১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৩ বৈশাখ ১৪৩১, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
বৈশ্বিক বায়ুদূষণ প্রতিবেদন

ক্ষতিগ্রস্ত শীর্ষ ৫টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ

বায়ুদূষণে গড় আয়ু কমে, বাড়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি; বাংলাদেশের বায়ুর মান নির্ধারিত মাত্রার অনেক নিচে; ২০১৭ সালে দেশে মারা গেছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ
-

বায়ুদূষণের কারণে বিশ্বে প্রতি বছর প্রায় ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বায়ুদূষণে যে ১০টি দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে তার মধ্যে রয়েছে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, নাইজেরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। ২০১৭ সালে বায়ুদূষণে বাংলাদেশে মারা গেছে ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ। বায়ুদূষণের ঝুঁকিবিষয়ক একটি আন্তর্জাতিক গবেষণায় ও বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর বাসিন্দাদের ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ কোনো না কোনোভাবে বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করছেন।
বৈশ্বিক বায়ুদূষণের ঝুঁকির ওপর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক দু’টি প্রতিষ্ঠান হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচ ই আই) ও ইনস্টিটিউট অব হেলথ ম্যাট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুয়েশন (আই এইচ এম ই) যৌথভাবে ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। গত বুধবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু কমা এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, বিশ্বে টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগ বৃদ্ধির তৃতীয় বড় কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। বায়ুতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণা পিএম-২.৫ ও পিএম-১০-এর পরিমাণ মেপে বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়েছে। বাতাসে পিএম-২.৫-এর পরিমাণের দিক থেকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলো দক্ষিণ এশিয়ার। এসব দেশের মধ্যে আছে নেপাল, ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার। সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানের কারণে মৃত্যুর হারের তুলনায় ২০১৭ সালে বায়ুদূষণের ফলে বেশি মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে বর্তমান সময়ে জন্ম নেয়া শিশুদের গড় আয়ু ২০ মাস কমবে। বাংলাদেশের বায়ুর মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের অনেক নিচে। সংস্থাটির বেঁধে দেয়া সময়সীমার মধ্যে বায়ুর মান ধরে রাখতে পারলে যে সব দেশ বেশি লাভবান হবে, তার মধ্যে সবার ওপরে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু তখন বাড়বে ১ দশমিক ৩ বছর। আর ভারত, পাকিস্তান ও নাইজেরিয়ায় গড় আয়ু বাড়বে এক বছর করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে বায়ুদূষণের কারণে হৃদ?রোগ, শ্বাসকষ্টজনিত জটিল সমস্যা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও ক্যান্সারের মতো রোগবালাই ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষত শিশু ও গর্ভবতী নারীরা বায়ুদূষণের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে। ইটভাটা, অবকাঠামো নির্মাণ ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া ধোঁয়া ও ধুলার কারণে ওই দূষণ ঘটছে।
যেসব কারণে বাংলাদেশে বায়ুদূষণ এত বেশি : বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম। তিনি বলেছেন, গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের দেশ হওয়ায় শীতের সময় হিমালয়ের পরের সব দূষণ এ দিকে চলে আসে। এর সঙ্গে যোগ হয় আমাদের নিজেদের অনেক দূষণ। দূষণ রোধে কর্তৃপক্ষের জোরালো পদক্ষেপের অভাবে বায়ুদূষণের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে আসছে না বলে তিনি মনে করেন। তার মতে, অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা, ঢাকার মতো বড় শহরের চার পাশে ইটভাটা, শহরের মধ্যে নানা কারখানা স্থাপন বায়ুদূষণের একটি কারণ।
‘সেই সঙ্গে শহরের প্রচুর ধুলা এবং নির্মাণকাজে বায়ুদূষণ হচ্ছে। ট্রাফিক জ্যামের কারণে গাড়িগুলো রাস্তায় অতিরিক্ত সময় ধরে চলায় সেগুলো অতিরিক্ত জ্বালানি খরচ করছে। এসবও বায়ুদূষণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।’
তিনি বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে পরিবেশ অতিরিক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে, সেই গরম ঠা া করার জন্য মানুষ অতিরিক্ত এসি ব্যবহার করছে, আবার তাতে বায়ুদূষণ আরো বাড়ছে।
