২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

খেলাপি ঋণে শঙ্কিত ব্যাংক খাত

বড় বড় ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে সাড়া পাচ্ছে না ব্যাংক ; ৩০০ কোটি টাকা ডাউন পেমেন্টে ২০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নিয়মিতকরণ
-

ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট নীতিমালার আওতায় এখন পর্যন্ত সরকারি ৫ ব্যাংক ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৮৩৫টি আবেদন পেয়েছে। এদের কাছে পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ রয়েছে ১৯ হাজার ৩৬৮ কোটি ৬৬ লাখ। খেলাপি ঋণের মাত্র ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট দিয়ে তারা খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ পাচ্ছেন। এতে তাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলো ডাউন পেমেন্ট পেয়েছে মাত্র ৩০০ কোটি টাকা। তবে এই সব ব্যাংক বড় কোনো ঋণখেলাপির কাছ থেকে ঋণ পুনঃতফসিলের আবেদন পায়নি। এর ফলে এক দিকে খেলাপি ঋণের বিপুল অঙ্ক নিয়মিত হয়ে যাওয়ার পর এই ঋণ আদায়ের সম্ভাবনা থাকছে না সেভাবে। অন্য দিকে বড় খেলাপিরা সে সুযোগও গ্রহণ না করে ভিন্ন কোনো পথে এগোতে চাইছে বলে মনে করা হচ্ছে। সৃষ্ট খেলাপি ঋণ পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতে অকার্যকর তহবিলের পাহাড় সৃষ্টি হচ্ছে আর একই সাথে নতুন করে বিনিয়োগের সক্ষমতা হারাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর ফলে খেলাপি ঋণ নিয়েই ব্যাংক খাতে এক বড় ধরনের অচলাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ। এটা কমাতে না পারলে অর্থনীতি টেকসই হবে না। অর্থমন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে এসব কথা জানা গেছে।
সরকারি ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্য মতে, সরকারি ৫ ব্যাংকের মধ্যে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিটে টাকার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছে জনতা ব্যাংক। ব্যাংকটিতে ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য ৫৮৪টি আবেদন পড়েছে। এককালীন এক্সিটের জন্য ২৪৭টি আবেদন পড়েছে। সর্বমোট ৮৩১টি আবেদনে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১১ হাজার ৪৩৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। আদায়কৃত ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ ১৬৩ কোটি ৭২ লাখ টাকা।
প্রসঙ্গত, সরকারি হিসাবে বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) হিসাব কষে দেখিয়েছে, বর্তমানে এই খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ লাখ ৪০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা; যা মোট বিতরণকৃত ঋণের প্রায় ২৬ শতাংশ। বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ৯ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
আইএমএফ খেলাপি ঋণের যে হিসাব দেখিয়েছে তার মধ্যে আদালতের স্থগিতাদেশ, পুনঃতফসিল এবং বিশেষ অ্যাকাউন্টের ঋণও রয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে এ রিপোর্টটি হস্তান্তর করে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল। এতে দেশের ব্যাংকিং খাতের সংস্কারে ৪৩টি সুপারিশ করা হয়েছে। এ দিকে নানা ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সত্ত্বেও সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিস্থিতি উন্নতি করা যাচ্ছে না। ফলে গত এক বছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ছয়টি (সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ও বিডিবিএল) বাণিজ্যিক ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৩ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে পুঞ্জীভূত মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫৪ হাজার ৪২ কোটি টাকা। এটি ব্যাংক খাতের সার্বিক খেলাপি ঋণের প্রায় অর্ধেক। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা।
গত এক বছরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। আলোচ্য সময়ে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অগ্রণী, বেসিক ও বিডিবিএল ব্যাংকেরও খেলাপি ঋণ বেড়েছে। অন্যান্যের মধ্যে রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কিছুটা কমেছে, আর খুব সামান্য কমেছে সোনালীর।
ব্যাংকগুলোর নিজস্ব হিসাব মতে, চলতি বছরের জুন শেষে সোনালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা (বিতরণকৃত ঋণের ২৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ)। গত বছর (২০১৮ সাল) জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ১২ হাজার ৪৭৫ কোটি টাকা (৩৩ দশমিক ২৭ শতাংশ)।
একইভাবে জুন শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ২১ হাজার ৪১০ কোটি টাকা (বিতরণকৃত ঋণের ৪০ শতাংশ)। গত বছর জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার কোটি টাকা (১৫ শতাংশ)।
একই সময়ে অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ৬ হাজার ১৪৭ কোটি টাকা (বিতরণকৃত ঋণের ১৭ শতাংশ)। গত বছর জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা (১৭ শতাংশ)।
রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ৪ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা (বিতরণকৃত ঋণের ১৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ)। গত বছর জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ৯১৬ কোটি টাকা (২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ)।
আলোচ্য সময়ে দুর্নীতিগ্রস্ত বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি ৮ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকা (বিতরণকৃত ঋণের ৫৭ দশমিক ৪১ শতাংশ)। গত বছর জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ হাজার ৪৪৩ কোটি টাকা (৫৬ দশমিক ৪৩ শতাংশ)।
