২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

তেঁতুলিয়ার সমতল ভূমিতে গড়ে উঠছে সবুজ চা বাগান

তেঁতুলিয়ার সমতল ভূমির একটি চা বাগান :নয়া দিগন্ত - ছবি : নয়া দিগন্ত

পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় সমতল ভূমিতে গড়ে উঠছে নিত্যনতুন চা বাগান। ফলে শাকসবজিসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ কমছে।
দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় এক সময়ে অর্থকরী ফসল আখ, আনারস চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল। ১৯৯০ দশকের পর থেকে সমতল ভূমি খনন করে পাথর উত্তোলন শুরু হয়। এর আগে তেঁতুলিয়ার মহানন্দা নদী থেকে পাথর উত্তোলন করা হতো। তখন তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড় জেলার অর্থনীতি আখ, আনারস ও পাথর শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। বর্তমানে আখ ও আনারসের আবাদ কমেছে। এর পরিবর্তে সমতল ভূমিতে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে চা। সিলেট ও চট্টগ্রামের পর দেশের তৃতীয় চা অঞ্চল হিসেবে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলা স্থান দখল করে নিয়েছে।

জানা যায়, ১৯৯৭ সালে তেঁতুলিয়ায় প্রথম স্বল্প পরিসরে সমতলে চা আবাদ শুরু করে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড (টিটিসিএল)। পরে তেঁতুলিয়ায় বৃহৎ পরিসরে চাচাষ শুরু করে কাজী অ্যান্ড কাজী টি অ্যাস্টেট লিমিটেড। একপর্যায়ে বিকাশ বাংলাদেশ নামের একটি কোম্পানি ক্ষুদ্র চাচাষিদের বিনা সুদে চাচারা প্রদান করে। তখন থেকেই চা আবাদে সাধারণ চাষিদের আগ্রহ বাড়তে থাকে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় অফিসের তথ্য মতে, তেঁতুলিয়া, পঞ্চগড় সদর, আটোয়ারী, বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলাসহ গোটা জেলায় দুই হাজার ২৬৫ হেক্টর সমতল ভূমিতে চা চাষ হয়েছে। ২০১৭ সালে ৫৪ দশমিক ৪৬ লাখ কেজি চা উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি উপজেলার মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলা শীর্ষে। পঞ্চগড় অফিসের সমীক্ষা অনুয়ারী তেঁতুলিয়া ও পঞ্চগড়ে নিবন্ধনকৃত বড় চা বাগান (২০ একর জমির ওপরে নয়) এর সংখ্যা সাতটি এবং ঠাকুরগাঁওয়ে একটি। পঞ্চগড় অফিসের অধীনে নিবন্ধনকৃত চা চাষির সংখ্যা ৮১২ জন। এছাড়া ক্ষুদ্র চা চাষির সংখ্যা প্রায় চার হাজার।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের অধীনে পঞ্চগড় জেলায় ২১টি চা কারখানা রেজিস্ট্রেশন ও অনুমোদিত আছে। এর মধ্যে ১২টি কারখানা পুরোদমে কাজকর্ম শুরু করেছে। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁও জেলায় আরো একটি চা কারখানা অনুমোদন (প্রস্তাবিত) আছে। পঞ্চগড় জেলায় অনুমোদনকৃত কারখানাগুলোর মধ্যে তেঁতুলিয়া উপজেলায় টিটিসিএল টি ফ্যাক্টরি, গ্রিন কেয়ার অ্যাগ্রো লিমিটেড টি ফ্যাক্টরি, সাবিহা টি ফ্যাক্টরি, বাংলা টি ফ্যাক্টরি, ইমপেরিয়াল টি ফ্যাক্টরি এবং পঞ্চগড় সদর উপজেলায় নর্থ বেঙ্গল টি ফ্যাক্টরি, মৈত্রী টি ফ্যাক্টরি, করতোয়া টি ফ্যাক্টরি, কাজী অ্যান্ড কাজী টি ফ্যাক্টরি পুরোদমে চা প্রসেসিং শুরু করেছে। এ ছাড়া অন্যান্য চা কারখানাগুলোর নির্মাণকাজ চলমান।

এসব কারখানায় বৃহৎ ও ক্ষুদ্র চাচাষিরা প্রতি কেজি সবুজ চাপাতা ২৫ থেকে ৩০ টাকা হারে বিক্রি করে। বর্তমানে প্রস্তুতকৃত চা পাতার নিলাম মার্কেটে (অকসন মার্কেট) দাম বেশি থাকায় কারখানার উৎপাদন অব্যাহত রাখতে চাষিদের কাছে কোনো কোনো টি ফ্যাক্টরি ৩৫ থেকে ৩৮ টাকা পর্যন্ত সবুজ চাপাতা কিনছে। সবুজ চা পাতার দাম আকস্মিক বৃদ্ধিতে সাধারণ চাষিরা বসতবাড়ির আশপাশে বাঁশ ঝাড়, কাঠ গাছের বাগান, আমের বাগান ইত্যাদি উপরে ফেলে নতুন নতুন চা বাগান সৃজন করছেন। ফলে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় সাধারণ চাষিদের অন্যান্য ফসলের তুলনায় অর্থকারী ফসল চা আবাদের আগ্রহ রীতিমতো আলোচিত বিপ্লবে পরিণত হয়েছে। এরই সুযোগে চা চারা তৈরির নার্সারি মালিকেরা প্রতিটি চারা দ্বিগুণ থেকে তিন গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে। বর্তমানে পলিব্যাগে লাগানো ১২ ইঞ্চির প্রতিটি চা চারা ১২ থেকে ১৬ টাকা দরে বিক্রি করছে।

