১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চর উন্নয়নে ৫৩ জন যাবেন বিদেশ ট্যুরে প্রকল্প ব্যয়ের ১৩.৩৪ শতাংশই বিদেশ সফর; রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় বললেন অর্থনীতিবিদেরা

-

পুকুর খননের পর এবার চর উন্নয়ন দেখতে বিদেশ সফরে যাবেন ৫৩ জন সরকারি কর্মকর্তা। নদীমাতৃক ও বরেন্দ্র ভূমির দেশে চর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে চর ও চরাঞ্চলের মানুষের উন্নয়নে বিদেশে স্ট্যাডি ট্যুর করতে যাবেন প্রায় সাড়ে চার ডজন কর্মকর্তা। প্রায় ১৫ কোটি টাকার প্রকল্পে তাদের জন্য দুই কোটি টাকা বা ১৩.৩৪ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। স্ট্যাডি ট্যুরের নামে রাষ্ট্রীয় অর্থ এবং বিদেশী ঋণের টাকায় কর্মকর্তাদের এই প্রমোদভ্রমণ। প্রয়োজন না থাকলেও দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে বিদেশ সফর বা স্ট্যাডি ট্যুর খাতটি অত্যাবশ্যক খাতে পরিণত হয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের ইতিবাচক সাড়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে কার্যপত্রে। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এটা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় ছাড়া কিছুই নয়। এসব বন্ধ করা উচিত।
পরিকল্পনা কমিশন ও ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চর ডেভেলমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট প্রজেক্টের মাধ্যমে উপকূলীয় চরাঞ্চলের ছয় হাজার ভূমিহীন জনগোষ্ঠীকে খাস জমি বন্দোবস্ত দেয়া এবং নতুন উপকূলীয় চরাঞ্চলে বসবাসরত জনগণের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য হ্রাস করার একটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তিন বছরের এই প্রকল্পে ৭ কোটি ৮৭ লাখ ৭১ হাজার টাকা দেবে ইফাদ। বাকি ৭ কোটি ১১ লাখ ২১ হাজার টাকা বাংলাদেশ সরকারের। নোয়াখালীর সুবর্ণচর ও কোম্পানিগঞ্জ এবং চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রকল্পের মাধ্যমে উপকূলীয় অধিবাসীদের নিরাপদ বসতি স্থাপন ও তাদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করা।
পরিকল্পনা কমিশনের পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, এই প্রকল্পের আওতায় ৫৩ জনের বৈদেশিক স্ট্যাডি ট্যুর রাখা হয়েছে। আর এই ট্যুর বাবদ দুই কোটি টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিলের এক কোটি এবং বৈদেশিক সহায়তা এক কোটি টাকা। কিন্তু এখানে কোন দেশ, কাদের, কোথায় ও কী ধরনের স্ট্যাডি ট্যুর হবে তা প্রকল্প প্রস্তাবনায় বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি প্রকল্পের আওতায় ১২ জনের চার্জ অ্যালাউন্স বাবদ সরকারি খাত থেকে ৭৪ লাখ টাকার সংস্থান রাখা হয়েছে। জিওবি খাতে এই ব্যয় বাদ দিতে হবে। তবে একান্ত প্রয়োজনে এটা প্রকল্প সাহায্য খাত থেকে করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণ খাতে জিওবি অংশ থেকে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। এখানেও কোনো বিস্তারিত কোনো বিবরণ উল্লেখ করা হয়নি। এটা পাঁচ লাখ টাকা করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের সেচ উইং। এই প্রকল্পের জন্য এক কোটি টাকা ব্যয়ে একটি জিপ কেনার প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ব্যয় যৌক্তিক করার জন্য বলা হয়েছে।
এ ব্যাপারে কার্যপত্রে সেচ উইংয়ের অভিমতে বিদেশ ট্যুরে ইতিবাচক সাড়া দেখা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, প্রকল্পটি ছোট ও বৈদেশিক সহায়তায় বাস্তবায়িত হবে বিধায় বৈদেশিক স্ট্যাডি ট্যুর বাবদ প্রকল্পসাহায্য থেকে এক কোটি টাকার সংস্থান রাখা যেতে পারে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত স্ট্যাডি ট্যুরে আইএমইডি, ইআরডি, কার্যক্রম বিভাগ, একনেক অণুবিভাগ ও পরিকল্পনা কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা সংস্থার প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করে ব্যাচ পুনর্গঠন করা যেতে পারে।
