২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

আমার রতœগর্ভা মা

-

স্রষ্টার সৃষ্টির সব থেকে সেরা জিনিস হচ্ছে ‘মা’। সাধারণ রক্ত-মাংসের শরীরের মাতো কেবল একজন অসাধারণ মানুষই নন, তিনি একাধারে একটি প্রতিষ্ঠান, সংসারের সুদক্ষ পরিচালক, নিপুণ এক শিল্পীসত্তা, যে সত্তা তার সুদৃঢ়, অথচ সরল নেতৃত্বে ধারণ করে থাকেন পরিবারের অদৃশ্য বন্ধনগুলো। এ কথা হয়তো নির্দ্বিধায় বলা সম্ভব, স্রষ্টা মা সৃষ্টি না করলে পৃথিবী হতো নিষ্প্রাণ-নির্জীব। আমার স্বর্ণালি জীবনের মা স্নেহের যে মুঠোমুঠো রোদ্দুর ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই রোদ্দুর মেখেই আমার দৈনন্দিন জীবনের শুরু। জীবনে উত্থান-পতনের স্বাভাবিক নিয়মে দুঃখ, জ্বরা আসতেই পারে। তখন মায়ের কোমলতাই কাজ করে সব থেকে কার্যকরী প্রতিষেধক হিসেবে। আসলেই মায়ের সাথে সন্তানের মাধ্যাকর্ষণ শক্তির চেয়েও প্রচণ্ড শক্তিশালী নিবিড় প্রেমময় অনুভূতিক একটা অবিচ্ছিন্ন বন্ধন আছে। সন্তানের কষ্টে সে যন্ত্রণা পৌঁছে যায় মায়ের আত্মার দুয়ারে। মা নিজেই সন্তানের যন্ত্রণাভোগী হয়ে দূর করে দেন সন্তানের কষ্ট। আমার মমতাময়ী মা মুসলিমা সালামও ছিলেন সে রকমই একজন স্নেহময়ী জননী।
ছোট্টবেলায় খুব ভোরবেলা মা আমাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিতেনÑ ঘুম থেকে উঠে প্রথম আমরা আরবি পড়তাম, তারপর রেয়াজ করাতম। তা ছাড়া ভোরের আলো বাতাস শরীরের জন্য উপকারী। বাবা ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা; সুতরাং বছরান্তে এ জেলা থেকে সে জেলা শহর-বন্দরে বদলি হয়ে যেতে হতো। আমরা একটু বড় হতেই বাবা ঢাকায় বদলি হয়ে এসে আর তিনি প্রমোশন নিতেন না, যাতে তাকে ঢাকা ছাড়তে না হয়। আমাদের শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চায় কোনো ক্ষতি না হয়। আমার বাবা, মামা, খালা, চাচা, মা সবাই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। তাই আমাদের বাড়ির পরিবেশ ছিল ভীষণ আনন্দ উচ্ছ্বাসে ভরপুর। মা-বাবা দু’জনই ছিলেন লেখক। আমার মায়ের লেখা ‘বেগম’ পত্রিকার রস-রচনাগুলো ৫০-৬০ দশকের দিকে ছিল দারুণ জনপ্রিয়। মা ঘর গৃহস্থালির সব কাজকর্ম শেষ করেও ঘরে চালাতোন সাংস্কৃতিক চর্চা। আমার খালা নাজমা হক ছিলেন তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের একজন সফল উপস্থাপিকা। তিনি যখন আমাদের বাসায় বেড়াতে আসতেন, তখন খালা নাটক পরিচালনা করতেন তাতে অভিনয় করতাম আমরা সব ভাই বোন। কী যে মজার সেই দিনগুলো, তা ভুলে যাওয়া যায় না।
আমার বড় বোন আর ছোট তখন খুব ভালো গান করত। বাইরের বিভিন্ন সঙ্গীত প্রতিযোগিতাগুলো থেকে তারা প্রাইজও নিয়ে আসত। তা দেখে আমারও ইচ্ছে করত প্রাইজ পেতে কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি আমার ততটা মনোযোগ ছিল না। তাই মা বললেন, তুমি বরং গিটার বাজানো শিখো। এই গিটার দিয়েই তুনি উঠে আসবে সবার সামনে। ঠিক তাই। মা আমায় নিক্কন ললিতকলা একাডেমিতে ভর্তি করে দিলেন। আমার অন্য বোনদের সাথে সাথে আমারও যন্ত্রসঙ্গীত চর্চা চলতে থাকল। জীবনে অনেকটা সময় পার করে মনে হচ্ছে ভাগ্যিস ‘মা’ আমাকে নিজের একান্ত পৃথিবীতে আত্মতৃপ্তির নিজস্ব আইডেন্টির জন্য খুব চমৎকার জীবন উপভোগ করার উপায় বাতলে দিয়েছিলেন, তা না হলে এই অবসর সময়গুলো এমনি এমনি অলসভাবেই কেটে যেত। আমার গিটারের রূপালি তারের সুরের মূর্ছনায় প্রতিটি ধ্বনিতে ‘মা’-কে বড্ড বেশি অনুভব করি। মা যেন স্বর্গের সুধা নিয়ে জীবনে আমার আবির্ভূত হয়েছিলেন। মাকে প্রতিদিন প্রতিটি মুহূর্তে যেন নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে মনের গহিনে লালন করে আসছি। আমার এখনো মনে পড়ে, তখন আমি কলেজে পড়ছি। ইস্ট পাকিস্তান এডুকেশন উইক অর্থাৎ শিক্ষা সপ্তাহে আমি যন্ত্রসঙ্গীত প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করি। তার পরেরবার ইউনেস্কোর আয়োজনে বাংলা একাডেমির সহায়তায় দেশব্যাপী গল্প ও কবিতা লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছিলাম। সেদিন মা আমার মাথায় চুমু খেয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘তুই পারবি মা, তুই পারবি।’ মা আমার ঘরকন্নার কাজ নিজে যেমন করতেন তেমনি তিনি চাইতেন আমরা, বোনেরাও যেন তা শিখে ফেলি। তাই শবেবরাতের সময় মা আমাদের রুটি বানানোর প্রতিযোগিতায় লাগিয়ে দিতেন। এতে আমিই ফার্স্ট হয়ে যেতাম। দেখা যেত এমনি করে আমরা সব বোনই ঘরকন্নার কাজও রপ্ত করে ফিলেছি। মার সাথে রাত জেগে এক সারিতে দাঁড়িয়ে নামাজও পড়তাম। দোয়া করতাম দু’হাত তুলে।
ছোট্টবেলা একবার ভীষণ ঝড়-তুফান হলো। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ক্ষয়ক্ষতিও হলো। আমরা তখন ১২-১৩ বছরের শিশু। ঝড় থেমে গেলে মা, আর আমার একমাত্র মামা, অনু মামা ঝড় সম্পর্কে লেখার প্রতিযোগিতায় লাগিয়ে দিলেন। মা বললেন, দেখি তোমরা কে সব থেকে ভালো লিখতে পারোÑ
যে কথা সেই কাজ। আমরা, বোনেরা লিখতে বসে গেলাম। সবশেষে আমার লেখাটাই সবচেয়ে ভালো বলে গণ্য হলো। মা আর মামা সেদিন আমার অনেক প্রশংসা করেছিলেন। সেটা আমার ছোট্ট হৃদয়ে আজো গেঁথে আছে। আমার মায়ের যখন ১২-১৩ বছর বয়স, তখন আমার বাবার সাথে বিয়ে হয়। তারপর এক এক করে সাতটি সন্তানের মা হন তিনি। ঘরে সারা দিন খাওয়া-দাওয়া, হইচই, মেহমানদারি, গান-বাজনার আসর সবই যেন ‘মা’ এক হাতে সামলাতেন। আমার বাবা মো: আবদুস সালাম ছিলেন ভীষণ রকম বন্ধুত্ব ভাবাপন্ন মানুষ। যার কারণে সংসারের এত কাজকর্ম গান-বাজনা নিয়েও কোনো ঝামেলাই মনে হয়নি মার কাছে। বরং খালা, মামা, চাচা, বাবার সঙ্গীতজ্ঞ বন্ধুরা মিলে চলত ঘরে মিষ্টি এক আনন্দের পরিবেশ। মাসে এক-দুইবার তো গান-বাজনার বিশাল আয়োজন হতোই। তাইতো আমার বোন রেবেকা সুলতানা, আবিদা সুলতানা, সালামা সুলতানা, চিত্রা সুলতানা, আমার ভাই মো: আলী সুমন ও শওকত আলী ইমন বাংলাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী। শুধু আমি যন্ত্রসঙ্গীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। তাও আমার মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। আজ দেশ-বিদেশে আমার একক যন্ত্রসঙ্গীতের আয়োজন হয়। শাহ্বাগ জাদুঘর মিলনায়তন, ব্রিটিশ কাউন্সিল, আমেরিকার নিউ ইয়র্ক ও ফ্লোরিডায় অনেকবার আমার একক যন্ত্রসঙ্গীতের প্রোগ্রাম হয়েছে। এসবই আমার মায়ের আশীর্বাদ।
আমরা সাত ভাইবোনই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজে যার যার অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। তাই দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অবদান রাখার জন্য আজাদ প্রডাক্টস সর্ব প্রথম রতœগর্ভা ‘মা’দের যে অ্যাওয়ার্ডের ঘোষণা দেয়, তখন আমার মা প্রথমবারই রতœগর্ভা মা হিসেবে স্বীকৃতি পান।
দিন-রাত-মাস-বছর পেরিয়ে মা তুমি আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলে সেই না ফেরার দেশে। আর যে কথাটা তোমাকে কখনো বলা হয়নি গলা জড়িয়ে ধরে সেই ছোট্ট বেলার মতো বলতে ইচ্ছে করছে বারবার হাজারবার ‘মা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি।’ কত দিন তোমায় দেখি না।

অনুলিখন: রুমা ইসলাম


আরো সংবাদ



premium cement