তেঁতুলিয়ায় চা আবাদ বাড়ার পাশাপাশি শিক্ষিত বেকার যুবক ও শ্রমজীবী মানুষের কর্মসংস্থান বেড়েছে। বাগানের সবুজ চাপাতা তোলার জন্য শ্রমিকেরা প্রতি কেজি তিন টাকা এবং নতুন বাগান সৃজনে জমিতে রোপণের জন্য প্রতিটি চারা দেড় টাকা থেকে দুই টাকা হারে ক্ষেতচুক্তি নিয়ে থাকে। এ ছাড়া অনেক অর্ধশিক্ষিত বেকার যুবক ক্ষুদ্র চাচাষিদের নিকট পাইকারি দরে কমিশনের ভিত্তিতে সবুজ চাপাতা কিনে টি ফ্যাক্টরির সাথে ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এ দিকে কাজী অ্যান্ড কাজী টি অ্যাস্টেট অর্গানিক পদ্ধতিতে চা উৎপাদনসহ বাজারজাত করছে। তেঁতুলিয়ার উৎপাদিত চা বহির্বিশ্বে রফতানি হচ্ছে।

তেঁতুলিয়ার মাগুরা গ্রামের ক্ষুদ্র চা চাষি আব্দুল লতিফ জানান, ২০১৬ সালে কলাবাগানে ভেঙে চার বিঘা জমিতে চা চাষের সাথে সাথী ফসল চাষ করেছি। এই বাগান সৃজনে প্রায় দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে। প্রতি ৪৫ দিনে (এক রাউন্ড) ওই জমি থেকে প্রায় দেড় লাখ টাকার চাপাতা বিক্রি করছি। প্রতি রাউন্ডে ৪০ হাজার টাকা খরচ বাদে তার ৯০ হাজার টাকা মুনাফা থাকে।

ক্ষুদ্র চাষি লতিফের মতে, চা আবাদ দীঘমেয়াদি ফসল হওয়ার কারণে প্রথম দিকে বাগান সৃজনে খরচ একটু বেশি হলেও বাগানের বয়স বাড়ার সাথে সাথে বাগানে পাতার ফলনও বাড়ে। চা বাগান করে পাঁচ সদস্যের পরিবারে তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ফিরেছে।

তেঁতুলিয়া চাচাষি কাজী মতিউর রহমান বলেন, ২০১৫ সালে আট বিঘা জমিতে পর্যায়ক্রমে চা বাগান সৃজন করেছি। বর্তমানে ওই বাগানে ফলনও ভালো পাচ্ছি। তবে মাঝে মাঝে ব্যক্তিমালিকানাধীন টি ফ্যাক্টরিগুলোর নিজস্ব নিয়মনীতি ও সিন্ডিকেটের কারণে কখনো জমির উৎপাদিত কাঁচা চাপাতা বিক্রিতে ন্যায্য দাম পাই না। যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চাচাষিদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে উত্তরণের পদক্ষেপ নেয়া হয়; তবে চাচাষিদের দুর্ভোগ লাঘব হবে।

তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান কাজী আনিছুর রহমান একজন বৃহৎ চাচাষি। এই বাগান মালিক জানান, তেঁতুলিয়ায় যে হারে চা আবাদ বাড়ছে সেই তুলনায় টি ফ্যাক্টরির সংখ্যা খুব কম। ফলে চাষিদের সবুজ চাপাতা বিক্রির ক্ষেত্রে মাঝে মধ্যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ছাড়া কারখানার মালিকেরা অকসন মার্কেটের সাথে কিছুটা মানের পার্থক্য দেখিয়ে মাঝে মধ্যে পাতা ক্রয়ে দরপতন করে থাকেন। তাই তেঁতুলিয়ার উৎপাদিত চা বিশ্ব বাজারের সাথে গুণগতমান ধরে রাখার জন্য বাগান মালিক ও চাষিদের আরো বেশি সচেতন হবে।

বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় অফিসের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালক ড. মোহাম্মদ শামীম আল মামুন বলেন, পঞ্চগড়ের পরে ঠাকুরগাঁওয়ে সমতল ভূমিতে ব্যাপকভাবে চা আবাদ শুরু হয়েছে। এখানকার বাগান মালিক ও চাচাষিরা ছোট ও বড় পরিসরে বাগান করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। একই সাথে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও জেলায় নতুনভাবে চা ফ্যাক্টরি গড়ে উঠছে। চা আবাদ প্রসারের বিষয়ে এ অঞ্চলের সমতল ভূমি ও জলবায়ু অনুকূল থাকায় সিলেট ও চট্টগ্রামের তুলনায় এখানকার চা বাগানগুলোর ফলন ভালো। ফলে পঞ্চগড়ের ও ঠাকুরগাঁওয়ের সমতলে উৎপাদিত সবুজ চা গুণে-মানে ইতোমধ্যে দেশে-বিদেশে সাড়া জাগিয়েছে। সেই সাথে উত্তরাঞ্চলের মানুষের দিনদিন অর্থনৈতিক জীবনমানের উন্নয়ন হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement