২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ক্যান্সার : সচেতনতাই সুস্থতা

-

গত ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিশ্ব কান্সার দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হয় ক্যান্সার দিবস। ক্যান্সারে অকাল মৃত্যুর সংখ্যা ২০৩০ সালের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘আমি আছি এবং আমি থাকব।’
লিখেছেন রহিমা আক্তার মৌ
‘আজ নাকি বিশ্ব ক্যান্সার দিবস! কি সৌভাগ্য আমার এই দিনটাও আমি উদযাপন করতে পারব! এই দিবস টা একান্ত আমার! এই ক্যান্সারের সুবাদে অনেক কিছু হারিয়েছি আবার অনেক কিছু পেয়েছি ! অনেক ুদ্রতাকে জয় করতে শিখেছি। শিখেছি নিজেকে অবদমন করতে, জেনেছি সব কিছু আমাকে চাইতে নেই, পেরেছি অনেক প্রিয় জিনিসের মায়া অনায়াসে ছেড়ে দিতে। নিজেকে নতুন করে চিনেছি। চিনেছি খুব কাছের মানুষ কে। পেয়েছি অনেকের করুণা শুনেছি আহারে! আবার পেয়েছি মানুষের হৃদয় উপচানো ভালোবাসা, প্রার্থনা। খুব কাছের মানুষের আমাকে হারানোর বেদনার কথা ভেবে মুক্তোদানার মতো চোখের পানি। সময় খুব মূল্যবান। প্রতিটি মানুষ কখনও না কখনও খারাপ সময়ের মুখোমুখি হয়। মানুষ তখন অনুধাবন করতে পারে নিজের অবস্থান। মানুষ বুঝতে পারে কতটা অলীকস্বপ্নে এবং মিথ্যে মায়ায় বেঁচেছিল। আমার মাথার চুলগুলো যখন সব পড়ে গিয়েছিল মাথাটা যখন আমার ছেলে ন্যাড়া করে দিলো তখন আমি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করেছি, হে ঈশ্বর এই দিনও আমার দেখার ছিল! তার আগে কেন আমার মৃত্যু হলো না! আমি ক্যান্সার মেনে নিয়েছিলাম কিন্তু ন্যাড়া মাথা মানতে পারছিলাম না! আমি জানি আর ঈশ্বর জানেন কিভাবে আমি এই দুঃসময় অতিক্রম করেছি প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে!
তাই কোনো সাধারণ মানুষ যখন আমাকে মামুলি দুঃখ দিতে চায় আমার কষ্টেও হাসি পায়! ধারণাই নাই আমি কত অনায়াসে এসব ইগনোর করতে পারি! জীবন আমাকে শিখিয়েছে শক্ত হতে পাথরের মতো করে!
তাই পাওয়া আর না পাওয়া আমাকে ছুঁয়ে যায় না! আমি নিজেই তো ছুঁয়েছি সেই অসীমকে! আমি শিখেছি ুদ্রতাকে জয় করতে, মানুষকে তার অজ্ঞানতার জন্য মা করতে! আমি সৌভাগ্যবতী আমি ক্যান্সার কে জয় করতে পেরেছি আমার অদম্য মনোবল ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস আর অগণিত মানুষের ভালোবাসায়! আমি আমার নতুন জীবন আর প্রতিদিন নতুন সকাল দেখার নতুন আশা নতুন করে বেঁচে থাকার জন্য দয়ালু ঈশ্বরের কাছে চিরঋণী! বিশ্বের প্রতিটি ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষকে ঈশ্বর তুমি সুস্থ করে দাও আজকের দিনে তোমার কাছে আমার আকুল আবেদন। যতই তুমি দুঃখ দাও সইবার মতাও তাকে দিও! তুমিই পার সব কিছু বদলে দিতে, মৃত প্রাণ জাগিয়ে তুলতে পার তুমুল আনন্দে!’
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ক্যান্সার দিবস। সেই দিন লেখক, শিল্পী শুভ্রা নীলাঞ্জনা নিজের টাইমলাইনে লিখেন নিজের লড়াইয়ের কথাগুলো, ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে জিতেছেন তিনি। কিন্তু সবাই কি জিততে পারে?
অনেক দিন পর দেখা রাইজা ভাবীর সাথে। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করায় জবাব আসে ভালো নেই। কিছু দিন যাবত গাইনি ডাক্তার দেখাচ্ছেন। ডাক্তার জরায়ু অপারেশন করতে বলেছেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি নন। কারণ জিজ্ঞেস করে জবাব পেয়ে আমি তো হা হয়ে যাই। তিনি শুনেছেন জরায়ু অপারেশন করলে অপারেশনের পর আগের মতো জীবনযাপন করতে পারে না। মেলামেশা করতে পারে না, যার কারণে স্বামীরা অসন্তুষ্ট হয়। চেষ্টা করেছি বুঝাতে, চেষ্টা করেছি আসল সত্যটা তাকে জানাতে যে এটা ভুল ধারণা। প্রতিটা মানুষের প্রথম অধিকার নিজে সুস্থ থাকা।
