২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচীন কীর্তি

অনন্য স্থাপত্য
সোনারগাঁওয়ে হোসেন শাহী মসজিদ :নয়া দিগন্ত -

মোগল আমলের বারো ভূঁইয়াদের মধ্যে বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী শাসক ঈসা খাঁর রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। এখানে বারো ভূঁইয়া প্রধান ঈসা খাঁ ও মুসা খাঁ এবং পূর্ববর্তী স্বাধীন সুলতানেরা রাজত্ব করতেন। তাদের রাজত্বকালে তারা রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় মনোরম ইমারত, মসজিদ, খানকা ও সমাধি নির্মাণ হয়। তাদের প্রতিটি মসজিদ, খানকা ও সমাধিতে মুসলিম ঐতিহ্যগত আরবীয় অলঙ্করণ পরিলক্ষিত হয়। এসব প্রাচীন কীর্তির প্রতিটি মসজিদ, খানকা ও সমাধি ছোট-বড় প্রস্তর খণ্ড দিয়ে সুসজ্জিত।
সোনারগাঁও বর্তমানে বিক্ষিপ্ত কতগুলো গ্রামের সমষ্টি মাত্র। পানাম, আমিনপুর, গোয়ালদী, মোগরা পাড়া, দমদমা, ভাগলপুর, শাহ চিল্লাহপুর, মহজমপুর এসব গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পুরা কীর্তিগুলোর ধ্বংসাবশেষ প্রাচীন সুবর্ণগ্রাম, নব্য বিকাশিকা, সম্রাট আকবরের প্রিয় নগরী জান্নাতুল বিলাদ অথবা হজরত জাল্লাল সোনারগাঁওয়ের সেই গৌরবোজ্জ্বল ও রোমাঞ্চকর ইতিহাসের কথাই সগৌরবে ঘোষণা করছে। এসব গ্রামের অন্যতম হলো গোয়ালদী। এ গ্রামে সে সময়ের গৌরবময় দিনের যেসব নিদর্শন বিদ্যমান রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হোসেন শাহী মসজিদ। সোনারগাঁওয়ের দ্বিতীয় উল্লেখযোগ্য প্রাচীনকীর্তি এই মসজিদ মুসলিম স্থাপত্য শিল্পের এক অনুপম নিদর্শন। ইতিহাস ও উপাখ্যানে সোনারগাঁওকে দেখা হয়েছে পরীর রানী হিসেবে। ইতিহাসে পূর্ব বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওকে হোসেন শাহী আমলে পরিচয় করে দেয়া হয়েছে স্বর্ণযুগ হিসেবে। কারণ এ সময়ের আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ছিলেন এক অনন্য সাধারণ প্রতিভাসম্পন্ন সুলতান। স্থাপত্যের প্রতি ছিল তার প্রগাঢ় অনুরাগ। তিনি নির্মাণ করে গেছেন অসংখ্য মনোমুগ্ধকর মসজিদ ও মাদরাসা। তার বিস্তৃত রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে যেসব মসজিদ নির্মিত হয়, তার মধ্যে এই ঐতিহাসিক গোয়ালদী মসজিদটি অন্যতম। বর্তমানে মসজিদটি দেখার জন্য প্রতিদিন দেশ-বিদেশের দর্শনার্থী ও পর্যটক আসেন সোনারগাঁওয়ে। সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলোর পাশাপাশি দর্শনার্থীদের হৃদয় জুড়াতে সম এমন অসংখ্য পুরাকীর্তির নিদর্শনের মাঝে হোসেন শাহী মসজিদ অন্যতম। এ মসজিদের মনোরম নির্মাণশৈলী অনায়াসে দর্শনার্থীদের হৃদয় আকৃষ্ট করে। কিন্তু সংস্কারের অভাবে আজ এটি ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে। এতে উপমহাদেশের স্বনামধন্য বারো ভূঁইয়ার রাজধানী সোনারগাঁও হারাতে বসেছে তার এক অনুপম নিদর্শন।
রাজধানী ঢাকা থেকে ২৪ কিলোমিটার পূর্বে সোনারগাঁওয়ের এক পল্লী গ্রাম গোয়ালদীতে ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা মনোরম পরিবেশে সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহীর শাসন আমলে নির্মিত এ মসজিদটি। জানা গেছে, আলাউদ্দিন হোসেন শাহের রাজত্বকালে মোল্লা হিজবার আকবর ৯২৫ হিজরি ১৫ শাবান মোতাবেক ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দে ১২ আগস্ট এ মসজিদ নির্মাণ করেন। হোসেন শাহ ৯০৫ হিজরি থেকে ৯২৭ হিজরি পর্যন্ত রাজত্ব করেন এবং তিনি বাংলার সুলতানদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। কারুকার্যময় মসজিদটি নির্মাণের পর দীর্ঘ দিন দর্শনীয় ইবাদতের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার একপর্যায়ে সংস্কারের অভাব ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়। পরে তা আবার নির্মাণ করা হয়। পুনর্নির্মাণের আগে মেহবার ও দেয়ালের কিছু অংশের অস্তিত্ব ছিল। সোনারগাঁওয়ে গোয়ালদী গ্রামে মসজিদটি নির্মিত হয় বলে এটির নাম দেয়া হয় গোয়ালদী হোসেন শাহী মসজিদ। সোনারগাঁওয়ে যেসব মুসলিম স্থাপত্য নির্মিত হয়েছে তার মধ্যে প্রাচীন আরবীয় শিল্পরীতিতে নির্মিত এ মসজিদটি সবচেয়ে আকর্ষণীয় মসজিদ।
মসজিদ সম্পর্কে জেমস ওয়াইজ এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালে এবং স্যার কালিংহাম ১৮৭৯ সালে সার্ভে অব ইন্ডিয়া রিপোর্টে বর্ণনা করেছেন। এ বর্ণনার ওপর ভিত্তি করে সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগ আগের মতো করে মসজিদটিকে নতুনভাবে নির্মাণ করেছেন। গৌঢ়, পাণ্ডুয়া বাংলার অন্যান্য ইমারতাদির মতো এ মসজিদের ভেতর ও বাইরের দেয়ালের পাথর ও ইটে আরবীয় অলঙ্করণ পরিলক্ষিত হয়। ইট ও পাথরের মূল অলঙ্করণের কিছু নিদর্শন মসজিদের পশ্চিম দেয়ালের, বিশেষত মেহরাবে লক্ষ করা যায়। মসজিদের মেহরাবের গায়ে ফুল, লতাপাতা আঁকা বিভিন্ন নকশা ও আরবি লিপির অলঙ্করণ। কেন্দ্রীয় মেহরাবটি চমৎকার। এটি কালো প্রস্তরে নির্মিত ও কারুকার্যখচিত। মসজিদের আয়তন বাইরের দিকে দৈর্ঘ্য প্রস্থ ২৬ ফুট করে। পলেস্তরা ছাড়াই লার চিকন ইটের তৈরি বর্গাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদটির ভেতরের প্রতি বাহুর দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৬ ফুট এবং দেয়ালগুলো ছিল প্রায় পাঁচ ফুট প্রশস্ত। দেয়ালের উভয় দিকে ছিল অতিসুন্দর পোড়ামাটির চিত্রফলক, মসজিদের চারকোণায় রয়েছে চারটি গোলাকার মিনার। মিনারগুলো মেঝের সমান্তরাল থেকে ভূমির দিকে কয়েকটি স্তরে ক্রমেই মোটা। দীর্ঘ দিনের অযতœ ও মেরামতের অভাবে মসজিদটি গম্বুজের বেশির ভাগ ও উত্তর-পূর্ব দক্ষিণ দেয়ালের উপরাংশ বিলুপ্ত হয়ে যায়। সম্ভবত এ কারণে মসজিদটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
জানা গেছে, আশির দশকে প্রতœতত্ত্ব বিভাগ এ শাহী মসজিদটিকে প্রতœতত্ত্বের আওতাভুক্ত করে এটি সংরণের ব্যবস্থা করে। সেই সময় প্রতœতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটির ব্যাপক সংস্কার করে। এতে ফুল, লতাপাতা নকশাসংবলিত পোড়ামাটির ফলক স্থাপন করা হয়। এখন মসজিদটির প্রকৃত রূপ অনেকটাই বদলে গেছে। মসজিদের গায়ে যেসব মূল্যবান কারুকাজখচিত পাথরের ফলক ছিল সেগুলো প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের আওতাভুক্তির আগেই চুরি হয়ে গেছে। বর্তমানে মসজিদটি প্রতœতত্ত্ব বিভাগের রণাবেণে রয়েছে। সোনারগাঁওয়ের গোয়ালদী শাহী মসজিদটি বর্তমানে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান। গোয়ালদী শাহী মসজিদটি তৎকালীন সুলতানি আমল তথা সেই সময়ের গৌরবোজ্জ্বল মুসলিম ঐতিহ্যের অন্যতম সাী হয়ে আছে।
এ মসজিদসংলগ্ন উত্তর দিকে আরো একটি মসজিদ রয়েছে। এটিও এক গম্বুজবিশিষ্ট। মসজিদটির গাত্রে বিদ্যমান শিলালিপি থেকে জানা যায় যে, ওই মসজিদটি আবদুল হামিদ হিজরি ১১১৬ ও ১৭০৫ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করেন। তখন থেকেই ফের ওই মসজিদে স্থানীয়রা নামাজ আদায় করে আসছেন। এ মসজিদটি দেখতে হোসেন শাহী মসজিদের মতোই। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মসজিদটির আয়তনও বৃদ্ধি করা হয়। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহী মসজিদটি বাংলাদেশ সরকারের প্রতœতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে নেয়া হলে বর্তমানেও সংস্কারের অভাবে কারুকার্য ও ইটগুলো খসে পড়ছে। কিন্তু ভাঙনের এ নির্মম প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ইতিহাসের এই সোনালি অধ্যায় হারিয়ে যেতে সময় নেবে না খুব বেশি।


আরো সংবাদ



premium cement
পাঁচবিবিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে এক ব্যক্তির মৃত্যু স্পেশাল অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ, প্রশংসিত দেওয়ানগঞ্জের রবিন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আরো ৭ দিন বন্ধ ঘোষণা থাই-মিয়ানমার সীমান্ত শহরের কাছে আবারো সংঘর্ষ শুরু : থাই সেনাবাহিনী পাঁচবিবিতে মোটরসাইকেল ও ট্রাক্টরের মুখোমুখি সংঘর্ষ, নিহত ১ তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি ছাড়াল চুয়াডাঙ্গায় ১৪০তম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলো বার্বাডোস সরকার চোরাবালির ওপর দাঁড়িয়ে আছে : রিজভী কুষ্টিয়ায় অস্ত্রসহ যুবলীগ নেতা আটক পাকিস্তানে একসাথে ৬ শিশুর জন্ম, সবাই সুস্থ ৪০ বছর ধরে মুসল্লিদের ফ্রি চা খাওয়ানো মদিনার সেই বৃদ্ধের ইন্তেকাল

সকল