বায়ুদূষণ কিভাবে কমানো যেতে পারে?
ড. আবদুস সালাম বলেন, দূষণ কমাতে প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ব্যবস্থা রয়েছে। প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাগুলো হলো রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণ বা ময়লাগুলো পুড়িয়ে ফেলার মতো নানা ব্যবস্থা, পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা, কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া, ট্রাফিক জ্যামের সমাধান, উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা ও এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করা। অপ্রত্যক্ষ ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে, এ জন্য প্রচুর বনায়ন করা, বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে, নির্মাণ কাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে করা যাতে সেটি দূষণের কারণ না হয়।
বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয়জন দূষিত বায়ু গ্রহণ করে। পৃথিবীর ৯১ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করে যেখানে বায়ুদূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি। পৃথিবীর যে ২০টি শহরে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে ভারতে আছে ১৪টি শহর। দেশটির উত্তরাঞ্চলের কানপুর শহর এ তালিকায় সবার উপরে। গবেষকেরা বলছেন, যেসব বয়স্ক মানুষের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কম তারা সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের ঝুঁকিতে আছেন। কারণ তারা প্রায়ই ঘরের বাইরে নানা ধরনের কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকেন।
দূষিত বাতাসের কারণে যেসব রোগ হতে পারে : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণার পরিমাণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া সীমার দশগুণের বেশি। সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দীর্ঘ দিন দূষিত বাতাসের মধ্যে থাকলে যেসব রোগ হতে পারে, তার মধ্যে আছে- হৃদরোগ, কাশি, নিউমোনিয়াসহ ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদি রোগ ফুসফুসের সংক্রমণ, ফুসফুসের ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্ট জনিত নানা রোগ, স্ট্রোক, চোখে ছানি পড়া ইত্যাদি।
শিশু ও গর্ভবতী নারীদের সমস্যা : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় বায়ুদূষণের মধ্যে থাকে তাহলে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে পরবর্তী প্রজন্মের ওপর। বায়ুদূষণের সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা।
বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে পাঁচ উপায়ে উপকৃত হবে বাংলাদেশ : ১. গড় আয়ু বাড়বে। স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার বলছে, বায়ুদূষণ রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়বে এক বছর তিন মাসের বেশি।
২. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা : অধ্যাপক আবদুস সালাম বলছেন, বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে সবচেয়ে বড় যে উপকার হবে সেটি হলো ‘জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায়ু সহায়তা’। বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রকোপ রোধে বায়ুদূষণ রোধ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
৩. রোগ সংক্রমণ থেকে রক্ষা : বায়ুদূষণের জন্য মানুষের শরীরে যেসব রোগের সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে, সেগুলো থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে যদি দূষণ রোধ করা যায়। ড. সালাম বলেন, বায়ুদূষণ কমলে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যাও অনেক কমে যাবে। ফুসফুসের সমস্যা, হৃদরোগ, চর্মরোগসহ অনেক রোগ কমে যাবে।
৪. প্রতিবন্ধী সমস্যা : প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেয়ার সংখ্যা যেমন কমে যাবে, তেমনি শিশু ও মানুষের গড় আয়ুও বাড়বে। অধ্যাপক আবদুস সালাম বলেন, একটি প্রজন্ম যদি দীর্ঘসময় ধরে বায়ুদূষণের ভেতর দিয়ে যায় তাহলে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম অনেক ক্ষতির মুখোমুখি হবে। সেটা কাটিয়ে ওঠা যাবে দূষণ রোধ করতে পারলে।
৫. অর্থনৈতিক সুবিধা : বায়ুুদূষণ কমানো গেলে একদিকে যেমন মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বেড়ে যাবে জিডিপিও। ড. সালাম বলছেন, নিজেদের আর্থিক সাশ্রয় যেমন হবে, তেমনি জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটবে। বাংলাদেশের শহরগুলোতে যানজটের কারণে বায়ুুদূষণ বাড়ছে বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।


আরো সংবাদ



premium cement