১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মাদকে আসক্ত হচ্ছে মেয়েরাও

-


মাদকের থাবা এখন সর্বত্র। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত সব শ্রেণীর তরুণই আসক্ত হয়ে পড়ছে। খুব সহজে ছেলে-মেয়েদের হাতে পৌঁছে যাচ্ছে ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজাসহ নানা মাদকদ্রব্য। ফলে ধ্বংস হচ্ছে পরিবার তথা গোটা সমাজ। এ ক্ষেত্রে মায়ের সচেতনতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে তরুণদের এই ভয়ঙ্কর মারণনেশা থেকে ফেরাতে

কেসস্টাডি-১
নাজমা খানমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলেটি ভালোভাবেই মানুষ হয়েছে। পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করছে। মেয়েটি ছেলের সাথে বেশি বয়সের পার্থক্য থাকায় বড় ভাইয়ের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাই ভাইয়ের সাথে মিথিলা (ছদ্মনাম) সব কিছু শেয়ার না করে বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে। নিজের রুমে মিথিলা বন্ধুদের নিয়ে রাতভর ইন্টারনেটে নিষিদ্ধ ছবি দেখে। মা নিষেধ করলে বলে, রাতভর তারা পড়াশোনা করে; অথচ প্রতি বছরই সব সাবজেক্টে পাস করতে পারে না। কোনোমতে ওপরের ক্লাসে উঠে যাচ্ছে। স্কুল থেকেও আসে কমপ্লেন। প্রতিদিন বন্ধুদের সাথে ঘুরতে বের হয় আর রাত করে বাড়ি ফেরা প্রতিদিনের রুটিনে পরিণত হয়েছে। একদিন মিথিলার এক বন্ধু তাকে ইয়াবা খেতে দেয়। বলে, এটা খেলে রাতে ঘুম ভালো হবে। এনার্জি বেশি হবে। সেই থেকেই মিথিলা ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে। কিছু দিন পর ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের কাছেও ইয়াবা বিক্রি করতে থাকে সে। মা আর ভাই যখন বিষয়টি টের পায়, তত দিনে নেশায় বুঁদ মিথিলা। মেয়ের এই অধঃপতন সহ্য করতে না পেরে মা নাজমা খানম ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক করে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে পড়ে আছেন।
কেস স্টাডি-২
আনোয়ারা বেগমের স্বামী মারা যান ১৫ বছর আগে। দুই মেয়েকে বড় করে, লেখাপড়া শেখাতে, অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয় তাকে। ছোট দোতলা একটি বাড়ির ভাড়া দিয়েই চলত তার সংসার। মাধ্যমিক পাস করার পর বড় মেয়েকে বিয়ে দেন। আত্মীয়স্বজনেরাই অভিভাবক হয়ে মেয়ের বিয়ে দেন। বিপত্তি ঘটে ছোট মেয়েকে নিয়ে। বখাটেদের উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে আত্মীয়দের সহায়তায় তড়িঘড়ি মেয়ের বিয়ে ঠিক করেন। বিয়ের বেশ কয়েক মাস পর মেয়ের জামাইয়ের আচরণে সন্দেহ দানা বাঁধে আনোয়ারা বেগমের মনে। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারেন, জামাই মাদকসেবী, মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। বেশ কয়েকবার পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলও খেটেছে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে তার। চোখে অন্ধকার দেখেন। ঠিকমতো খোঁজখবর না নিয়ে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার ফলে মেয়ের সর্বনাশ যে হয়ে গেছে তা বুঝতে আর বাকি রইল না। যখন স্থির করলেন, মেয়েকে আর ওই ছেলের সংসারে রাখবেন না, ততক্ষণে তার জন্য অপেক্ষা করছিল ভয়াবহ সংবাদ। এত দিনে তার মেয়েও মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। আর মাদকদ্রব্য বিক্রির অভিযোগে মেয়ের জামাই পুলিশের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে এখন পলাতক। ঘরে মাদক পাওয়ার অভিযোগে তার মেয়েকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। আনোয়ারা বেগম ছুটাছুটি করছেন মেয়েকে বাঁচাতে। আত্মীয়স্বজন তার মেয়েকে একঘরে করে দিলেও তিনি মা হয়ে কী করে মেয়ের করুণ পরিণতি দেখবেন? কী করে মেয়েকে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা করবেন?
কেস স্টাডি-৩
নীলা (ছদ্মনাম) উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ঘুরে বেড়ানো সব কিছুতেই এই জেনারেশনের স্টাইলে চলে। অর্থের অভাব নেই, সব চাইতেই পেয়ে যায়। কিন্তু পারিবারিক একটা অশান্তি সবসময় নীলার মনের মধ্যে তাড়া করত। এত বিত্তবৈভব থেকেও ভালোবাসা, স্নেহ, অভাব, বাবা-মা তাদের নিজেদের ব্যস্ততা, স্ট্যাটাস, লাইফস্টাইল, নিজেদের পারিবারিক কলহ এগুলো নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। একমাত্র সন্তানকে সঙ্গ দেয়ার সময় নেই। কিন্তু মাঝে মধ্যে বাবা-মা তাদের নিজেদের মতামত জোর করে চাপিয়ে দেন, তার মনের কথা না বুঝেই। উচ্ছৃৃঙ্খল জীবনযাপনে অভ্যস্ত নীলাকে এখন আর কোনো কঠিন শাসনই আটকাতে পারে না। শখের বশে মাদকসেবী হয়ে অজানা অনাকাক্সিক্ষত এক অন্ধকারে জীবনের পথে হাঁটছে।