বিডিবিএল ব্যাংকের খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়াবে ৯০১ কোটি টাকা (বিতরণকৃত ঋণের ৪৬ শতাংশ)। গত বছর জুন শেষে ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮০৫ কোটি টাকা (৫৪ শতাংশ)। বর্তমানে এই সব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
জনতা ব্যাংকের উল্লেখযোগ্য ঋণখেলাপিরা চট্টগ্রাম এলাকার লোক। কিন্তু তাদের কাছে থেকে ঋণ পুনঃতফসিলের তেমন কোনো আবেদন পাওয়া যায়নি বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আমাদের খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশ রয়েছে চট্টগ্রামে। আমরা আশা করেছিলাম সরকারের বিশেষ পুনঃতফসিল সুবিধা গ্রহণে চট্টগ্রামের খেলাপি ঋণ ব্যবসায়ী ও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসবে কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা তেমন কোনো সাড়া দেননি। কিন্তু আমরা আশা ছাড়িনি, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তাদের কাছ থেকে খেলাপি ঋণ আদায়ের।
শুধু চট্টগ্রামের ঋণখেলাপিরাই নয়; নতুন নীতিমালা সুযোগ কাজে লাগায়নি জনতা ব্যাংকের শীর্ষ ঋণখেলাপি ক্রিসেন্ট গ্রুপ এবং অ্যানন টেক্স। এই দুই গ্রুপের কাছে জনতা ব্যাংকের পাওনা প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ‘অ্যানন টেক্স’-এর কাছে পাওনা ৪ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা এবং ‘ক্রিসেন্ট গ্রুপ’-এর কাছে পাওনা ৩ হাজার ৫৭২ কোটি টাকা।
এ দিকে রাষ্ট্রমালিকানাধীন সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালী ব্যাংকে ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিটের আবেদন পড়েছে সবচেয়ে বেশি। ঋণ পুনঃতফসিলের জন্য আবেদন পড়েছে ৯৬৮টি। আর এককালীন এক্সিটের আবেদন পড়েছে ৬৫০টি। সর্বমোট ১ হাজার ৬১৮টি আবেদনে জড়িত খেলাপি ঋণের টাকার পরিমাণ ২ হাজার ৯২১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। আদায়কৃত ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ ৭৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে নিষ্পত্তিকৃত প্রস্তাব ১২৫টি। এর সাথে জড়িত অর্থের পরিমাণ ২৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা।
তৃতীয় স্থানে রয়েছে, বহুল আলোচিত দুর্নীতিগ্রস্ত বেসিক ব্যাংক। এই ব্যাংকটি ঋণ পুনঃতফসিলে ৪১১টি এবং এককালীন এক্সিটের ৪৯টি আবেদন পেয়েছে। সর্বমোট ৪৬০টি আবেদনের বিপরীতে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা। আদায়কৃত ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ ২৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে নিষ্পত্তিকৃত প্রস্তাবের সংখ্যা ৩২৪টি। জড়িত অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ১১১ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
রূপালী ব্যাংকে পুনঃতফসিলের ২৬৪টি এবং এককালীন এক্সিটের ১৫৫টি আবেদন পড়েছে। সর্বমোট ৪১৯টি আবেদনে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৬৩ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। আদাকৃত ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ ১১ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
অগ্রণী ব্যাংকের পুনঃতফসিলের ৪০২টি এবং এককালীন এক্সিটের ১০৫টি আবেদন পড়েছে। সর্বমোট ৫০৭টি আবেদনে জড়িত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ১৫৬ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আদায়কৃত ডাউন পেমেন্টের পরিমাণ ২১ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। নিষ্পত্তিকৃত আবেদনের প্রস্তাবের পরিমাণ ১৪টি। এর সাথে জড়িত অর্থের পরিমাণ ২৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা।
উল্লেখ্য, ব্যাপক সমালোচনার মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগ থেকে গত ১৬ মে ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিট-সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা’ জারি করে ব্যাংকগুলোতে পাঠানো হয়।
এ নীতিমালায় ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্টে ৯ শতাংশ সুদে ১০ বছরে খেলাপি ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেয়া হয়। কেস-টু-কেস বিবেচনায় ঋণ পরিশোধের জন্য এক বছরের জন্য গ্রেস পিরিয়ডও পাওয়া যাবে। অর্থাৎ প্রথম এক বছরে ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না খেলাপিদের। মওকুফ হবে অনারোপিত সুদের সম্পূর্ণ অংশ ও ইন্টারেস্ট সাসপেন্সেস হিসাবে রক্ষিত সুদও।একই সাথে খেলাপি ঋণের অনারোপিত সুদ মওকুফ সুবিধার পাশাপাশি খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যাংকের দায়ের করা মামলাও স্থগিত রাখার কথা বলা হয়। ওই নীতিমালা অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি সুবিধা দেয়া হয় ট্রেডিং (গম, খাদ্যদ্রব্য, ভোজ্যতেল ও রিফাইনারি), জাহাজশিল্প, লোহা ও ইস্পাত শিল্প খাতের ঋণখেলাপিরা। এসব খাতের খেলাপি গ্রাহকরা সরাসরি ঋণ পুনঃতফসিলের সুযোগ পাবেন। অন্য খাতের ঋণখেলাপিদের পুনঃতফসিলের সুবিধা পেতে হলে উত্তীর্ণ হতে হবে ব্যাংকের বিশেষ নিরীক্ষায়।
ঋণ স্থিতির (মওকুফ অবশিষ্ট) ওপর কস্ট অব ফান্ডের সাথে অতিরিক্ত ৩ শতাংশ সুদ যুক্ত করা যাবে। তবে ঋণের সুদহার সীমাবদ্ধ রাখতে হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশে। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দ মানের ঋণখেলাপিরা বিশেষ এ সুবিধা দেয়া হয়। পুনঃতফসিলের পর ঋণখেলাপিরা নিতে পারবেন নতুন ঋণও। এসব সুযোগ-সুবিধা পেতে সার্কুলার জারির দিন থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে আবেদন করতে হবে বলে নির্দেশনা দেয়া হয়।

 


আরো সংবাদ



premium cement