আমার বন্ধ রাসেল আহমেদ, ওর বউয়ের সাথেও ভালো যোগাযোগ আমার। এক দিন রাসেল কল করে জানায় ওর বউয়ের মন খারাপ। কেন জিজ্ঞেস করায় রাসেল জানায়, ডাক্তার দেখাচ্ছি কিছু সমস্যার জন্য। ডাক্তার বলেছে জরায়ু অপারেশন করতে হতে পারে। এতেই রাসেলের বউয়ের নানান চিন্তা। অপারেশন করলে এই হবে ওই হবে। আমি নিজেই কল করি রাসেলের বউকে। যা শুনলাম সব কথাই রাইজা ভাবির মতো। দুই সন্তান, সন্তানরাও বড় হয়েছে ছোটটার বয়স বারো বছর। কিছু কথা বলে বুঝালাম যে সবার আগে নিজের শরীরের দিকে ল রাখতে হবে।
ক্যান্সার হলো এক সমষ্টিগত রোগের একটি সাধারণ নাম, যেখানে শরীরের কিছু কোষ বিভিন্ন কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। অপরিশোধিত ক্যান্সার পার্শ্ববর্তী স্বাভাবিক কলার মধ্যে কিংবা শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এর ফলে সাংঘাতিক অসুস্থতা, প্রতিবন্ধকতা, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
‘ক্যান্সার সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এসব রোগীর মধ্যে ফুসফুস, মুখগহ্বর, রক্তনালী, জরায়ু ও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্তের সংখ্যাই বেশি। মহিলা রোগীদের মধ্যে শতকরা ৩০ ভাগ জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত। গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রতি বছর প্রায় ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। তাদের মধ্যে বহু মৃত্যুর ঘটনাই ঘটে রোগটিকে শুরুর দিকে শনাক্ত করতে না পারার কারণে।
(তথ্যসূত্র : ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯; দৈনিক যুগান্তর)
বিশ্বব্যাপী ক্যান্সার বাড়ছে। আগের তুলনায় বেশি মানুষ এই রোগে মারা যাচ্ছে। বিশ্বে প্রতি বছর ৯.৬ লাখ মানুষ ক্যান্সারের কারণে মারা যায়। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিউটের পরিসংখ্যান মতে, দেশে ক্যান্সার আক্রান্তদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ২০১৪ সালে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে চার হাজার ৫৭ জন, ২০১৫ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সাত হাজার ২৮৫ জনে, ২০১৬ সালে তা ১১ হাজার ও ২০১৭ সালে তা ২০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। আর ২০১৮ সালে সারা পৃথিবীতে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ৯৬ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, এর সঠিক প্রতিরোধের ব্যবস্থা না নিলে ২০৩০ সালের মধ্যে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে বছরে এক কোটি ৩০ লাখ মানুষ মারা যাবে। পৃথিবীতে যত সংখ্যক মানুষের ক্যান্সার হয়, তার মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ প্রতিরোধ করা সম। বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর কারণ হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ক্যান্সার। ৭১ শতাংশ ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুতে দায়ী থাকে তামাক, এমনকি ২২ শতাংশ অন্য ক্যান্সারেও আক্রান্তের সাথেও যুক্ত থাকে তামাক। পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি ফুসফুস, প্রস্টেট, কোলরেকটাল, পাকস্থলি, যকৃৎ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। নারীদের বেলায় যে তিন ধরনের ক্যান্সারের কথা বেশি শোনা যায়, সেগুলো হলো- জরায়ুর মুখে ক্যান্সার বা সার্ভিক্যাল ক্যান্সার, ডিম্বাশয়ের ক্যান্সার বা ওভারিয়ান ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সার।