কেস স্টাডি-৪
মিসেস হাসানের স্বামী পেশায় আইনজীবী। নিজের অবস্থান ও স্ট্যাটাস নিয়ে বেশ গর্বিত। দুই ছেলে ও স্বামী নিয়ে সুখী পরিবার। বেশ ভালোভাবেই বড় হচ্ছিল ছেলেরা। ভালো স্কুলে পড়াশোনা করে, খেলাধুলা করে। কিন্তু হঠাৎ-ই যেন বিপত্তি ঘটে ছোট ছেলে তুষারকে নিয়ে। কলেজে ভর্তি হওয়ার কয়েক মাস পর তার পরিবর্তন ধরা পড়ে। ঠিকমতো পড়াশোনা করে না। কলেজে যায় না। সারা রাত জেগে থাকে, আর দিনের বেলায় ঘুমায়। জেগেই টাকা চায়। না দিলে নারকীয় তাণ্ডব চালায়। মা ছেলেকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, কিন্তু পারেন না। পরিবারের সবাই মাকে এ জন্য দায়ী করে। পরে জানতে পারেনÑ কলেজের কিছু খারাপ ছেলের পাল্লায় পড়ে সে ড্রাগ নেয়। ইয়াবা, হিরোইন খায়। বাড়ি থেকে যখন তুষারকে টাকা দেয়া বন্ধ করা হলো, তখন তুষার ঘরের জিনিসপত্র এমনকি মায়ের গয়নাও চুরি করে বেচতে শুরু করল। মাদকদ্রব্য বিক্রি ও নানা অপকর্মের অভিযোগে তুষার এখন জেলে। মা-বাবা ছেলের যন্ত্রণায় অসুস্থ হয়ে যান। একটি সাজানো গোছানো সুখী পরিবারের ভয়ানক পরিণতি।
শুধু পরিবারই ধ্বংস হচ্ছে না, মাদকের ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত হচ্ছে পুরো সমাজ।
এসব কেস হিস্ট্রি প্রমাণ করে, মাদক কতটা ভয়ঙ্কর। এর ভয়াল থাবায় ধ্বংস হয়ে যায় একটি জীবন আর তার সাথে তার আপনজনও। তাই পারিবারিক সচেতনতাও খুবই জরুরি। কেউ মাদকাসক্ত হয়ে গেলে এবং কেউ মাদকাসক্ত যাতে না হয়, সেজন্য মা-বাবা ও তার পরিবারকেই সচেতন হতে সবার আগে।
মাদকাসিক্ত একটি জটিল, মনোদৈহিক, পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা। এ থেকে মুক্তি পাওয়া জটিল ও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, একজন মা স্নেহের বশবর্তী হয়ে কিংবা মমতায় তার সন্তানের মাঝে পরিবর্তন লক্ষ করেও এমনকি সন্তান মাদক নিচ্ছে জেনেও বাবা এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে লুকিয়ে রাখে। নেশাগ্রস্ত সন্তান মায়ের কাছ থেকেই টাকা-পয়সা সাহায্য পেয়ে থাকে। মা সন্তানকে বুঝিয়ে ও শাসন করে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করেন। এর ফল অনেক ক্ষেত্রে মায়ের জন্য ভয়ঙ্কর ও হৃদয়বিদারক হয়। নেশাগ্রস্ত সন্তানের হাতে মায়ের মৃত্যু কিংবা আহত হওয়ার খবর প্রায়ই শোনা যায়। মেয়েদের ক্ষেত্রে আরেকটি ঘটনা লক্ষ করা যায়, সামাজিকতা ও লোকলজ্জার ভয়ে ড্রাগ অ্যাডিক্টেড মেয়েদের রিহ্যাব সেন্টার বা ক্লিনিকে ভর্তি করেন না অভিভাবকেরা। মেয়েটিকে বাড়িতে বন্দী রেখেই চিকিৎসা করেন। এতে অনেক ক্ষেত্রে মেয়েটির মৃত্যুও ঘটতে পারে। কারণ, মাদকাসক্ত রোগীর নেশাদ্রব্য প্রত্যাহারজনিত সময়ে শরীরে এমন কিছু গুরুতর মনোদৈহিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যার চিকিৎসা বাড়িতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এ কারণে রোগীকে হাসপাতাল কিংবা ক্লিনিকে ভর্তি করতে হয়। এ রোগ থেকে মুক্তি পেতে প্রয়োজন দীর্ঘ দিনের চিকিৎসা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও পারিবারিক সচেতনতা।

 


আরো সংবাদ



premium cement