ঘরের বাইরে এসে চিৎকার করেন। গতকাল শহর ছিল কার্যত ফাঁকা। রাস্তায় কোনো শিশু দেখা যায়নি। অভিভাবকরা শিশুদের নিয়ে এখন চরম আতঙ্কে সময় পার করছেন। গুজব গুজব বলে পুলিশের কোনো কথাই জনগণ এখন আর বিশ্বাস করতে পারছেন না।
উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে শহর এলাকার বারহাট্টা রোডস্থ শ্রমিক ইউনিয়ন সংলগ্ন মেথরপট্টিতে মদ্যপ অজ্ঞাত এক যুবকের ব্যাগ থেকে হঠাৎ একটি শিশুর সদ্যকাটা রক্তে রঞ্জিত মস্তক মাটিতে পড়ে যায়। এ সময় সেখানে উপস্থিত লোকজন তা দেখে ভয়ে আঁতকে উঠেন। এ সময় ঘাতক যুবক দৌড়ে পালানোর সময় নিকটবর্তী নিউটাউন অনন্ত পুকুর পাড়ে পেছনে ধাওয়া করে ঘিরে ফেলে জনতা। এ সময় চরম উত্তেজিত জনতা লাঠিসোটা দিয়ে পিটিয়ে অজ্ঞাত ওই ঘাতক যুবককে হত্যা করে। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছে মডেল থানা পুলিশ শিশুর গলাকাটা মস্তক এবং অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার করে নেত্রকোনা আধুনিক সদর হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে। এই সংবাদ ঝড়ের গতিতে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবার মধ্যে চরম আতঙ্ক শুরু হয়।
গতকাল দিনভর এই নিয়ে সাধারণের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা চলতে থাকে। শান্তির শহর নেত্রকোনায় এমন অবিশ্বাস্য ও লোমহর্ষক ঘটনায় সাধারণ লোকজন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন। গলা কেটে শিশুকে হত্যা রহস্য উন্মোচিত না হওয়ায় এখন নানা ধরনের গুজব ছড়িয়ে পড়ছে।