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. বেগম রোকেয়া আনোয়ার জানান, ‘বাংলাদেশের নারীরা জরায়ুমুখের ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারের কারণে বেশি মারা যাচ্ছে। অথচ উন্নত বিশ্বে এটি শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। কারণ এই রোগ পুরোপুরি প্রতিরোগযোগ্য। পূর্ব-লক্ষণ যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশেও বেশ কিছু পদ্ধতি রয়েছে এবং ভিআইএ নামে সহজ একটি পরীা জাতীয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। মেয়েরা যখন সুস্থ থাকে, তখন মনে করে আমি তো সুস্থ, কেন আমি ডাক্তারের কাছে যাবো? কিন্তু যে কোনো ক্যান্সারের পূর্ব-লণ নির্ণয় করতে হলে সুস্থ অবস্থাতেই তাকে হাসপাতালে আসতে হবে।’
আনন্দের খবর প্রতি বছর ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার সংখ্যাও বাড়ছে। কানাডার প্রিন্সেস মার্গারেট ক্যান্সার সেন্টারের গবেষকরা ক্যান্সার আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের নমুনায় জেনেটিক কোন পরিবর্তন হয়েছে কি না তা বের করার নতুন এক পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। এতে নির্দিষ্ট কোন জিন কাজ করছে কি না বা কোনটি হঠাৎ কাজ বন্ধ করেছে কি না, সেটি বোঝা যাবে। এর ফলে ক্যান্সার উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভবই হবে না কেবল, বরং সেটি কোন ধরনের ক্যান্সার তাও জানা যাবে।
(তথ্যসূত্র : বিবিসি নিউজ বাংলা ৬ এপ্রিল ২০১৯)
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ক্যান্সার ইপিডেমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা: হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন জানান, ক্যান্সার আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যেসব কারণে মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, সেগুলো বেশি বেশি করে প্রচার করলে সচেতনতা বাড়বে। কিন্তু দেশে সচেতনতার বিষয়ে কোনো পদপে নেই। এ খাতে বরাদ্দও নেই। ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে ৭০ থেকে ৮০ ভাগ রোগীর রেডিয়েশন থেরাপি দরকার। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১৫টি প্রতিষ্ঠানে ক্যান্সারের চিকিৎসা রেডিওথেরাপি দেয়া হচ্ছে। বছরে নতুন করে আক্রান্ত আড়াই লাখ মানুষের জন্য চিকিৎসা কেন্দ্রের এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। ফলে অর্ধেকের বেশি রোগী চিকিৎসাসেবার বাইরে থাকছে।’
শিায় কর্মেেত্র মতায় নারীরা অনেক এগিয়েছে ঠিক, কিন্তু কিছু গোঁড়ামি থেকে বের হতে পারেনি নারীরা। নিজেরাও চায় না আবার অনেক েেত্র পরিবারও বেরোতে দেয় না। আজো পাতিলের শেষ খাবার ঘরের মা এর পাতে যায়, আজো তাজা খাবার মায়ের পাতে যেতে দেরি হয়। সেই সময়ে নারীরা নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনছে। রোগ যেমন আছে, আছে চিকিৎসাও। সবার আগে নিজেকে সুস্থ রাখতে হবে এটাই ভুলে যায় নারীরা। ভেজাল খাবার, শস্য উৎপাদনে কীটনাশকের ব্যবহার, পরিবেশ দূষণ, ধূমপানসহ নানা কারণে মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। নারীরা হচ্ছে অসচেতন হয়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে ১২ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। প্রতি বছর দেশে প্রায় দুই লাখ মানুষ এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় এবং দেড় লাখ মানুষ মারা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, বিশ্বে প্রতি বছর ৮২ লাখ মানুষ ক্যান্সারে মৃতুবরণ করে। বিশেষ করে সাড়ে ১০ কোটি নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত। আর ক্যান্সারে আক্রান্তদের অধিকাংশই হচ্ছে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের নাগরিক।
লেখক : সাহিত্যিক কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক

 


আরো সংবাদ



premium cement