প্রকল্পের প্রেক্ষাপটে জানা গেছে, নেদারল্যান্ড সরকারের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় ১৯৮০ সাল থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার প্রকল্পের মাধ্যমে সমুদ্র থেকে ভূমি পুনরুদ্ধার ও চর উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। পরে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল, বিশেষত নোয়াখালীতে চর উন্নয়ন ও বসতি স্থাপন প্রকল্প-১, ২, ৩, ও ৪ এর মাধ্যমে ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ব্যাপক চর উন্নয়ন এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভূমি বন্দোবস্তের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। ইতোমধ্যে এ প্রকল্পগুলোর মাধ্যমে ২৫ বছরে সমুদ্র থেকে জেগে ওঠা ৪৫ হাজার একর জমির সার্বিক উন্নয়ন সাধন করে ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত ৩৫ হাজার ভূমিহীন পরিবারকে কৃষি খাসজমি বন্দোবস্ত প্রদান করে পুনর্বাসন করা হয়েছে। প্রস্তাবিত প্রকল্পের জন্য ২০১৭ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করা হয় ইফাদ ও নেদারল্যান্ড সরকারের পক্ষ থেকে। সেই সমীক্ষার আলোকেই এই প্রকল্প।
অন্যতম বাস্তবায়নকারী সংস্থা নোয়াখালী জেলা প্রশাসক তন্ময় দাসের কাছে ৫৩ জনের বিদেশ সফরের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে জানান, প্রকল্পটি এখনো পাস হয়নি। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এখানে প্রায় ১৮টি কম্পোনেন্ট আছে। ফলে বিস্তারিতভাবে আমি কিছুই বলতে পারব না। তবে প্রকল্প পরিচালকের সাথে আলাপ করলে বিস্তারিত জানা যাবে।
কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) মো: জাকির হোসেন আকন্দের কাছে গতকাল বিষয়টি জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের জনশক্তির দক্ষতাকে শক্তিশালী করার জন্য যেসব প্রকল্প হাতে নেয়া হয় তাতে বিদেশে স্ট্যাডি ট্যুরের প্রয়োজন আছে। এর মধ্যে প্রাণিসম্পদ, পানিসম্পদসহ বেশি কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে জনবলকে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন করতে সেটা করা হয়। কিন্তু প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের চর উন্নয়ন প্রকল্পের বিষয়টিতে ৫৩ জনের বিদেশ ট্যুরের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা দেখতে হবে।
সম্প্রতি পুকুর খনন প্রকল্পে বিদেশে প্রশিক্ষণ প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছিলেন, হয়তো বিদেশে যাবে প্রকৃতি দেখবে। অভিজ্ঞতা নেবে। কিছুটা বিনোদনও বটে। তবে আমি খোঁজ নেব কী ঘটনা।
বিদেশ ট্যুরের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, নদী বা সমুদ্র যেখানে থাকে বা আছে সেখানে চর থাকবেই। কিন্তু চর থাকলেই সেখানে দরিদ্র মানুষ থাকবে সেটা ঠিক না। চর ও চরের মানুষের উন্নয়নের জন্য বিদেশে স্ট্যাডি ট্যুর করতে হবে এটা হাস্যকর। একজন শিশুও বলতে পারবে এটার প্রয়োজন আছে কি না। তিনি বলেন, কারিগরি প্রকল্পের জন্য কারিগরি জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনে যারা সেই বিষয়ে অভিজ্ঞ তাদের নিকট থেকে অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশে স্ট্যাডি ট্যুরের প্রয়োজন আছে। কিন্তু চর উন্নয়ন প্রকল্পে কেন ৫৩ জনের বিদেশ ট্যুর? তিনি বলেন, এটা রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়ের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের প্রমোদভ্রমণ ছাড়া কিছুই নয়। প্রকল্পে এ ধরনের অপচয় বন্ধ করা উচিত। তা ছাড়া পরিকল্পনা কমিশন যদি মূল্যায়নের সময় তাদের স্টাডি ট্যুরে অন্তর্ভুক্ত করতে বলে এটাতো এক ধরনের ভাগাভাগি হয়ে যায়। এটা প্ল্যানিং কমিশনের কাজ নয়।


আরো সংবাদ



premium cement