২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বীর নরসিংদীর মিয়া চাঁনের স্বীকৃতি চায় পরিবার

-

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮)। এ যুদ্ধ শুরু হয় ২৮ জুলাই ১৯১৪ সাল। শেষ হয় ১১ নভেম্বর ১৯১৮ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ব্রিটিশের হয়ে যুদ্ধে অংশ নেন সাহসী ব্যক্তিরা। তাদের একজন হচ্ছেন বর্তমান বাংলাদেশী বাঙালি মিয়া চাঁন।

তার স্মৃতি আজ অবহেলায় ও অযতেœ রয়েছে। ময়মনসিংহ জেলার ভালুকার আওলাতলী গ্রামে হবির বাড়ি ইউনিয়নের নির্জন পল্লীতে পড়ে আছে। তার সাহসিকতার গল্প নতুন প্রজন্ম জানেন না। এমনকি এলাকার বর্ষীয়ানরাই ছিঁটেফোটা জানেন। অথচ তার রয়েছে গৌরবের গল্প। তিনি সাধারণ সহজ সরল জীবন যাপন করে গেছেন বলে কেউ তুলে ধরেননি তার বিজয় গাথা। ব্রিটিশ সরকারের হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন মিয়া চাঁন। তিনি একমাত্র বাংলাদেশী। জন্মস্থান নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলার চন্দনপুর গ্রামে।
গত সোমবার ১১ নভেম্বর ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ১০১ বছর পূর্তি। মিয়া চাঁন যখন ব্রিটিশদের হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন তখন ভারত-পাকিস্তান বিভক্ত হয়নি। জন্ম হয়নি বাংলাদেশের। তিনি ইস্ট ইন্ডিয়ান হয়েই যুদ্ধে অংশ নিয়ে একজন সাহসী যোদ্ধার পরিচয় দেন। এই সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে যুদ্ধ শেষ স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তাকে ভূষিত করা হয় দুটি মেডেল দিয়ে। তৎকালীন সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়ার ছয়জন এই মেডেল পান। মিয়া চাঁন তাদের একজন ছিলেন।

মিয়া চাঁন একটি মেডেল পান ক্যাম্পিংয়ের জন্য। আরেকটি পান ভিক্টরি মেডেল। এছাড়া ওই সময় তিনি নানা পুরস্কার লাভ করেন।
ব্রিটিশদের হয়ে যুদ্ধ জয়ে স্বদেশ ছেড়ে বিদেশের মাটিতে স্থায়ী হয়ে বসবাসের সুযোগও পান। তবে তিনি ব্রিটিশের কাজ থেকে কোনো সহযোগিতা নেয়া ছাড়াই চলে আসেন নিজ গ্রামে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মিয়া চাঁন কোনো সহযোগিতা ছাড়াই কৃষি কাজ করে তার জীবিকা নির্বাহ করে গেছেন।
মিয়া চাঁন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে আসেন নিজের জন্মস্থান নরসিংদী জেলার মনোহরদী উপজেলায় চন্দনপুর গ্রামে। এখানে কিছু দিন থাকার পর ময়মনসিংহ জেলার ভালুকায় কিছু জমি কিনে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তিনি জীবনের শেষ দিনগুলো কাটান। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৬৮ সালে। জীবিত থাকাকালীন তিনি বাংলাদেশ সরকার ও ব্রিটিশ সরকারের কাছে থেকে কোনো সহযোগিতা নেননি বা পেতে তদবির করেননি। তিনি রেখে যান দুই ছেলে এক মেয়ে।

তার ছেলেমেয়েরাও বাংলাদেশ সরকার ও ব্রিটিশ সরকারের কাছে আবেদন করেননি কোনো সহযোগিতার জন্য। তবে তার ছেলেমেয়ের সন্তানরা বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবতে শুরু করছেন। তারা গর্ব অনুভব করছেন তাদের দাদা বা নানা একজন গর্বিত যোদ্ধা। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। বিজয়ী হয়েছেন। যোদ্ধার স্বীকৃতিও পেয়েছেন। তবে তারা মিয়া চাঁনের মূল্যায়ন চান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাহসী সৈনিক হিসেবে তার স্মৃতি সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকার ও ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতা চান।
তার ছেলের ঘরের নাতনি একজন কণ্ঠশিল্পী। নাম স্বপ্না পারুল। তিনি বলেন, মিয়া চাঁন ইস্ট ইন্ডিয়া হতে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন। বিশ্বের অনেক দেশ থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অনেক সৈনিক অংশ গ্রহণ করেছিল কিন্তু বিজয়ের মুকুট সবাই পরতে পারেননি। বাংলার মাটির এমন সন্তান যিনি বিজয় অর্জন করেছেন। তিনি আমার দাদা মিয়া চাঁন। স্বপ্না পারুল বলেন, আমি সব কিছু জানার পর এখন আমার দাদাকে নিয়ে গর্ববোধ করি। আমি মনে করি এ গর্ব অহংকার শুধু আমার নয়, সারা বাংলার মানুষের।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে মুক্তিযোদ্ধাসহ গুণী ব্যক্তিদের যেমন সম্মানিত করা হয় বা হচ্ছে তেমনি আমার দাদার কৃতিত্বকে সম্মানিত করা হোক আমরা তা চাই। তার স্মৃতি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হোক। চন্দনপুর গ্রামে পড়ে থাকা আমার দাদার স্মৃতি সংরক্ষণ করতে ব্রিটিশ সরকার এগিয়ে আসুক। যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে বাংলাদেশী একজন সাহসী যোদ্ধা রয়েছেন, যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন এবং বিজয়ীর বেশে ফিরেন। আমাদের সরকারও এটা করতে পারে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে পারে। আমরা ও চন্দনপুর গ্রামের মানুষ এই আবেদন করছি।
তার ছোট ছেলে নিজামউদ্দিনের মেয়ের ঘরের ছেলে আরিফুর রহমান পলাশও একই কথা বললেন। আমরা আজ গর্বিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আমার পরিবারের কেউ অংশ নিয়েছেন। আমরা তার মৃল্যায়ন চাই রাষ্ট্রীয়ভাবে।

চন্দনপুর গ্রামের বয়স্ক লোকজনদেরও একই কথা। তাদের কথা মিয়া চাঁন চন্দনপুরের বাসিন্দা হলেও তিনি শেষ জীবনটি কাটান ভালুকায়। ওখানে তার কবরটি অযতেœ পড়ে আছে। তারা আলাপকালে বলেন, আমরা চাই বাংলাদেশ এবং ব্রিটিশ সরকার প্রথম বিশ্বযুদ্ধসহ অন্যান্য যুদ্ধে শরিক হওয়া যোদ্ধাদের খবর রাখছেন। তাদের স্মৃতি ও গৌরব গাথা সংরক্ষণ করে জাতির সামনে তুলে ধরছেন। শুধু আমাদেরগ্রামের মিয়া চাঁনই অবহেলিত। অযতেœ পড়ে রয়েছে তার সমাধিস্থল। পারিবারিক উদ্যোগে তা ধরে রাখার চেষ্টা চলছে। এ কাজটা যেন ব্রিটিশ সরকার ও আমাদের সরকার করে।
ভালুকার কেউ কেউ বলেন, মিয়া চাঁন খুবই সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন ধারণ করেছেন। বিশ্বযুদ্ধের একজন যোদ্ধা হিসেবে কারো সাথে অহংকার নিয়ে চলেননি। আমরা চাই এমন একজন ভালো মানুষের কথা বাংলাদেশসহ ব্রিটিশের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে ব্রিটিশ ও বাংলাদেশ সরকার এগিয়ে আসুক।

মিয়া চাঁনের এক সহপাঠী বলেন, আমাদের বাংলাদেশে এমন একটা রতœ আছে, আমাদের দেশেরই অনেকে জানেন না। আমরা চাই সরকার বাংলাদেশের একমাত্র বিজয়ী প্রথম বিশ্বযোদ্ধার কৃতিত্বকে সম্মান জানাক। নতুন প্রজন্ম জানুক। তিনি বলেন, আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি আজকে ভারতে এই যোদ্ধাদের ছয়জনের নাম খোদাই করে লিখে রেখেছে। তাহলে আমরা কেন পারব না আন্তর্জাতিকভাবে আমাদের এই খ্যাতি তুলে ধরতে। আমরা আশা করি বর্তমান সরকার ও ব্রিটিশ সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিবে। বিজ্ঞপ্তি।


আরো সংবাদ



premium cement